গাইবান্ধার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই মাদারগঞ্জ প্রতিরোধ যুদ্ধ একটি অন্যতম অধ্যায়।
Published : 25 Mar 2024, 09:50 AM
ট্যাংক আর পাঁচ-ছয়টি মেশিনগানে সমৃদ্ধ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বহরের বিপরীতে গাইবান্ধার মাদারগঞ্জের প্রতিরোধ যুদ্ধে বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ছিল নেহাতই মামুলি। তারপরেও এই ‘অসম যুদ্ধে অসীম সাহসী’ মুক্তিবাহিনীর হাতে প্রাণ দিতে হয়েছিল ২১ হানাদার বাহিনীকে। শুধু ‘কৌশলের কারণেই’ সেদিন ট্যাংক নিয়ে পালিয়ে বেঁচেছিল পাকিস্তানিরা।
অবশ্য ১৭ এপ্রিলের মাদারগঞ্জের এই প্রতিরোধ যুদ্ধের পরই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অধিক শক্তি নিয়ে গাইবান্ধায় প্রবেশ করে। আর নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে ৭ ডিসেম্বর গাইবান্ধা মুক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত চালায় গণহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও নারী নির্যাতন।
গাইবান্ধার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই মাদারগঞ্জ প্রতিরোধ যুদ্ধ একটি অন্যতম অধ্যায়। এটি এখনো মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় মানুষদের স্মৃতিতে জাগরুক।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, রংপুর ও বগুড়াসহ দেশের কোনো ক্যান্টনমেন্ট থেকে যাতে পাকিস্তানি সেনারা গাইবান্ধায় আসতে না পারে সেজন্য আগে থেকেই গাইবান্ধায় অল্প কয়েকদিনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের আংরার ব্রিজে অবস্থান নেন।
১৫ এপ্রিল রাতে হানাদার বাহিনী আংরার ব্রিজে পাহারারত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর হামলা চালায়। দীর্ঘ সময়ের তুমুল লড়াইয়ের পর আংরার ব্রিজের যুদ্ধে হানাদাররা পিছু হটে যায়।
এর পরদিন ১৬ এপ্রিল গাইবান্ধায় খবর আসে হানাদার বাহিনীর একটি বহর রংপুর থেকে বড়দরগা-মাদারগঞ্জ ও সাদুল্লাপুর হয়ে গাইবান্ধা অভিমুখে এগিয়ে আসছে।
এ খবর পেয়ে সুবেদার আলতাফের নেতৃত্বে একদল বীর মুক্তিযোদ্ধা রওয়ানা দেন রংপুরের পীরগঞ্জ থানার মাদারগঞ্জ অভিমুখে।
ওই প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আনোয়ারুল কাদির ফুল মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “১৬ এপ্রিল সকালে পলাশবাড়ী থেকে ডিফেন্স তুলে নিয়ে আলতাফ সুবেদার গাইবান্ধায় চলে আসেন। সেই দিন বিকালে আমরা সবাই চার থেকে পাঁচটা ট্রাক ও জিপ নিয়ে মাদারগঞ্জ চলে যাই। আমরা মাদারগঞ্জ হাটের পশ্চিমে (গাইবান্ধা-রংপুর সীমান্তবর্তী) নলেয়া নদীর ভাঙ্গা ব্রিজটির পশ্চিম-দক্ষিণ পাশে সাদুল্লাপুর থানার মীরপুরের একটা লম্বা বাঁশ ঝাড়ের ভেতরে বাংকার করে পজিশন নেই।
“এই বাংকার করার সময় ওই এলাকার গ্রামবাসীরা আমাদের অনেক সহযোগিতা করেন। শুধু তাই নয়, তীর-ধনুক লাঠিসোঁটা নিয়ে এসে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল স্থানীয় লোকজন।”
