জার্মানিতে ৪০ বছর: প্রথম বড়দিনের উৎসব দেখা

আমাদের ফ্লাটে যে পুরনো পাঁচজন ছিলাম, তাদের মধ্যে দু’জন বেশ খোঁজাখুঁজির পর কাজের সন্ধান পেল। আর যারা নতুন এসেছেন, তারা তখন রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার প্রক্রিয়ার কাজে ব্যস্ত ।

শাহ আলম শান্তি, জার্মানি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Sept 2017, 06:30 AM
Updated : 16 Sept 2017, 06:30 AM

আমার আর কী কাজ? সকালে বাজার করা বা এদিক-সেদিক ঘোরার ইচ্ছে করলে বের হতাম, তবে ঠাণ্ডার কারণে বেশি সময় বাইরে থাকতাম না।

ডিসেম্বরের শীত, তারপর বিকেল হলেই সন্ধ্যের অন্ধকার। কেমন যেন একটা গুমোট ভাব। ভাবতাম, আহা! দেশের এই ডিসেম্বর মাস কতোই না আরামের! হালকা ঠাণ্ডা আর মিঠে রোদ। জার্মানিতে এসে তো রোদের মুখ তখনও ভাল মতো দেখা হয়নি, আর কবে যে দেখবো- সেটাও তখন অনিশ্চিত।

তারপর কাজ একটা বের করলাম। আসার সময় দেশ থেকে যে জার্মান বই নিয়ে এসেছিলাম, সেটা পড়ার চেষ্টা করা। বই তো পড়া যায়, কারণ অর্থ ইংরেজিতেই দেওয়া। তারপর সমস্যা হলো- উচ্চারণ কি রকম হবে সেটা পারতাম না। তবে শব্দের অর্থ মনে রাখার চেষ্টা করতাম।

প্রথম দিকে সমস্যা হলো,  ‘এনটশুলডিগুং’ (Entschuldigung) শব্দের উচ্চারণ নিয়ে। এই শব্দটি প্রাথমিক পর্যায়ে শেখা খুব জরুরী ছিলো, কারণ এর অর্থ হল- এক্সকিউজ মি। মানে কাউকে রাস্তা, বাজার বা অন্য কিছু জিজ্ঞেস করতে হলে তো এই শব্দ দিয়েই শুরু করতে হয়।

বইয়ের প্রথম পাতায় ছিল “Ich bin Müller, Du bist, Sie sind.”-তার মানে আমার নাম মুইলার। এখানে লক্ষ করলাম, জার্মান ভাষায় কাউকে সম্বোধন করার ক্ষেত্রে দুটি ধরন আছে। যেমন ‘দু’ (Du), মানে ‘তুমি’। আর ‘জি’ (Sie), মানে ‘আপনি’। যেখানে ইংরেজিতে ‘you’ দিয়েই সবাইকে সম্বোধন করা যায়। ‘জি’ শব্দটি ব্যবহার করা করা হয় কেউ যদি অপরিচিত এবং সম্মানীয় হন, তার ক্ষেত্রে । তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মনে হয় ‘দু’-ই ব্যবহার করা হয়।

জার্মানিতে আঞ্চলিকভাবে উচ্চারণেরও পার্থক্য আছে। আঞ্চলিকতার উচ্চারণের ভেদাভেদ সব ভাষায়ই আছে, এখানে তার ব্যতিক্রম হবে কেন?

২২ ডিসেম্বর থেকে জার্মানিতে দিন একটু একটু করে বড় হতে থাকলো। অবশ্য সপ্তাহে ১১ মিনিট দিন দীর্ঘ হলে তো টেরই পাওয়া যায় না। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি একটু ভালো অনুভব করি এই ভেবে যে এবার আর দিন ছোট হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

১৯৭৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর, চলে এলো ক্রিস্টমাসের সন্ধ্যা। এর আগে কোনো ধারণাই ছিল না যে ইউরোপের খ্রিস্টান সম্প্রদায় এই দিনটি কীভাবে উদযাপন করে। আর দিনটিকে আরও ঘোলাটে করে দিল কাজল। আগেই বলেছি যে কাজল একটি কাজ পেয়েছে। ওইদিনও তার কাজ ছিলো, তাই সে সকালেই চলে গিয়েছিল।

আসলে কি, এই বড়দিনে যাদের কাজ করতে হয়, সেটা হয় বেশ ঢিলেঢালাভাবে। তারপর কিছু কাজের পরে নিজেদের কায়দায় বড়দিনের পার্টি করা হয়। সেই পার্টিতে মূলত ড্রিংকস-ই চলে, সাথে থাকে হালকা খাবার।

সেদিন মনে হয়, কাজলদের কাজের জায়গায় ভালোই পানাহার হয়েছিলো। সে ফিরল বিকাল ৪টায়। দেখলাম তার মুখ খুশিতে উদ্ভাসিত। সে ঘরে ঢুকেই তার বন্ধু জামালকে বলল, “জামাল জামাল, ভাইনাখট পার্টি শুরু হয়ে গেছে।”

আমরা বাসায় ছিলাম চারজন। তাড়াতাড়ি উঠে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সেই ‘ভাইনাখট পার্টি’ বা ক্রিস্টমাসের উৎসব দেখার চেষ্টা করলাম। ভেবেছিলাম রাস্তায় মানুষ বের হবে, বাজি পোড়াবে, ড্রিংক করবে। কিন্তু কোথায় আমাদের মাথায় থাকা সেই দৃশ্য! জানালা খুলে রাস্তায় ভালো করে দেখলাম আমাদের কল্পনার বিপরীত দৃশ্য। রাস্তা প্রায় শূন্য।

যতোই সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিলো, ততোই রাস্তার শূন্যতা বাড়ছিলো। আর হবেই না কেন? খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান, যাকে জার্মান ভাষায় বলা হয় ‘হাইলিগার আবেনড’ বা ‘পবিত্র সন্ধ্যা’ তথা বড়দিনের উৎসব। এদিন নাকি যিশুখৃস্টের জন্মদিন। তবে এই ধর্মের পণ্ডিতদের মতে যিশুর এই জন্মদিন বাইবেলের কোথাও উল্লেখ নেই।

তারপরও এই সন্ধ্যায় যারা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন, তারা মিলিত হন পরস্পরের সাথে। উপহার বিনিময় করেন। তারপর একসাথে মজার মজার খাবার খান। সাথে তো লাল-সাদা বা অন্য রঙের হালকা থেকে কড়া পানীয় থাকবেই। এসব চলবে গভীর রাত পর্যন্ত, আর চলবে আড্ডা।

চলবে ...

লেখক: 

প্রবাসী বাংলাদেশি

এই লেখকের আরও পড়ুন-

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!