জার্মানিতে ৪০ বছর: জার্মান বাড়িওয়ালার উদারতা

আমাদের বন্ধুদের মধ্যে আমাদের ফ্ল্যাটটি ছিল সবচেয়ে বড়, তাই প্রায়ই সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বন্ধুরা আড্ডা দেওয়ার জন্য আমাদের বাসায় চলে আসতো।

শাহ আলম শান্তি, জার্মানি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 August 2017, 06:45 AM
Updated : 6 August 2017, 07:22 AM

এদের মধ্যে ছিল ফরহাদ, মঞ্জু, সোহরাব আর নুরু ভাই। সেই নুরু ভাই, যিনি আমদেরকে ফ্রাঙ্কফুর্টে আসার পর প্রথম রাতে আশ্রয় দিয়েছিলেন এবং যত্ন করে খাইয়েছিলেন। নারিন্দার নুরু ভাই ছিলেন আমদের স্কুলের বন্ধু সালামের বড় ভাই, তাই আমরা তাকে নুরু ভাই বলে ডাকতাম।

নুরু ভাই এলে আমরা একটু বেশিই খুশি হতাম, কারণ তিনি ছিলেন ভালো রাঁধুনি। বিয়ারের সাথে সাথে আড্ডাগুলো ছিল বেশ প্রাণবন্ত। এর মধ্যে একদিন আমি লন্ডন থেকে একশ’ পাউন্ডের একটা মানি অর্ডার পেলাম। এই অর্থেরও ব্যবস্থা করেছিলেন আমার চতুর্থ বোন, আর এই পাঠিয়েছিলেন বোনের বান্ধবীর স্বামী। এই পাউন্ডের সমপরিমাণ মার্ক পেয়েছিলাম দুইশ’ মার্কের উপরে।

এই মার্ক পেয়ে মনে হয়েছিল যে আমি যেন আরেকটু শক্তি পেলাম। দেশের স্বল্প আয়ের কৃষকরা যেমন ঘরে ধান তুলে হিসেব করেন, আমি সে রকম হিসেবই করতাম । এই পরিমাণ অর্থ দিয়ে কয় মাস টিকে থাকা যাবে তা ঠিক করতাম।

দেশ থেকে যখন আমরা উড়াল দিয়েছিলাম, তখন আমদের সবার কাছেই ছিল রিটার্ন টিকেট। এখন যখন দেখলাম, আমার আর আপাতত ফেরার কোনো সম্ভাবনা নেই, আর  এই টিকিটের মেয়াদ তিন মাসের, তাই ওটাকে আরেক ছোটবেলার বন্ধু হেলালের কাছে পাঠিয়ে দিলাম।

পরে শুনেছি, হেলাল ওই টিকেট ফেরত দিয়ে ট্রাভেল এজেন্টের কাছ থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা উঠিয়ে আমার বাসায় গিয়ে দিয়ে এসেছিল। তার মানে, আমরা টিকেট কিনেছিলাম ১০ হাজার ২০০ টাকা দিয়ে আর ফেরত পেলাম ২ হাজার ২০০ টাকা। তাই আমাদের জার্মানিতে আসার খরচ হয়েছিল ৮ হাজার টাকা ।

বৈরি পরিবেশে শরীর সুস্থ থাকার পর সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলো টাকার। ওই পরিস্থিতিতে যেহেতু আমি রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করিনি, তার মানে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে একেবারেই অনিশ্চিত ছিলাম। তাই স্বাভাবিকভাবেই টাকা নিয়ে আমাকে ভাবতে হত অনেক বেশি। সে কারণে খুবই সাবধানে আমাকে চলতে হয়েছে। তবে কোনো সময় আমার অন্যান্য বন্ধুদের থেকে থাকা ও খাওয়ার ক্ষেত্রে বেশি কষ্ট করিনি।

আমাদের ফ্ল্যাটটির ভাড়া ছিল ৬৫০ মার্ক। সেখানে আমরা চারজন থাকি বা সাতজন থাকি, ভাড়া একই। তার মানে, এখন যখন ফ্লাটের মানুষ বেড়ে গেল, তখন আমাদের মাথাপিছু ভাড়াও কমে আসল। তখনন আমাদের দিতে হত ৯৩ মার্কের মত।

আমাদের বাড়িওয়ালার অনেক গুণের মধ্যে একটা গুণ ছিল- তার ফ্রাঙ্কফুর্টের দু’টো আর ওফেনবাখের একটি বাড়িতে এশিয়ান বিদেশি তথা বাংলাদেশ থেকে আগত লোকজন তাড়াতাড়িই মাথা গোঁজার ঠাই পেতেন। আর যারা তখন তার বাড়িতে থাকতেন, বিশেষ করে আমাদের বাড়িতে থাকতেন, তাদেরকে ভাড়া হিসেবে বেশি অংকের ‘কুইটুং’, মানে রশিদ লিখে দিতেন।

এই জার্মান ‘কুইটুং’ শব্দটি প্রয়োজনের কারণে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীরা অনেক আগেই শিখে ফেলতেন। যারা রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন, তাদেরকে ভাড়ার রশিদ সামাজিক নিরাপত্তার অফিসে দেখাতে হতো। তখন যদি ভাড়া দিতে হতো ৯৩ বা একশ’  মার্ক, তাহলে বাড়িওয়ালা লিখে দিতেন দুইশ’ মার্ক। সুতরাং ওনার বাসায় রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীরা সবাই একশ  মার্কের বাড়তি সুবিধা পেতেন।

কেন যে এই বাড়িওয়ালা জার্মান হয়েও রাষ্ট্রের বিপরীতে গিয়ে উদ্বাস্তুদের জন্য এই বাড়তি সুবিধা আদায় করে দিতেন, সে বিষয়ে আমি তখন পরিষ্কার হতে পারিনি।
চলবে ...

লেখক: 

প্রবাসী বাংলাদেশি

এই লেখকের আরও পড়ুন-

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!