সুবেদার আলতাফের বুদ্ধির জোরে সেদিন মাদারগঞ্জ থেকে বেঁচে আসতে পেরেছিলেন উল্লেখ করে আনোয়ারুল কাদির বলেন, “১৭ এপ্রিল খুব ভোরেই পাকিস্তানি সৈন্যরা ট্যাংকসহ মাদারগঞ্জে হাজির। ওই ভোর রাতেই তারা পাঁচ থেকে ছয়টি মেশিনগান সংযোজিত গাড়ি থেকে নেমে ওই নলেয়া নদীর ব্রিজের পূর্ব পাশের মাদারগঞ্জে অবস্থান নেয়। গাড়িগুলো একটু সরে গেলেই তারা মেশিনগানের গুলি ছুড়তে থাকে।
তিনি বলেন, “যেহেতু আমরা আগে থেকেই পজিশন নিয়েছিলাম; পাকিস্তানি সেনারা আসার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় অসম শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ। একটা ব্যাংকার থেকে আমাদের একমাত্র হেভি মেশিনগানের গুলি ছোড়া শুরু হয়। আর বিভিন্ন পজিশনে থেকে তিন থেকে চারটা এলএমজির গুলি চলছে। যাতে পাকিস্তানি সেনারা মনে করে, আমাদের কাছে অনেকগুলো এলএমজি আছে। আর আমরা ২৫-৩০ জন আনাড়ি মুক্তিযোদ্ধারা থ্রি-নট-থ্রি দিয়ে সমানতালে গুলি ছুড়ছি। ভয়ে আমার হাত-পা কাঁপছে।”
ফুল মিয়া বলেন, “অনেকক্ষণ গুলি চালানোর পর আমাদের গুলি ফুরিয়ে গেল। ওরা ট্যাংক নিয়ে এসেছে। এখন আমরা নির্ঘাত মারা যাব। আলতাফ সুবেদারের মাথাতে এই চিন্তাটা ছিল। কিন্তু আমরা ভাগবো কীভাবে? এতক্ষণ যে যুদ্ধ চলছে। সুবেদার আলতাফ একটিবারের জন্য রকেট লাঞ্চার থেকে গুলি ছোড়েন নাই। তিনি সবার কাছে মেসেজ পাঠালেন এই বলে যে, ট্রাক স্টার্ট হওয়ার পর পরই পজিশন ছেড়ে সবাই দৌড়ে ট্রাকে গিয়ে উঠবে।
“একটু পরে তিনি ট্রাকগুলোকে খুব শব্দ করে স্টার্ট দিতে নির্দেশ দিলেন। ট্রাকগুলো যেন গর্জে উঠল। তখনই তিনি হুকুম দিলেন, মারো রকেট লাঞ্চার। মজিদ ওস্তাদ গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজ করে চারটে রকেট লাঞ্চার মারলেন। ওই শব্দ শুনে আমরা সবাই দৌড়ে গিয়ে ট্রাকে উঠে পড়লাম। ট্রাকগুলো পড়িমরি করে দে ছুট গাইবান্ধার দিকে।”
তিনি বলেন, “আর ওদিকে বেকুব হানাদার বাহিনী ট্রাকের আর রকেট লাঞ্চারের হামলার শব্দ শুনে মনে করল হেভি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমাদের সঙ্গে আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধা এসে যোগ দিয়েছে। তাই ওরা প্রাণ ভয়ে ট্যাংকের মুখ ঘুরিয়ে পিছন দিকে দে ছুট। মুহূর্তের মধ্যে মাদারগঞ্জ ফাঁকা।”
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবির পীরগঞ্জ উপজেলা সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক স্থানীয় গবেষক অধ্যাপক কামরুজ্জামান বলেন, “পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা যাওয়ার সময় মাদারগঞ্জ হাটের হিন্দুদের একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ৫০টি বাড়ি গান পাউডার দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এ ছাড়া হানাদাররা দুজন সাধারণ মানুষকে গুলি হত্যা করে। তারা হলেন- মাদারগঞ্জ হাটের ক্ষিতীশ চন্দ্র সাহা ও হাকিম উদ্দিন শেখ।”
প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেওয়া আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কাদের বলেন, “এই যুদ্ধে ২১ জন হানাদার নিহত এবং নুরুল আমিন নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।”
