জার্মানিতে ৪০ বছর: বিদেশে প্রথম প্রেসের কাজ

কঠিন শীতের দুটো মাস জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি। ঠাণ্ডার বিরুদ্ধে পোশাকের তেমন কোনো সরঞ্জাম না ব্যবহার করেই অক্ষত অবস্থায় কাটিয়ে দিলাম জার্মানিতে।

শাহ আলম শান্তি, জার্মানি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 March 2018, 06:57 AM
Updated : 14 March 2018, 08:35 AM

এভাবে শীতের বিরুদ্ধে জয়লাভ করে আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল। ভাবলাম, আগামী শীতকালগুলোও এভাবে কাটাতে পারব। মার্চ বা অনেক সময় এপ্রিল মাস পর্যন্ত জার্মানিতে ঠাণ্ডা থাকে। তবে তখন দীর্ঘ শীতকালের ছোবলে ঠাণ্ডা অনেকটাই গা-সওয়া হয়ে যায়।

আর ওই সময়ের আরেকটা ইতিবাচক দিক হলো, ডিসেম্বর মাসের মতো সংক্ষিপ্ত দিনের অবসান হয়ে দিন একটু একটু বড় হতে থাকে। তাই আশার আলো দেখা যায় যে আর কিছুদিন পরই তো রোদের মুখ একটু বেশি বেশি দেখা যাবে।

এপ্রিল মাসে আমার ঢাকা থেকে আসা বন্ধুর তালিকায় যোগ হলো মনি। না, মনিকে এসে আমাদের মতো প্রাথমিক অবস্থায় অসহায় পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি। কারণ, ওর বড় ভাই শফিক তখন ফ্রাঙ্কফুর্টে। মনি ওর ভাইয়ের কাছেই থাকতো।

মনি আমার তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময়কার সেই বন্ধু। বিদেশে আসার সময় আমার বাসা থেকে মা তার হাতের বানানো কয়েকটি ভাপা পিঠে পাঠিয়েছিলো মনির হাতে। সেই পিঠা খেতে গিয়ে শুধু খাওয়াই না, অনেকদিন পর মনে হলো মায়ের হাতের স্পর্শ পাচ্ছি। সে যে কি এক অনুভূতি, সেটা ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নেই!

মনি আসার কয়েকদিন পর থেকে পত্রিকা বিক্রির অফিসে আসা-যাওয়া করতে লাগলো এবং পত্রিকা বিক্রির সুযোগও পেল। ভালো লাগতো যখন আমরা পত্রিকার জন্য অপেক্ষা করার সময় ওখানকার বেঞ্চে বসে গল্প করতাম। এক সময় আমরা বসেছি ঢাকা গভর্মেন্ট মুসলিম হাই স্কুলের ক্লাসের বেঞ্চে, আর এখন বসছি ইয়ানের পত্রিকা বিতরণের অফিসে। সময়ের সাথে অবস্থানের এই পার্থক্য!

ওই সময় মনি বাসা থেকে আমার জন্য আঙ্গুর বা অন্য কোনো ফল নিয়ে আসতো। সে সময় মনে হয় আমার মতো নতুন ছাত্ররা অনেকেই জার্মান মার্কের কথা চিন্তা করে ফল কিনে খেতে শুরু করেনি।

মনিরের ক্ষেত্রে আরেকটি সুবিধা ছিলো যে সে প্রথম থেকে ফল খেতে পারছিলো। কারণ, শফিক ভাই তখন একটি পাঁচ তারকা হোটেলে কাজ করতেন। আর সেখান থেকে সে কিছু কিছু ফল বাসায় নিয়ে আসতেন। আমি মনির কাছ থেকে শুধু ফলই পেতাম না, তার সাথে পেতাম ছোটবেলার বন্ধুত্বের স্পর্শ।

এদিকে পত্রিকা বিক্রির বিতরণের অফিসে কয়েক মাস হকারি করার পর মনে হয় একটু সিনিয়র হকারে উন্নীত হলাম। একদিন ওই অফিসের ইয়ান পত্রিকা বিতরণের সময় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হের আলম, আপনি কি প্রেসে কাজ করতে আগ্রহী?’ ( ‘হের’ মানে মিস্টার আলম)। ইয়ান সব সময় আমাদের ‘হের’ বলেই ডাকতেন।

