আবেদন যাচাই-বাচাই করে স্বীকৃতির পাশাপাশি স্বীকৃতিপ্রাপ্ত গৃহহীন ও দরিদ্র ‘বীরকন্যাদের’ পর্যায়ক্রমে ‘বীর নিবাস’ নির্মাণের ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান জেলা প্রশাসক।
Published : 18 Mar 2024, 09:05 AM
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর পরই নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার আতাইকুলা গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনী সব ঘর থেকে হিন্দুদের ধরে ধরে এনে একলাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে।
এ সময় গ্রামের নারীদেরকেও ধরে এনে জড়ো করা হয়েছিল একটি ঘরে। স্বামী-সন্তান-স্বজনদের তাদের চোখের সামনেই গুলি করে হত্যা করা হয়। এই দৃশ্য দেখে নারীরা যখন শোকে কাতর, মূর্ছা যাচ্ছিলেন- তখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের এক এক করে উঠিয়ে নিয়ে ধর্ষণ-নির্যাতন চালায়।
গ্রামবাসী জানায়, একাত্তরের ২৫ এপ্রিল গ্রামটি ঘেরাও করে মোট ৫২ জন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। এর আগে দিনভর লুটপাট, অগ্নিসংযোগ চালায় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা।
এ ঘটনার দীর্ঘ সময় পর গ্রামটির ১০ জন নারীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালে তাদের বীরকন্যা (মুক্তিযোদ্ধা) হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করে সরকার। আর ২৬ জন আবেদন করেছেন। এর বাইরে অনেক নির্যাতিত নারীই এখনও স্বীকৃতির বাইরে রয়েছেন।
নির্যাতিত নারীরা পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের মত তাদের জন্যও ‘বীর নিবাস’ নিমার্ণ করে দেওয়া দাবি করেছেন।
একইসঙ্গে তারা সরকারের কাছে সেদিন আতাইকুলার ঘটনায় নিহত ৫২ জনের গণকবরে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ ও নিহতদের শহীদের মর্যাদা দেওয়ার দাবিও জানান।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, নির্যাতিত নারী ও গ্রামবাসী জানান, আতাইকুলা গ্রামটি হিন্দু অধ্যুষিত। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর পরই এই গ্রামের আশপাশের রাজাকাররা শক্তিশালী হয়ে উঠে। তারাই মূলত এই গ্রামটির কথা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে জানায়।
রানীনগর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. ইসমাইল হোসেন ও আতাইকুলা গ্রামের বাসিন্দা প্রদ্যুত কুমার পালের বয়ানে জানা যায়, ২৬ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী গ্রামটি ঘেরাও করে ফেলে। তারা গ্রামে ঢুকে প্রথমে সবাইকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ফেলে।
প্রতিটি ঘরে ঘরে গিয়ে তারা টাকা-সোনাসহ যত মালামাল আছে দিয়ে দিতে বলে। টাকা-সোনা দিলে কাউকে হত্যা করা হবে না বলে আশ্বাস দেয় পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা। তাদের কথামতো সবাই, সবকিছু দিয়ে দেয়।
দুপুরের দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গ্রামের সব নারী-পুরুষকে ধরে প্রদ্যুত কুমার পালের বাড়ির সামনে জড়ো করে। তারপর পুরুষদের একদিকে দাঁড় করানো হয় আর নারীদের একটি ঘরে নিয়ে আটকে রাখা হয়।
পুরুষরা যারা লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন তাদের মধ্যে মুসলিমদের আলাদা হয়ে যেতে বলা হয়। কিন্তু সেখানে কোনো মুসলমান ছিল না। তখন হিন্দুদের বলা হয়, মন্ত্র পাঠ করতে, ঈশ্বরের নাম নিতে। তারপরই ব্রাশফায়ার চালানো হয়।
সেদিন যাদের ধরে আনা হয়েছিল তাদের মধ্যে ওই গ্রামের বাসিন্দা প্রদ্যুত কুমার পালও ছিলেন। সেদিন বাবা-কাকা-ভাইকে হারিয়েছেন তিনি। কিন্তু এই গণহত্যা থেকে যে দুজন পুরুষ ভাগ্যক্রমে বেঁচে ফিরেছিলেন তাদের মধ্যে প্রদ্যুৎ একজন।
প্রত্যক্ষদর্শী প্রদ্যুত কুমার পাল বলছিলেন, “ওইদিন চোখের সামনে আমাদের বাড়ির আঙিনায় প্রথমে বাবা-কাকাকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদাররা।
“এরপর টাকা, সোনার গহনাসহ অন্যান্য মালামাল লুটপাট শেষে তারা গ্রামবাসীকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। একই জায়গায় ধরে আনা অর্ধশতাধিক গ্রামবাসীকে সারিবদ্ধভাবে পশ্চিমমুখ হয়ে বসতে ও আল্লাহকে স্মরণ করতে বলে।