তিনি বলেন, “পরে ওই দিন (১৭ এপ্রিল) বিকালেই ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক ধরে পলাশবাড়ী হয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ভারী ও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রসহ নিয়ে গাইবান্ধায় প্রবেশ করে। শহরে ঢুকেই হানাদাররা গাইবান্ধা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মাদারগঞ্জ প্রতিরোধ যুদ্ধে আহত বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল আমিনকে হত্যা করে।”
‘আমার উপলব্ধিতে মুক্তিযুদ্ধে গাইবান্ধা’ বইয়ের বরাত দিয়ে গাইবান্ধার তৎকালীন মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ আজিজুল হক বলেন, ওই দিন একজন ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে হানাদার বাহিনীর একটি ট্যাংক বাহিনীর ইউনিট গাইবান্ধায় আসে। তারা গাইবান্ধা শহরে স্টেডিয়ামে (বর্তমান শাহ আব্দুল হামিদ স্টেডিয়াম) ঘাঁটি করে। আর কিছু দূরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের রেস্ট হাউজে অফিসারদের থাকার ব্যবস্থা করে।
“এসে প্রথম দিন বিকালেই পাকিস্তানি সেনারা বেশ কয়েকজন যুবককে ধরে আনে। পরে স্টেডিয়ামের পাশে রেল লাইনের ধারে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এ সময় পানি পান করতে চাইলে মুমূর্ষু এই হতভাগ্যদের মুখে হানাদাররা প্রস্রাব করে দেয়। গোটা গাইবান্ধা শহর আসে হানাদারদের আয়ত্তে।”
তিনি বলেন, এরপর থেকে গাইবান্ধায় শুরু হয় হানাদার বাহিনীর নির্বিচারে গণহত্যা, নারী নির্যাতন, লুটপাট এবং গ্রাম-গঞ্জে অগ্নি-সংযোগের মতো নারকীয় যজ্ঞ।
এ অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধারা গাইবান্ধা শহর ত্যাগ করে যমুনা-ব্রহ্মপুত্রের চরে নিরাপদ স্থানে চলে যান। সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে দেশের মুক্তির জন্য পুনরায় প্রস্তুতি নিতে ভারতের মানকার চর ও তুরায় প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করে মুক্তিসেনারা।
প্রস্তুতি-পর্ব
সারা দেশের মতো একাত্তরের মার্চে গাইবান্ধা উত্তপ্ত হতে থাকে। ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের পর গাইবান্ধায় মুক্তিকামীরা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে।
১৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের সদস্য লুৎফর রহমানকে আহ্বায়ক করে ১৭ সদস্যবিশিষ্ট গাইবান্ধা মহকুমা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়।
এরপর ২৩ মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে শাসকগোষ্ঠী সর্বত্র পাকিস্তানি পতাকা উড়ানোর নির্দেশ দিলে তা প্রতিরোধের ডাক দেয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ।
ওই দিন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে গাইবান্ধার পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে তৎকালীন মহকুমা ছাত্রলীগের সভাপতি এম এন নবী লালু পাকিস্তানি পতাকার পরিবর্তে ওড়ান স্বাধীন বাংলার পতাকা।
