জার্মানিতে ৪০ বছর: নাম বিভ্রাটের বিড়ম্বনা

জার্মানিতে সুন্দর ও বড় বাসা পেলাম। এবার মাসে মাসে ভাড়ার টাকা গুণতে হবে আমাদের।

শাহ আলম শান্তি, জার্মানি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 June 2017, 06:30 AM
Updated : 6 June 2017, 06:32 AM

আগে কথা ছিল, নতুন বাসায় আমাদের ফ্রাঙ্কফুর্টের বন্ধু ফরহাদ আসবে।তাই তখন আমরা হিসেব করেছিলাম যে ৬৫০ মার্কের ভাড়া যদি আমরা চারজন ভাগ করে দেই, তাহলে আমরা চালিয়ে নিতে পারবো। কিন্তু আসার কয়েকদিন পর ফরহাদ জানালো, ও আসছে না।

ফরহাদ ওফেনবাখের এই বাসায় আসবেই বা কী করে, ওর বাসাটা এক রুমের হলেওফ্রাঙ্কফুর্ট মেইন স্টেশন থেকে দূরত্ব ছিল ১০ মিনিটের হাঁটাপথ। আর সেই ১৯৭৭ সালে, যখন জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতায়, তখন অনেক ছাত্রলীগের ছেলেরা জার্মানিতে আসছিল।

এদের অনেকেরই সাথে ফরহাদের জানাশোনা ছিল।কারণ সেও আওয়ামীলীগ ও বাকশালের সময় ছাত্রলীগের উচ্চ পর্যায়েরই একজন ছিল।তাই আমাদের মাস ছয়েক আগে আসলেও ইতোমধ্যেই ওর সামাজিক শেকড় বেশ শক্ত হয়ে গিয়েছিল।

এই নতুন পরিস্থিতিতে আমাদের আবার নতুন লোক খোঁজার প্রয়োজন হয়ে পড়ল। তবে না, আমাদের বেশিদিন লোক খুঁজতে হয় নাই।একসাথে পেলাম দু’জনকে।তাদের একজন জামাল, সে ছিল রশিদের বন্ধু।আরেকজন কাজল, সে জামালের বন্ধু।

আমরা তো খুশি, কারণ লোক বাড়লে ভাড়া কমবে।সেটাই ছিল ওই সময় আমাদের দরকারি ব্যাপার। ওরা শুধু বাসায়ই না, আমাদের হাড়ি-পাতিলের সাথেও যোগ দিল।মানে এবার আমাদের সংসারের সদস্য সংখ্যা দাঁড়াল পাঁচে।

কয়েকদিনের মধ্যে লক্ষ্য করলাম, কাজল সবচেয়ে ভালো রান্না করে,তারপর জামাল।সুতরাং ওরা ভাল খাবার জন্য ভালই রান্না করতো। তাই আমাদের খাবারের মান কিছুটা উন্নত হলো। 
নভেম্বর এগোতে থাকলো আর তার সাথে ঠাণ্ডাও বাড়তে থাকলো। বাজার করা ছাড়া তেমন একটা বের হওয়া হতো না। তারপরও এর মধ্যে একদিন বিকেলে বাসার পেছন দিকে আমরা হাঁটতে বের হলাম।

মিনিট দশেক হাঁটার পর রাস্তার বাম দিকে দেখতে পেলাম একটা নদী বয়ে যাচ্ছে। পরে জেনেছি, এই সেই জার্মানির অন্যতম প্রখ্যাত ‘মাইন’ নদী। নদীটি ফ্রাঙ্কফুর্টের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ওফেনবাখ শহরের উপর দিয়েও প্রবাহিত হয়েছে। সেই কারণে ফ্রাঙ্কফুর্টকে বলা হয়‘ফ্রাঙ্কফুর্ট আম মাইন’। আর ওফেনবাখ শহরকে বলা হয় ‘ওফেনবাখ আম মাইন’।তার মানে এই দুটি শহর মাইন নদীর তীরে অবস্থিত।

মজার ব্যাপার হলো, জার্মানির পূর্বাঞ্চলে পোল্যান্ডের সীমানায় আরেকটি শহর আছে, তার নামও ‘ফ্রাঙ্কফুর্ট’।কিন্তু এখানে দুই শহরকে চেনার জন্য বলা হয়‘ফ্রাঙ্কফুর্ট ওডার’এবং ‘ফ্রাঙ্কফুর্ট আম মাইন’।তার অর্থ, একটির উপর দিয়ে ওডার ও অন্যটির উপর দিয়ে মাইন নদী প্রবাহিত হয়েছে।

এই ফ্রাঙ্কফুর্টের নাম নিয়ে অনেক সময় বিভ্রাট হয়।যেমন- ৯০ দশকে আমার বাসায় প্রায় প্রতি বছর পুস্তক প্রকাশক আলীগড় লাইব্রেরির মালিক কাইয়ুম ভাই আসতেন।তিনি থাকতেন আমার বাসায়। একবার ওই দশকেই জার্মানির পূর্বাঞ্চলে বেশ বন্যা হয়েছিল এবং ফ্রাঙ্কফুর্ট ওডারশহরের কোনো কোনো জায়গায় পানি উঠেছিল।

এই খবর কাইয়ুম ভাই টেলিভিশনে দেখে সাথে সাথে আমাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলেন, “শান্তি আপনার বাড়ি থেকে এখন পানি কতদূর?” আমি তখন হেসে জানালামএই দুই শহরের নামে পার্থক্য।

