জার্মানিতে ৪০ বছর: অর্থনৈতিক সঙ্কটের ইতি

প্রথম দিন পত্রিকা বিক্রি করার সুযোগ পাওয়ার পরের দু’দিন আর সেই সুযোগ পেলাম না। না পাওয়াটাই স্বাভাবিক ছিলো।

শাহ আলম শান্তি, জার্মানি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Jan 2018, 07:14 AM
Updated : 16 Jan 2018, 07:16 AM

আমরা যারা নতুন ছিলাম, তারা অপেক্ষামান গ্রুপের হকার। কোনো স্থায়ী বিক্রেতা কোনোদিন অনুপস্থিত থাকলে, তখন আমরা সেই সব জায়গা পূরণ করতাম।

দু’দিন পর আবার একদিন ইয়ানের ডাক পেলাম। আমাকে দেওয়া হলো আরেকটি জায়গায়। যতদূর মনে পড়ে, স্থানটি ছিলো হোটেল ফ্রাঙ্কফুর্টার হফের কাছাকাছি ‘ডব্লিউএমএফ’ নামে একটি দোকানের সামনে। দিনটি ছিল বুধবার। আর এই বুধবারে ‘রুন্ডশাও’ পত্রিকায় কিছু বিজ্ঞাপন থাকতো। তাই পত্রিকা বিক্রি সামান্য কিছু বেশি হতো।

আমার সেদিন ১৮টি পত্রিকা বিক্রি হলো। এই বিক্রিতেও আমি সন্তুষ্ট ছিলাম। সন্তুষ্ট না হওয়ার কারণ ছিল না। প্রথমত, বিক্রির তো সুযোগ পেলাম। তারপর আমার উপার্জনে আরও কয়েকটি মার্ক যোগ হলো। কিন্তু, পরেরদিন ছিল বৃহস্পতিবার, সেদিনও আবার বিক্রির কোনো সুযোগ পেলাম না।

এদিকে ভাষা স্কুলে নিয়মিত যাচ্ছি, আর শিখছি নতুন নতুন শব্দ ও বাক্য। আজ ৪০ বছর পর যখন স্মৃতিচারণ করি, তখন ভাবি ওই সময়টা একদিকে যেমন ছিলো পরিশ্রমের, অন্যদিকে ছিলো প্রতিদিন ভাষা ও নতুন কিছুর শেখার। এই পরিশ্রমের বিনিময়ে নতুন কিছু শেখার কী যে আনন্দ আর তৃপ্তি, সেটা আমি সেই সময় বুঝতে পেরেছি।

শুক্রবার ক্লাসের পর আবার চলে গেলাম পত্রিকার সেই অফিসে। আগেই অন্যদের কাছ থেকে শুনেছি যে শুক্রবারে যারা পত্রিকা বিক্রি করতে আগ্রহী, তাদের কাউকে নিরাশ হতে হয় না। কারণ ওইদিনের পত্রিকা কলবরে অনেক মোটা থাকতো। সেখানে বাড়ি ভাড়ার, গাড়ি ক্রয়-বিক্রয়, চাকরির, ফ্ল্যাট ক্রয়-বিক্রয় থেকে শুরু করে এমন কিছু জিনিস বা পণ্যের বিজ্ঞাপনের বাদ থাকতো না। তাই ওইদিনের পত্রিকার কাটতিও সোমবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পত্রিকা বিক্রির থেকে অনেক গুণ বেশি ছিলো।

তাছাড়া অন্যদিন যেখানে পত্রিকার দাম ৪০ পেনি থাকতো, সে জায়গায় শুক্র ও শনিবার মূল্য হত এক মার্ক। এখানে বলা প্রয়োজন যে শনিবার উইকএন্ডের পত্রিকা হিসেবে ভেতরে সব বিজ্ঞাপনের পাতা একই থাকতো। শুধু প্রথম ও শেষের পাতার পরিবর্তন আনা হতো। আর এই দু’দিন বিক্রেতারা ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরের বিভিন্ন সিগনালে গাড়ি লাল বাতির সময় থামার সাথে সাথে দুই সারি গাড়ির মাঝখান দিয়ে হেঁটে হেঁটে পত্রিকা বিক্রি করতেন।

আমার ওই প্রথম শুক্রবার ইয়ান আমাকে একটি অটো প্লাজ (প্লাজ মানে স্থান) দিলেন। মানে, গাড়ির সামনে পত্রিকা বিক্রির স্থান। এর আগে অবশ্য আমি অন্য জায়গায় আমার ক্লাসের সহপাঠী ভারতীয় সাইদের সাথে ‘বিল্ড’ পত্রিকা বিক্রি করেছিলাম। তাই ইতোমধ্যে আমার এই কাজে একদিনের অভিজ্ঞতাও ছিলো।