এদিকে ২৭ মার্চ গাইবান্ধায় ছুটিতে আসা এবং অবসরপ্রাপ্ত সেনা, নৌ, বিমান, ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) এবং আনসার বাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে মুক্তিবাহিনী গঠন করা হয়।
তখনকার ইপিআরের সুবেদার আলতাফ ওই মুক্তি বাহিনীরি নেতৃত্ব দেন। সেইদিন থেকে গাইবান্ধা কলেজ মাঠ, ইসলামিয়া হাইস্কুল মাঠ ও আনসার ক্যাম্পে ছাত্র, যুবক ও জনতাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়।
প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন নৌবাহিনী হতে দলত্যাগী জওয়ান কাজিউল ইসলাম ও ওয়াহেদুন্নবী মিন্টু, সেনাবাহিনীর মকবুল হোসেন বাদল, ওয়াহিদুল্লাহ আজাদ, মাহবুব আলী ও এনামুল হক টুকু, আনসার কমান্ডার আজিম উদ্দিন ও মমতাজুল ইসলাম।
অল্প কয়েকদিনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই মুক্তিযোদ্ধারা নানা কৌশলে প্রতিরোধ গড়ে তুলে ২৬ মার্চ থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত গাইবান্ধাকে হানাদার মুক্ত রাখেন। এই সব প্রতিরোধ যুদ্ধের মধ্যে ১৭ এপ্রিলের মাদারগঞ্জ প্রতিরোধ যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য।
গাইবান্ধার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক অধ্যাপক জহুরুল কাইয়ুম জানান, গাইবান্ধা মহকুমা সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয় তৎকালীন মহকুমা সদরের প্রাদেশিক সদস্য ওয়ালিউর রহমান রেজা এবং মহকুমা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আতাউর রহমানকে।
এ ছাড়া আবু তালেব মিয়া (সাবেক সংসদ সদস্য), হাসান ইমাম টুলু, হিরুসহ আরও বেশ কয়েকজন নেতা ও কর্মী মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন।
গাইবান্ধায় অন্যান্য যুদ্ধ
গাইবান্ধা ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত ‘গাইবান্ধার ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মো. মাহবুবর রহমানের ‘একাত্তরে গাইবান্ধা’ বই থেকে জানা যায়, গাইবান্ধায় কেবলমাত্র সাদুল্লাপুর, পলাশবাড়ী ও গোবিন্দগঞ্জের সামান্য পশ্চিম ও উত্তর পশ্চিমাঞ্চল ছিল ৬ নম্বর সেক্টরভুক্ত।
এ ছাড়া গাইবান্ধার বাকি এলাকা ১১ নম্বর সেক্টরভুক্ত হয়। গাইবান্ধার মুক্তিযোদ্ধারাও যুদ্ধ করেন ১১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডভুক্ত থেকে। মানকার চর সাব-সেক্টরের সর্বপ্রথম কমান্ডার মো. শফিউল্লা সেপ্টেম্বরে গাইবান্ধা মহকুমার জন্য মোট ছয়টি কোম্পানি গঠন করেন।
১. রোস্তম আলী খন্দকার কোম্পানি ২. মাহবুব এলাহী রঞ্জু কোম্পানি ৩. এমএন নবী লালু কোম্পানি ৪. আমিনুল ইসলাম কোম্পানি ৫. খায়রুল আলম কোম্পানি ৬. সাইফুল ইসলাম সাজা কোম্পানি।
এ ছাড়া গাইবান্ধায় ৬ নম্বর সেক্টরভুক্ত দুটি কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন- মফিজুর রহমান খোকা কোম্পানি এবং শাহাজাহান আলী টুকু কোম্পানি।
গলনার চরে ঘাঁটি করে রোস্তম আলী খন্দকার কোম্পানির সাতটি প্লাটুন ফুলছড়ি ও সাঘাটা থানা এলাকায় যুদ্ধ করেছেন।