আরেকবার এই দুই শহরের নামের বিভ্রাট নিয়ে প্রায় বিপদেই পড়তে যাচ্ছিলাম। তখন আমি বার্লিন - ফ্রাঙ্কফুর্ট প্রায় নিয়মিত আসা যাওয়া করতাম। ওই সময় একবার কার শেয়ারিং-এ বার্লিন থেকে ফিরছিলাম।

‘কার শেয়ারিং’ হলো যে কোন চালক তার গন্তব্যস্থলে যাওয়ার সময় যদি তার গাড়িতে আসন খালি থাকে, তখন সে ইন্টারনেটে জানায় যে আমি অমুক জায়গায় যাচ্ছি এবং আমার গাড়িতে এই ক’টা সিট খালি আছে।আগ্রহী যাত্রীরা সেটা দেখে যোগাযোগ করে এবং পরে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় মিলিত হয়ে একসাথে যাত্রা করে।

যাহোক, বার্লিন থেকে ফেরার পথে এরকমই একজন চালকের সাথে যোগাযোগ হয়েছিল।আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম রাত সাড়ে ৮টার দিকে। গাড়িটি ছিল‘বিএমডব্লিউ’। তাই খুশি হয়েছিলাম যে দ্রুতগামী এই গাড়িতে আমরা তাড়াতাড়িই পৌঁছে যাব।

গাড়িতে উঠে বসলাম।চালককে মনে হলো ২৪-২৫ বছরের একজন বিদেশি তরুণ।আর সাথে ছিল আরও দু’জন বিদেশি।খুব সম্ভবত তারা পূর্ব ইউরোপের লোক হবেন।

যাক গাড়ি চলতে শুরু করল।আধা ঘণ্টার মধ্যেই হাইওয়েতে উঠে গেলাম। আমি বসে ছিলাম পেছনের আসনে। জার্মান হাইওয়েগুলোতে বড় বড় করে নীল সাইন বোর্ডে রাস্তার দিক-নির্দেশনা থাকে যে কোন দিকে কোন শহর আছে।এভাবেই গন্তব্য স্থানে পৌঁছানো যায়।

কিছুদূর পথ অতিক্রম করার পর হঠাৎ দেখি, এই তরুণ চালক ফ্রাঙ্কফুর্ট ওডারের দিকে গাড়ি চালানো শুরু করে দিয়েছে।আমি দেখেই সাথে সাথে চেঁচিয়ে বলতে শুরু করলাম,“এই তুমি কোনদিকে গাড়ি চালাচ্ছো?”ও বললো, “কেন?আমি তো ফ্রাঙ্কফুর্টের দিকে গাড়ি চালাচ্ছি।”

আমি বললাম,“তুমি ফ্রাঙ্কফুর্টের দিকে গাড়ি চালাচ্ছো ঠিকই,তবে এটা কোন ফ্রাঙ্কফুর্ট সেটা কি তুমি জানো?”ছেলেটি বলল, “না।”

তখন আমি ‘ফ্রাঙ্কফুর্টআম মাইন’এবং ‘ফ্রাঙ্কফুর্টওডার’-এর অবস্থান বুঝিয়ে দিলাম।তার মানে একটি শহর আরেকটি শহরের প্রায় বিপরীতে। এরপর সে জানালো যে তার ন্যাভিগেটর কাজ করছে না। আর এই পথে সে কোনদিন যায়নি। গাড়িটিওতার নিজের নয়, বান্ধবীর।

বুঝলাম যেসে এখন দুশ্চিন্তায় পড়েছে। আমি ওকে তখন বললাম,“তোমার চিন্তার কোনো কারণ নাই। মনে কর এখন আমি তোমার জীবন্ত ন্যাভিগেটর। কারণ এই বার্লিন - ফ্রাঙ্কফুর্ট হাইওয়েতে আমি অসংখ্যবার চলাচল করেছি, তাই এই রুটটি আমার মুখস্ত।”

আমি তাকে গাড়ি আগের দিকে নিয়ে আসতে বললাম। তবে হাইওয়েতে গাড়ি ঘোরানো সোজা নয়।প্রথমে হাইওয়ে থেকে বেরিয়ে যেতে হবে, তারপর আগের দিকে আনতে হলে কমপক্ষে ১০-১২ কিলোমিটার ঘুরে আসতে হবে। সেটাই সে করলো।

তারপর তাকে বললাম যে তুমি এই জায়গা থেকে ‘ফ্রাঙ্কফুর্টআম মাইন’লেখা কোন দিক-নির্দেশনা পাবে না। তাই তোমাকে প্রথম চালাতে হবে ‘লাইপজিগ’শহরের দিকে।এই শহর পার হয়ে তুমি নেবে ‘এরফুর্ট’-এর দিকে। সেদিকে চালাতে থাকলে যখন তুমিফ্রাঙ্কফুর্ট আম মাইন৩২৯ কিলোমিটার দূরে এমন দিক-নির্দেশনা দেখতে পাবে।

চালক তাই করছিল আর আমি সজাগ দৃষ্টি রাখছিলাম যে সে সঠিক পথে যাচ্ছে কি না। না, এরপর আর কোন ভুল হয়নি।একটু দেরি হলেও আমরা ভালমতোই পৌঁছেছিলাম।

শহরের নামের মিলের জন্য যে বিভ্রাট হয়, সেই কথা বলতে গিয়ে অনেক কথাই বলা হলো। আগামী পর্বে আবার ফিরে আসবো মূল অংশে। আশা করি সাথে থাকবেন।

চলবে ...

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

এই লেখকের আরও পড়ুন-

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!