সেদিন আমাকে দেওয়া হলো ৮০টি পত্রিকা। মোটা হওয়ার কারণে সেগুলো ভারি ছিল । অফিসে দেখলাম, যারা আগে পত্রিকা পেয়েছে, তাদের কাছ থেকে অতি আগ্রহী অপেক্ষামান ক্রেতারা কিনছেন। বিজ্ঞাপনের কারণেই এই ক্রেতাদের যেন দ্রুত হাতে পত্রিকা আসে, তার একটা প্রতিযোগিতা ছিলো।

আমি আমার পত্রিকাগুলো নিয়ে ট্রলির ব্যাগে ঢুকিয়ে আমার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। পত্রিকার অফিস ‘জেইল’ থেকে আমার বিক্রির স্থান বেশ একটু দূরে ছিলো। তাই ট্রামে যেতে হতো। আমি ট্রামে করেই সেই জায়গায় পৌঁছালাম।

নেমে দেখলাম, আমাকে যে সিগনাল বাতির সামনে দাঁড়াতে বলা হয়েছে, সে রাস্তাটি হলো ফ্রেইডবার্গ থেকে যে গাড়িগুলো ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে প্রবেশ করছে, সেই রাস্তা। তার মানে, বিক্রির জন্য জায়গাটা খুব ভালো। কারণ, ওই পথে বাইরে থেকে আসা গাড়িগুলোর যাত্রীরা এই বিজ্ঞাপন সম্বলিত কাগজটি আমার হাতেই প্রথম দেখবেন।

আমি নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে পাতলা প্লাস্টিক দিয়ে মোড়া, শক্ত টেপ দিয়ে বাঁধা প্যাকেটগুলো থেকে একটির টেপ কেটে প্লাস্টিক ছাড়িয়ে গাড়ির দুই সারির মাঝখান দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। ক্রেতাদের হাত উঁচিয়ে কেনার বেশ আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। ক্রেতারা মার্ক হাতে রেখেই ইশারা দিচ্ছিলেন। আবার কেউ কেউ হালকা হর্ন দিয়ে ডাকতেন।

মাত্র কয়েকবার সিগনাল বাতি লাল হওয়ার মধ্যেই আমার ১৫টি পত্রিকা বিক্রি হয়ে গেল। এই বিক্রি করতে গিয়ে আমি ভাবছিলাম যে অন্য দিনগুলোতে যে জায়গায় তিন ঘণ্টায় ১৫টি পত্রিকা বিক্রি হয় না, সে জায়গায় আজ ১৫ মিনিটেই ১৫টা পত্রিকা বিক্রি হলো। দারুণ ব্যপার!

আমার বিক্রির আগ্রহ অনেক বেড়ে গেল। মনে হচ্ছিলো, এখানে ক্রেতা-বিক্রেতার ভূমিকার পরিবর্তন হয়েছে। আমি তখন ক্রেতাদের কাছে একজন আগ্রহের মানুষ। আড়াই ঘণ্টার মধ্যে আমার ৮০টি পত্রিকা বিক্রি হয়ে গেল। আমি আধা ঘণ্টার মধ্যে অফিসে চলে গেলাম।

বিক্রি থেকে পাওয়া মার্কের একটা নির্ধারিত অংশ এবং টিপসের মার্ক রেখে বাকিটা জমা দিলাম অফিসে। সেদিন খুব সম্ভবত সব মিলিয়ে আমার পকেটে এসেছিল ৩০ মার্কের মতো। পরের দিন শনিবারেও একই কায়দায় একই জায়গায়, তবে সকালে সকাল ৯টা থেকে ১টা পর্যন্ত বিক্রি করলাম। কিন্তু শুক্রবারের বিক্রির মতো তেমন সাড়া পেলাম না।

অফিস থেকেও সেদিন ৪০টি পত্রিকা দেওয়া হয়েছিলো। বিক্রি হয়েছিলো ৩০টির মতো পত্রিকা । যতদূর মনে পড়ে, শনিবার ছুটির দিন থাকার কারণে আমাদের শুক্রবারের তুলনায় কমিশন একটু বেশি দেওয়া হতো। তাই, সেদিন আয় হলো ২২ মার্কের মতো।

দুই দিনে ৫২ মার্ক উপার্জনের পর আমি তো দারুণ খুশি! আমি সাথে সাথে হিসেব করে ফেললাম যে মাসে চারটি উইকেন্ডে পত্রিকা বিক্রি করতে পারলে, অন্তত থাকা-খাওয়ার খরচ উঠে যাবে। আর বাকি দিনগুলো তো আছেই। তার মানে, আমি আমার অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে বের হয়ে আসার একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখতে পেলাম।

চলবে ...

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

এই লেখকের আরও পড়ুন-

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!