আমি ভেতরে ভেতরে খুশি হলাম। তবে সে ভাব যথাসম্ভব চেপে শান্তভাবে বললাম, হ্যাঁ। তখন তিনি আমাকে একটি চিরকুট দিয়ে বললেন যে আগামীকাল সকালে আপনি সকাল ৮টায় প্রেসে চলে যাবেন।

নিউ আইসেনবার্গ হচ্ছে ফ্রাঙ্কফুর্ট শহর থেকে ১০ -১২ কিলোমিটার দূরে একটি শহর। সেদিন আমার সাথে ওই প্রেসে কাজের জন্য আরও তিনজনকে ইয়ান চিরকুট দিলেন। তাদের মধ্যে সবাই আগে ওই প্রেসে কাজ করেছে। তাই তাদের কাছ থেকে জেনে নিলাম যে ওই জায়গায় কীভাবে যেতে হয় এবং কোথায় আগামীকাল সকালে আমি তাদের দেখা পাব।

ওদের কথা মতো পরের দিন সকালে আমি তাদের সাথে ট্রাম স্টপেজে মিলিত হলাম। তারপর প্রায় ২০ মিনিটের মতো হেঁটে প্রেসে গিয়ে পৌঁছালাম। প্রেসটি শহরের বেশ নির্জন জায়গায় অবস্থিত, তাই সেখানে ঘন বসতি ছিল না।

প্রেসের ভেতরে ঢুকে দেখি বিশাল এক প্রেস। আর বিশাল বিশাল তার ছাপা ও প্যকেজিং-এর মেশিন । জীবনে এতো বড় প্রেসে কাজের সুবাদে এই প্রথম ঢোকা হলো।

প্রেসে ঢুকে এবার আমি আমার চিরকুটটি একজনকে দেখালাম। তিনি আমাকে দেখিয়ে দিলেন কার কাছে আমাকে যেতে হবে। আমি গেলাম ওখানকার ‘সেফ’ মানে ঊর্ধ্বতনের কাছে। আমি আমার চিরকুটটি দেখালাম। তখন ৮টা বাজতে কয়েক মিনিট বাকি।

জার্মানি হচ্ছে কঠোরভাবে সময় আর নিয়ম মেনে চলার দেশ। তাই এই দেশে এসে কয়েক মাসেই সেটা রপ্ত করতে হয়েছে। সেফ এবার আমাকে বিশাল এক মেশিনের এক অংশে নিয়ে গিয়ে দেখালেন, আমার পেছনে যে উঁচু করে রাখা একটি ম্যাগাজিনের একাংশ রাখা আছে, সেটা ওই মেশিনের একটি খোপে রাখতে হবে।

সেদিন যে মেশিনে আমরা কাজ করেছি, সেখানে আরও দুটি খোপ ছিলো। সেই দুটো খোপের সামনে আমার মতো আরও দু’জন ছিলেন। আমরা যে মেশিনে ছিলাম, তখন কাজ হচ্ছিলো একটি ম্যাগাজিনের ছাপানো বিভিন্ন অংশ এবং কভার একসাথে করে পুরনায় একটি ম্যাগাজিনে রূপান্তরিত করা।

এই ম্যাগাজিনটি শুক্রবারের মধ্যে শেষ করতে হতো। তাই, এরকম আরও কয়েকটির কাজও তখন এই প্রেসে হতো। এ কারণে এই বাড়তি কাজের জন্য ইয়ান সপ্তাহের শেষে আমাদের মতো কাজে আগ্রহীদের প্রেসে পাঠাতেন।

এই কাজের জন্য আমাদেরকে ঘণ্টায় পাঁচ মার্ক দেওয়া হতো। যদিও এই মার্ক তখনকার শ্রমের বাজার অনুযায়ী বেশ কম ছিলো, কিন্তু আমারা তৃপ্ত ছিলাম। কারণ, এই ১০ ঘণ্টা কাজের জন্য ওই ৫০ মার্ক আমাদের কাছে আকর্ষণীয় অর্থই ছিল।

সারাদিন কাজের পর যখন দুই-একদিনের মধ্যে এই টাকা হাতে আসতো, তখন কাজ করার কষ্ট ভুলে যেতাম। মনে হতো, এরকম পরিশ্রমের অর্থই আমাকে জার্মানিতে নিজের পায়ে দাঁড়াতে অনেক সাহায্য করবে।

চলবে ...

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

এই লেখকের আরও পড়ুন-

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!