জার্মানিতে ৪০ বছর: বিজ্ঞাপন বিলির দিনগুলো

আমার ভাষা কোর্স ও পত্রিকা বিক্রি ঠিকমতোই চলছিল। তবে শুক্র ও শনিবার বেশি পত্রিকা বিক্রি হতো বলে সপ্তাহের অন্য চারদিন পত্রিকা বিক্রি ছিল একেবারেই একঘেয়েমি।

শাহ আলম শান্তি, জার্মানি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Feb 2018, 06:09 AM
Updated : 15 Feb 2018, 06:09 AM

তবে শুক্র ও শনিবারের জায়গাটি ধরে রাখার জন্য পত্রিকা বিক্রিতে নামতে হতো। আমি অবশ্য এই একঘেয়েমি কাটানোর জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভাষার বই পড়তাম। ওইদিনের যা পড়ানো হয়েছে, সেগুলো আবার দেখে নিতাম। আর পরের ক্লাসের পড়াটাও বোঝার চেষ্টা করতাম।

প্রতিদিন পত্রিকার শিরোনাম ও অন্যান্য সংবাদের দিকে চোখ বুলাতাম, যদি কিছু বুঝতে পারি। পত্রিকায় খুঁজতাম সেইসব শব্দ, যার সাথে ইংরেজি শব্দের মিল আছে। শব্দের অর্থ খোঁজার জন্য আমার সাথী ছিল জার্মান ইংরেজি অভিধান, তাই কোনো খবর গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে তার শব্দ ও বাক্য বোঝার জন্য অভিধানের পাতা উল্টাতাম।

আমার এই পরিশ্রমের জন্য আমি ক্লাসে দ্বিতীয় ভালো ছাত্র হয়ে উঠেছিলাম। আমার চেয়ে ভালো পারতো গ্রিসের মেয়ে এলিজাবেথ। ও মনে হয় আগে আরেকটি কোর্স করে এসেছিল। আর ওর ইচ্ছে ছিল ভাষা শিখে আমার মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়ন করার।

ক্লাসে যদি গাবি বা ডরিস কাউকে জিজ্ঞেস করতো, তখন ওরা আমাদের দু’জনের দিকে ইঙ্গিত করে বলতো- ওদের জিজ্ঞেস করো, আমারা তো আর ভাষা শিখে পড়াশোনা করবো না। আমরা এখানে এসেছি জার্মান ভাষায় যেনো একটু কথা বলতে পারি।

অন্যদিকে আমাদের সাথে আসা সহযাত্রী ও বন্ধু সেলিম ভাষা শেখার একটি ছয় মাসের স্টাইপেন্ড পেয়ে গেল। কারণ, তখন যারা রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করতো এবং ভাষা শিখতে উৎসাহী ছিল, তাদেরকে হল্যান্ডের সীমানার কাছাকাছি একটি বোর্ডিং স্কুলে পাঠানো হতো। সেটা ছিল উন্নতমানের একটি স্কুল এবং থাকা-খাওয়া সম্পূর্ণ বিনামূল্যে।

সেলিমের ইচ্ছে ছিল পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার করার। তাই সে এই সুযোগ হাতছাড়া করলো না। সে  ছয় মাসের জন্য চলে গেল সেই স্কুলে। যদিও সে মাঝে মাঝে আমাদের বাসায় বেড়াতে আসতো। ওর চলে যাওয়ার আমরা একসাথে আসা চারজনের মধ্যে রশিদ আর আমি দু’জন হয়ে গেলাম। কারণ, নিলু তো এসে এক মাস পরেই দেশে চলে গেছে।

বাজার অর্থনীতির চূড়ান্ত বিকাশের দেশ জার্মানিতে আমাদের মধ্যে পত্রিকা বিতরণকারী ইয়ান শধু পত্রিকা হকারদের মধ্যে পত্রিকা বিতরণ করে আয় করতো না, এর সাথে সে আমাদের মতো শ্রমশক্তিকে অন্য কাজে লাগিয়ে উপার্জনও করতো। তাই সে মাঝে মাঝে শহরের বাড়িতে বাড়িতে বিজ্ঞাপন বিলি করার কাজও নিয়ে আসতো। দেখা যেত, হয়তো সে ৫০ হাজার প্রচারপত্র বিলি করার কাজ পেল, তখন আমরা যারা পত্রিকা বিক্রি করি, তাদের সবাইকে জিজ্ঞেস করতো যে আমরা সেই কাজ করতে রাজী আছি কিনা। আমরা প্রায় সবাই তখন সেই কাজ লুফে নিতাম।

এই কাজে বাসায় বাসায় চিঠির বাক্সে বিজ্ঞাপনগুলো দিতে হতো। বিতরণকারী প্রত্যেককে ম্যাপ এঁকে দেওয়া হতো যে শহরের কোন এলাকায় তাকে এই লিফলেট বিতরণ করতে হবে। আর সাথে দেওয়া হতো সেই অনুপাতে প্রচারপত্র।

আমিও একদিন সেই কাজ পেলাম। সেদিন আমাকে ৪ হাজার লিফলেট দেওয়া হয়েছিল। আমি বিজ্ঞাপনগুলো নিয়ে তাদের নির্দেশিত জায়গায় চলে গেলাম। তারপর শুরু করলাম বাসায় বাসায় সেগুলো চিঠির বাক্সে রাখা। ওই সময় বহুতল বাড়ি দেখলে মনটা খুশি হয়ে যেত। ভাবতাম, এবার দেওয়ার মত একসাথে অনেক চিঠির বাক্স পাওয়া যাবে বলে। আবার একটা লেটার বক্সের বাড়ি দেখলে মন খারাপ হয়ে যেত।

প্রচুর হাঁটতে হয়েছে এই কাজ করতে। কিন্তু ৫-৬ ঘণ্টা বিলানোর পর অফিসে এসে যখন হাতে ৫০ মার্ক পেতাম, তখন সব পরিশ্রমের কষ্ট লাঘব হয়ে যেত। হিসেব করতাম, যদি এ ধরনের কাজ মাসে চার বার করতে পারি তাহলে আমার থাকা-খাওয়ার মার্ক উঠে আসবে।

আমার মধ্যে তখন বড় চিন্তা ছিল, পড়াশোনার জন্য উপার্জন করতে হবে। স্বাবলম্বী হতে হবে। কারো কাছে যেন আর হাত পাততে না হয়।

চলবে ...

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

এই লেখকের আরও পড়ুন-

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!