জার্মানিতে ৪০ বছর: মুক্তিযুদ্ধের সময় ফাইলের বালিশে ঘুমাতাম

ফরহাদের এক রুমের অ্যাপার্টমেন্ট মনে হয় ১৫ বর্গ মিটারের বেশি ছিল না। এই স্বল্প জায়গায় পাশাপাশি দু’টো সিঙ্গেল খাট। ঘরে ঢুকে বাম দিকে ছিল একটা ইলেকট্রিক চুলা আর বাইরে ছিল বাথরুম।

শাহ আলম শান্তি, জার্মানি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Jan 2017, 07:05 AM
Updated : 18 Jan 2017, 07:06 AM

নুরুর সাথে মনে হয় নিলুর কোন এক ফাঁকে কথা হয়েছিল। তাই সে জানাল, ও নুরুর সাথে থাকবে। নিলু চলে যাওয়ার পর আমরা বাকি রইলাম তিনজন। আর ফরহাদ ও নিজাম তো আছেই।

দুপুরে খাবার সময় আমাদের নতুনদের জন্য খাবার ছিল কৌটার কিমা মাংস বা মুরগির পাখনার হাড়,গিলা-কলিজার প্যাকেট- যেগুলোর দাম ছিল খুব কম। আর প্যাকেট চাউলের ভাত করা হত,যেগুলো গরম পানিতে ছেড়ে দিলে ফুলে উঠা পর্যন্ত চুলায় রেখে দিতে হয়। তারপর উঠিয়ে প্লেটে কেটে রাখা।

ফরহাদ আর নিজাম যখন রান্না করতো, তখন আমারা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতাম। ভাবতাম, ক’দিন পর আমাদের এগুলো খেয়েই পেট চালাতে হবে। এটা বিশ্বজনীন যে মানুষ কোন সংকটকালে প্রথমেই খোঁজে খাবার,তারপর মাথার ওপর ছাদ,এরপর অন্য কিছু।

রাত ঘনিয়ে আসলো, এবার শোবার পালা। আগেই বলেছি,ছোট্ট ঘরে দু’টো বিছানা। তাই পা ফেলার কোন জায়গা ছিল না। ফলে আমাদের পাঁচজনকেই ওই দু’টো বিছানায় শুতে হল। মানে চোখ বুজে সোজা হয়ে পড়ে থাকা,এপাশ-ওপাশ করার কোনও সুযোগ ছিল না।

আমার অবশ্য এভাবে শোওয়া নতুন নয়। বরং এর চেয়েও খারাপ অবস্থায় ছিলাম যখন ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলছিল। ওই সময় আগরতলার শিক্ষক সমিতির অফিসে প্রায় ২৫ জন মানুষ ফাইল মাথায় দিয়ে পড়ে থাকতাম। ফাইলের বালিশও ওখানে পর্যাপ্ত ছিল না, তাই ফাইল পেতে হলে সন্ধ্যার আগেই ফাইল দখল করে বসে থাকতে হতো।

ওখানে শোওয়ার থেকেও বেশি খারাপ লাগতো যখন সারারাত মশার কামড় খেতাম। এরচেয়েও খারাপ অবস্থা হল যেদিন আমাদের একটি মাত্র টয়েলেটে কয়েকদিন পর থেকে আর যাওয়ার অবস্থা রইল না। মনে আছে, তখন লুকিয়ে এই হোটেল-সেই হোটেলে টয়েলেট করে তাড়াতাড়ি কেটে পড়তাম।

ফরহাদ আর রশিদেরও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এই ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তাই হয়ত দুটি বিছানায় পাঁচজন খুব কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়নি। আমি পৃথিবীর সব জায়গায় ঘুমোতে পারব যদি কানের কাছে মশার ভনভনানি না থাকে।

যাহোক, জার্মানিতে আসার পর নুরুর বাসায় অর্ধেক দিন, ফরহাদের বাসায় একদিন ও একরাত কেটে গেল। এবার আমরা জার্মানিতে কীভাবে থাকবো,কী করবো- তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় চলে এলো।

