জার্মানিতে ৪০ বছর: খাট সংকট ও খাদ্য সমাচার

আমরা যখন জার্মানিতে আসি, তখন বাংলাদেশের সাথে জার্মানির ভিসা প্রথা চালু হয় নাই। আমরা এসেছিলাম ১৯৭৭ সালের ১৪ অক্টোবর এরফ্লটের একটি ফ্লাইটে।

শাহ আলম শান্তি, জার্মানি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 July 2017, 08:27 AM
Updated : 31 July 2017, 08:27 AM

সেই ফ্লাইটে আমরা চারজন ছাড়াও ছিল আরও নয়জন বাংলাদেশি। তার মানে মোট ১৩ জন। শুনেছি যে আমাদের আগের এই এরফ্লটের সাপ্তাহিক ফ্লাইটগুলোতেও কিছু না কিছু বাংলাদেশি আসতেন।

আমাদের পরের ফ্লাইটে যারা দেশ থেকে এসেছিলেন, তারা সহজভাবেই ইমিগ্রেশন পার হয়েছিলেন। কিন্তু জার্মান ইমিগ্রেশন যখন বিষয়টি আমলে নিলেন তখন থেকে, মানে আমাদের ওখানে যাওয়ার একটা ফ্লাইট পর থেকে তাদের আচরণ হলো ভিন্ন। তারা প্রতি ফ্লাইটের বাংলাদেশ থেকে আগত যাত্রীদের কয়েকজন করে ডিপোর্ট করা শুরু করলেন।

ওই সময়ই জার্মানি চলে আসা দু’জন, যারা ছিলেন সেই স্লোসেন স্ট্রিটে ৪ নম্বরের একতলার বাসিন্দা, রোকনপুরের মতির বড় ভাই আতাউর ও তার এক মামাত ভাই মানিক জার্মানিতে আসলেন। স্বাভাবিকভাবে নতুন অবস্থায় বাসা পাওয়া কঠিন, তাই তারা হলেন আমাদের ওফেনবাখ বাসার ফ্ল্যাটমেট। সুতরাং তখন আমাদের চার রুমের বাসিন্দা হলাম ৭ জন।

 আমাদের ইচ্ছে ছিল, ছয়জন এই ফ্লাটে থাকবো। তাহলে একেক রুমে দুই জন করে থাকলে আমাদের ড্রয়িং রুমটা আড্ডা দেওয়ার জন্য ফাঁকা থাকবে। সেটা তো হলোই না, তার সাথে আমাদের একটি খাট কম পড়লো। কি আর করা, আমরাও তো প্রথম অবস্থায় ফ্রাঙ্কফুর্টে বন্ধুদের অসুবিধা করে থেকেছি।

আমরা পরিকল্পনা করলাম, নতুন চার জনকে চারটি খাট দেওয়ার পর সেলিম ও আমি এক খাটে থাকবো আর রশিদ থাকবে ড্রয়িং রুমের সোফায়। সেলিম আর আমি ছাত্র থাকাকালীন অবস্থায় হোস্টেলে অনেক সময় এক বেডে রাত কাটিয়েছি। সেখানে কম জায়গার জন্য একটু অসুবিধা হতো, কিন্তু তেমন অস্বস্থি বোধ করতাম না।

আতাউর ভাই আর মানিক ভাই প্রথম থেকেই বললেন, তারা দু’জন আলাদা খাবেন। সুতরাং আমাদের সংসারে যে পাঁচজন ছিলাম, সেই পাঁচজনই থেকে গেলাম। এদিকে জামাল আর কাজলের ভিসা আর কাজের পারমিশন হয়েছে। সাথে ‘সোসিয়ালআমট’, মানে সামাজিক নিরাপত্তার অফিস থেকে ৪৬০ মার্কও পেয়েছে।

১৯৭৭ সালে জার্মান মার্কের সাথে টাকার বিনিময় মূল্য ছিল এক ‘মার্ক’ সমান ১০ টাকা। ওই সময় যখন ধীরে ধীরে পণ্যের দামের সাথে পরিচিত হতে থাকলাম, তখন দেখলাম খাবার জিনিসের দাম জার্মান মুদ্রার একক হিসেবে বেশ সস্তা। দুধের দাম আর পানির দাম তো প্রায় কাছাকাছি। মাখন ২৫০ গ্রাম এক মার্কের মত। চাল, তেল, ময়দা, ডিম, চা, কফি, কলা, আপেল, আঙুর, মুরগি, ফলের জুস- এইসব নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দামও জার্মানির একজন দরিদ্র মানুষের জন্য ক্রয় সীমার মধ্যেই ছিল এবং এখনও আছে।

আমরা যে পাঁচজন একসাথে খেতাম, তারা মেসের মত ‘মার্ক’ ভাগ করে দিতাম। যতদূর মনে পড়ে, আমার তখন মাথাপিছু খাবারের জন্য ৯০ মার্ক লাগতো। এর মধ্যে আবার হোস্টেলের মত মাসের শেষ দিনে ভাল খাবার, যেমন- পোলাও, মুরগির রান ভাজা, মাংসের তরকারি খেতাম। রান্না তখন এক রকম হলেই হত। কারণ তখনও আমরা ভারতীয় মশলার সন্ধান পাই নাই। সাথে থাকতো আমাদের জন্য বিয়ার আর সেলিমের জন্য ফলের জুস।

ওই সময় আমরা যে নিয়ম করেছি, সেটা বাস্তবায়ন করতে কারো কাছ থেকে কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন হয়নি। তাই সেই পুরনো কথা বার বার মনে হয়- সংকট কালে মানুষ যতটুকু এক থাকে, অন্য সময় সেটা আর থাকে না। এটা ব্যক্তিগত,পারিবারিক পর্যায় থেকে শুরু করে জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত প্রযোজ্য।


চলবে ......

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

এই লেখকের আরও পড়ুন-

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!