গাইবান্ধা সদরের মোল্লার চরে ঘাঁটি করে মাহবুব এলাহী রঞ্জু কোম্পানির চারটি প্লাটুন গাইবান্ধা সদর ও ফুলছড়ি থানা এলাকায় যুদ্ধ করেছেন।
কাচির চর ও জিংগামারীর চরে ঘটি করে এম এন নবী লালু কোম্পানি পলাশবাড়ী থানা এলাকায় যুদ্ধ করেন।
মোল্লার চরে ঘাটি করে আমিনুল ইসলাম কোম্পানি উলিপুর, চিলমারী ও সাদুল্লাপুর থানা এলাকায় যুদ্ধ করেন।
এ ছাড়া ৬ নম্বর সেক্টরের মফিজুর রহমান খোকা কোম্পানির চারটি প্লাটুন পলাশবাড়ী ও ফুলছড়ি থানার কিছু এলাকায় এবং শাহাজাহান আলী টুকু কোম্পানির চারটি প্লাটুন সাদুল্লাপুর ও সুন্দরগঞ্জ থানার কিছু এলাকায় গেরিলা যুদ্ধ করেন।
গাইবান্ধায় সংঘটিত যুদ্ধগুলোর মধ্যে সন্ন্যাসদহ রেল ব্রিজের যুদ্ধ, ভাঙ্গামোড় অ্যাম্বুশ, কাঁকড়া গাড়ি ব্রিজের যুদ্ধ, ত্রিমোহনীর যুদ্ধ, তিস্তামুখ ঘাটে জাহাজ আক্রমণ, সিংড়া রেল ব্রিজ অপারেশন, ফুলছড়ি ও সাঘাটা থানা রেইড, ফুলছড়ির যুদ্ধ, ফুলছড়ির উড়িয়ার চরের যুদ্ধ, বাদিয়া খালির সড়ক সেতু এলাকার যুদ্ধ, হরিপুর অপারেশন, কোদালকাটির যুদ্ধ, রসুলপুর স্লুইস গেট আক্রমণ এবং নান্দিনার যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য।
গাইবান্ধা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডার নাজমুল আরেফিন তারেক বলেন, গাইবান্ধায় ১৭ এপ্রিল থেকে শুরু পাকিস্তানি সেনাদের নির্বিচারে গণহত্যা, নারী নির্যাতন, লুটপাট এবং গ্রামগঞ্জে অগ্নিসংযোগের মতো নারকীয় যজ্ঞ বন্ধ হয় ৭ ডিসেম্বর। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের এ দিনটিতেই গাইবান্ধার মানুষ পায় মুক্তির স্বাদ।
তিনি বলেন, গাইবান্ধার পূর্ব পাশ দিয়ে প্রবাহিত যমুনা-ব্রহ্মপুত্রের চরে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা ডিসেম্বরের শুরু থেকেই গাইবান্ধা শহরের দিকে এগোতে থাকে। তারা পূর্ব ও দক্ষিণ পাশে শহরের কাছাকাছি এসে পড়ে। একে একে সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা ও ফুলছড়ি থানা মুক্ত করে মুক্তিযোদ্ধারা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে গাইবান্ধা শহর।
৬ ডিসেম্বর সকালে ভারতীয় বিমান বাহিনীর দুটি বিমান গাইবান্ধা রেলওয়ে স্টেশনের পাশে বোমা ফেলে। ওইদিন বিকালে গাইবান্ধার স্টেডিয়াম ও ওয়ারলেসের অবস্থান থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত পাকিস্তানি সেনারা তাদের দোসর রাজাকার ও আল-বদরদের ফেলে বগুড়ার দিকে পালিয়ে যায়।
পর দিন ৭ ডিসেম্বর ভোরে কোম্পানি কমান্ডার মাহবুব এলাহি রঞ্জুর নেতৃত্বে দেড় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা তৎকালীন গাইবান্ধা মহকুমা শহরে প্রবেশ করে। তাদের দেখে হাজার হাজার মানুষ বিজয় উল্লাসে ফেটে পড়ে বলে জানান তিনি।
আরেফিন তারেক বলেন, ওই দিনই তৎকালীন এসডিও মাঠে (বর্তমান স্বাধীনতা প্রাঙ্গণ) দশ সহস্রাধিক মানুষ সংবর্ধনা জানায় বিজয়ী বীর সেনানীদের।
আরও পড়ুন:
হাজং কিশোর ধীরেন্দ্র মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণে যান পরিবারকে না জানিয়ে
‘কবরস্থানে সারারাত লাশের সঙ্গে অস্ত্র নিয়ে শুয়ে ছিলাম; ভয় লাগেনি’