পরদিন ফরহাদ জানালো, ওই বিল্ডিং-এর একেবারে নিচের তলায় এক রুমে আমাদের কলেজ বন্ধু মঞ্জুর ও মতি থাকে। মঞ্জুর থাকতো কোর্ট হাউজ স্ট্রিটে আর মতি হল রোকনপুরের ছেলে।

কোন সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার আগে আমি চেষ্টা করি, সেই বিষয়ে সাম্ভাব্য অধিক মানুষের সাথে আলাপ করার। ভয় ছিল, পাছে না ওরা অন্যরকম আচরণ করে? সন্ধ্যার দিকে আমরা মতিদের ঘরে গেলাম।

বেল দিতেই মঞ্জুর দরজা খুলে দিল। হাসিমুখেই আমাদের স্বাগতম জানাল। কিন্তু উপরে ফরহাদের ঘরে যেমন উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়েছি, সেটা মনে হল এখানে অনুপস্থিত। আর মঞ্জুরই বা কী করবে? মতির পরে এসেছে সে এবং মতির ঘরেই থাকছে।

ওখানে মঞ্জুরের কাছ থেকে শুনলাম,মতি হোটেল শেরাটনে কাজ করে আর মাসিক বেতন পায় ৭২৯ মার্ক। আমাদের কাছে ওই টাকা তখন বিরাট একটি অঙ্ক মনে হলো। ভাবলাম, মতির তাহলে আসা-যাওয়ার খরচ উঠে গেছে। সুতরাং এখন সে যা আয় করবে সব বোনাস।

মঞ্জুর ছিল অপেক্ষাকৃত স্মার্ট ছেলে। পড়াশোনা করেছে ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি হাই স্কুলে। আমি জানতাম, মঞ্জুর ঢাকায় জার্মান ভাষার কোর্স করছে।

মঞ্জুর জানালো, যদিও সে ছয় মাসের কোর্সটি করেছে, তবে এখানে এসে এদের উচ্চারণ তেমন কিছু বুঝতে পারে না। তাই সে এখন আবার ছয় মাসের একটি কোর্সে ভর্তি হয়েছে। তবে ঢাকা থেকে কিছু শিখে আসার কারণে ওকে দ্বিতীয় মাস থেকে সেই কোর্স করার অনুমতি দিয়েছে।

সন্ধ্যার পর মতি কাজ থেকে ফিরল। ঘরে ঢুকেই দেখতে পেল আমাদের তিনজনকে। মতির সাথে সবচেয়ে বেশি খাতির ছিল রশিদের। আর আমি মতিকে চিনতাম বন্ধুদের বন্ধু হিসেবে। মতি আর আমি তখন জগন্নাথ কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) সাথে জড়িত ছিলাম।

আমাদের দেখে মনে হলো না মতি খুশি হয়েছে। বরং মনে হলো, ও যেন তখন ভাবছিল- এ আবার কোন ঝামেলা!

মতি রশিদকে জিজ্ঞেস করলো, “কি আইছস নাকি?” আমাকেও জিজ্ঞেস করলো, “তুমিও আসছ?”  

তারপর মঞ্জুরকে গৃহকর্তার সুরে জিজ্ঞেস করলো,“কীরে, কী পাকাইছস?” বলেই পাতিলের ঢাকনা খুলে দেখল।

স্বাভাবিকভাবেই সারাদিন হাউস কিপিং-এর মত কঠিন কাজ করে এসে খিদে তো থাকবেই। একটু পরে রশিদ মতিকে বলল,“তুই তো কামাই করস,বিয়ার খাওয়া।”

মতি মুখটা করুণ করে বিরক্তির সুরে বলল,“দোস্ত, এটা খুব কষ্টের টাকা।”

তার মানে বুঝে নিলাম, রশিদের বিয়ার খাওয়ার শখ মিটে গেল।

ওখানে আর বেশি সময় কাটাই নাই,তাই উপরে চলে এলাম। রাতে আবার আগের মতই পাঁচজনের সোজা হয়ে পড়ে থাকা। তখন ভাবছিলাম, আগামী দিন কী করা যায়?

চলবে ...

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

ছবি কৃতজ্ঞতা: লেখক

এই লেখকের আরও পড়ুন-