জার্মানিতে ৪০ বছর: বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত ওফেনবাখের কথা

আমাদের তখন অন্যান্য কাজের মধ্যে একটি বিশেষ কাজ ছিল- রাস্তা চেনা। তাই আমরা মাঝে মাঝে বেরিয়ে পড়তাম।

শাহ আলম শান্তি, জার্মানি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 June 2017, 03:49 AM
Updated : 29 June 2017, 06:04 AM

প্রথম দিন যখন আমরা ওফেনবাখের কেন্দ্রস্থলে গিয়েছিলাম, তখন আমরা চেনার সুবিধার জন্য সোজা সোজা পথ নিয়েছিলাম। পরের বার যখন ওই মার্কটপ্লাজের দিকে গেলাম, তখন অভিজ্ঞতার জন্য সেই কেন্দ্রস্থলের দিকের একটা ধারণা করে নতুন ছোট ছোট রাস্তা দিয়ে এগোতে চেষ্টা করলাম।

মনে আছে, বেশ কয়েকটি বাক অতিক্রম করে বড় রাস্তায় গিয়ে দেখি, একটু দূরে হাতের ডান দিকে উঁচু উঁচু সব ভবন। সুতরাং বুঝে নিলাম, ওই যায়গার একটু সামনেই সেই মার্কটপ্লাজ হবে।

বড় রাস্তা পার হয়ে দেখি বেশ বড় একটি পার্ক। তাই এবার পার্কের ভেতর দিয়ে কোণাকুণি হেঁটে আরেকটি বড় রাস্তায় গিয়ে উঠে রাস্তা পার হয়ে অল্প একটু হেঁটে মার্কটপ্লাজের পেছন দিক দিয়ে কেন্দ্রস্থলে পৌঁছে গেলাম। এভাবে আমরা পাঁচজন যদি বিভিন্ন স্থানে যেতাম, তাহলে কিছু নতুন রাস্তার সাথে পরিচিত হতাম।

সন্ধ্যায় আমাদের আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তু থাকতো, কে কয়টা নতুন পথ আবিষ্কার করেছে। ওই সময় আমরা নতুন রাস্তা বা পথ চেনাকে আবিষ্কার বলতাম। তার মানে আমরা রাস্তা চেনাকে আবিষ্কার নাম দিয়ে বাড়তি একটা তৃপ্তি পেতাম।

ওফেনবাখ একটি ছোট শহর। শহরটি জার্মানির ১৬টি প্রদেশের মধ্যে একটি, ‘হেছেন’ প্রদেশে অবস্থিত। শহরের পশ্চিম এবং উত্তর দিকে ফ্রাঙ্কফুর্ট শহর আর দক্ষিণ- দক্ষিণ পূর্ব দিকে মাইন নদী বেঁকে গেছে। পৃথিবীর প্রত্যেকটি শহরেরই কম-বেশি ইতিহাস আছে, সে রকম আছে এই ওফেনবাখেরও।

প্রখ্যাত জার্মান কবি ও দার্শনিক গোয়েথে থাকতেন ফ্রাঙ্কফুর্টের ‘ছায়েলের’ কাছাকাছি। ১৭৭৫ সালে কবি ওফেনবাখ শহরে নিয়মিত আসতেন। কারণ তার প্রেমিকা ‘লিলি সোরনেমান’ থাকতেন এই ওফেনবাখ শহরেই। পরে বইয়ে পড়েছি যে, কবি গোয়েথে প্রায় সময় ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে ওফেনবাখে হেঁটেই আসতেন। অবশ্য তার বাসা ফ্রাঙ্কফুর্টের ছায়েল থেকে প্রেমিকা লিলির বাসা ১০-১২ কিলোমিটারের দূরত্বে ছিল। আর প্রেমের টানের কাছে সে দূরত্ব তো তেমন কোন দূরত্বই না।

আরও পড়েছি যে, গোয়েথে শুধু হেঁটে ওফেনবাখেই যেতেন না, তিনি ফ্রাঙ্কফুর্টের থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে ডার্মস্টাড শহরে মাঝে মাঝে হেঁটে যাওয়া-আসা করতেন। তবে ওখানে তার কোন প্রেমিকা ছিল কিনা, সেই তথ্য আমি পাইনি।
জার্মানির বড় শহরগুলোতে তো অবশ্যই, এমনকি ছোট ছোট শহরগুলোর সাথেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস জড়িত। যুদ্ধের শেষ বছরগুলোতে যখন হিটলারের ১৯৩৯ সালের যুদ্ধের শুরুর প্রথম বছরগুলোর দাপটের অনেক ভাটা পড়েছে, তখন মিত্রবাহিনীর বিমানগুলো জার্মানির আকাশে আধিপত্য বিস্তার লাভ করে। তারা জার্মানির একের পর এক শহরগুলোতে ইচ্ছে মতো বোমাবর্ষণ করতে থেকে।

ওই সময় ১৮ মার্চ, ১৯৪৪ সালে মিত্রবাহিনীর ৭৫০টি যুদ্ধ বিমান ওফেনবাখ শহরের উপর ব্যপক বোমাবর্ষণ করে। তখন বোমার ভয়ে শহর প্রায় ফাঁকা ছিল, তারপরও সেই রাতে ১৭৬ জন ওফেনবাখবাসী প্রাণ হারান। আর সেই বোমায় শহরের ৩৬ শতাংশ ধ্বংস হয়ে যায়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ইউরোপে শেষ হয়েছে হিটলারের ৩০ এপ্রিল, ১৯৪৫ সালে আত্মহত্যা এবং ৭ মে ১৯৪৫ সালের রাতে জার্মানির মিত্রবাহিনীর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের চুক্তি সাক্ষরের মধ্য দিয়ে। যেটা কার্যকরী হয় ৮ মে, ১৯৪৫ সালে।

তবে তার কিছু দিন আগে ১৯৪৫ সালের ২৬ মার্চ, ওফেনবাখ শহরকে আমেরিকান বাহিনী হিটলার মুক্ত করে। আর এই শহরেই আমার কেটেছে জীবনের সুন্দর সময়ের ৩৪টি বছর।

চলবে ...

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

এই লেখকের আরও পড়ুন-

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!