“ধরে আনা গ্রামবাসীর মধ্যে আমার দুই ভাইসহ আমরা তিনজনও ছিলাম। হানাদাররা ব্রাশফায়ার শুরু করলে আমি নিচু হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ি। তখন আমার শরীরের ওপর একটার পর একটা মরদেহ পড়ে, আমি লাশের নিচে ঢাকা পড়ে যাই। এতে ভাগ্যক্রমে অক্ষত অবস্থায় বেঁচে যাই।”
তার দাবি, “ওইদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত পাকিস্তানি হানাদাররা গ্রামটি ঘেরাও করে অন্তত ৫২ জনকে গুলি করে শুধু হত্যাই করেনি, টাকা, স্বর্ণালংকার লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ অর্ধশতাধিক নারীর ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়।”
প্রদ্যুত বলেন, “গণহত্যা শেষ করে ওরা ঘরে আটকে রাখা নারীদের দিকে যায়। তারপর সেখান থেকে নারীদের একে একে বের করে বিভিন্ন বাড়িতে নিয়ে নির্যাতন চালায়।
“বিকাল ৪টার দিকে ওরা গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। তখন দেখা যায়, আমার মতো লাশের নিচে পড়ে বেঁচে গেছেন হরিদাশ পালও। আর ৫২ জনকে ওরা হত্যা করে।
“চারদিকে রক্ত আর লাশ। জীবনে কোনোদিন তো এমন দেখিনি। আমরা তখন শোকে বিহ্বল। তার মধ্যেই পাশের গ্রাম থেকে লোকজনকে খোঁজে বের করে আনি। সবাই মিলে একটা বড় গর্ত করে সেখানে ৫২ জনকে একসঙ্গে গণকবর দেওয়া হয়।”
আতাইকুলা গ্রামে যারা শহীদ হয়েছিলেন তারা হলেন- যোগেন্দ্র নাথ পাল, শতীশ চন্দ্র পাল, সুরেশ্বর পাল, লঙ্কেশ্বর পাল, বলরাম পাল, শ্রী দাম পাল, গোবিন্দ চন্দ্র পাল, সুশান্ত কুমার পাল মন্টু, প্রশান্ত কুমার পাল ঝন্টু, বিদ্যুৎ কুমার পাল, সুধীর চন্দ্র পাল, বীরেন্দ্রনাথ পাল, উত্তম কুমার পাল (মঙ্গলা), শঙ্কর পাল দীপু, প্রফুল্ল পাল, ডা. প্রমথনাথ পাল, বীরেন্দ্রনাথ পাল (২), নারায়ণ চন্দ্র পাল, প্রেমচরণ পাল, রাজেন্দ্র নাথ পাল, শচীন্দ্র নাথ পাল, রসিক চরণ পাল, ষষ্ঠী চরণ পাল, মাখন চন্দ্র পাল, সুধীর চন্দ্র পাল, সুনীল চন্দ্র পাল, জগন্নাথ পাল, বাদল পাল, ভাদু পাল, সুধীর চন্দ্র পাল (গ্যা:) (৩), নিবারণ চন্দ্র পাল, তাল পাল, নারায়ণ চন্দ্র পাল (২) (রা:), বিষ্ণু পাল, দামু পাল (রাণী), নরেন্দ্র নাথ পাল, নিখিল চন্দ্র পাল (রাণী), সিদ্বেশ্বর সূত্রধর, শর্মেস্বর সূত্রধর, রাম চন্দ্র সূত্রধর, চৈতন্য সূত্রধর, সুকমল চন্দ্র সাহা, হরেন্দ্রনাথ সরকার, মঙ্গলা সরকার, শচীন্দ্রনাথ সরকার, ফিরিঙ্গি মাঝি (খেয়া), (ফিরিঙ্গির বাবা (খেয়া ঐ), সুধীর সরকার (৪), রশিক চন্দ্র হালদার, বীরেশ্বর হালদার।
রানীনগর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, “পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে রাজাকাররা খবর দিয়ে কোথায় থেকে নিয়ে এসেছিল সেটা আমরা জানি না। তবে আতাইকুলা গ্রামে গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট চলানোর পর তারা সান্তাহার রেলওয়ে স্টেশনের দিকে চলে যায়।”
সম্প্রতি আতাইকুলা গ্রামে গেলে অনেক নির্যাতিত নারীর সঙ্গে কথা হয়। অনেকেই বয়সের ভারে ন্যুজ্ব, চলাফেরা করতে পারেন না। অনেকে মারা গিয়েছেন। যারা বেঁচে আছেন তারা অভাব-অনটনের মধ্যে জীবন-যাপন করছেন।
নির্যাতিত নারীরা তাদের জন্য পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের মতো ‘বীর নিবাস’ নির্মাণ করে দেওয়ার পাশাপাশি নিহত ৫২ জনের গণকবরে স্মৃতিস্তম্ভ ও নিহতদের শহীদের মর্যাদাদানের দাবি জানিয়েছেন।
জেলায় গেজেটভুক্ত নারী মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১৭ জানিয়ে প্রদ্যুত কুমার পাল বলেন, এর মধ্যে ১০ জন এই গ্রামের। এরপর জেলার আরও ২৬ জন নারী নিজেদের বীরকন্যা দাবি করে গেজেটভুক্ত করার আবেদন করেছেন। এই আবেদন বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত তাদের গেজেটভুক্ত করতে হবে।
আতাইকুলা গ্রামের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নারী বীর মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- কালিদাসী পাল, রাশমুনি পাল, বাণী রানী পাল, ক্ষান্ত রানী, রেনু বালা, সুষমা বালা, মায়া সুত্রধর, সন্ধ্যারাণী পাল, গীতা রানী পাল ও সুষমা পাল।
গেজেটভুক্ত ওই ১০ নারী বীর মুক্তিযোদ্ধার আটজনই প্রয়াত হয়েছেন। বেঁচে আছেন কালিদাসী পাল ও গীতা রাণী পাল।
নির্যাতিতা গীতা রানী বলেন, “যুদ্ধের সময় স্বামী-স্বজন-সম্মান সবকিছু হারিয়েছি। লোকলজ্জার ভয় না করে অনেক চেষ্টার পর ২-৩ বছর ধরে ভাতা পাচ্ছি। এখন একটু ভালোভাবে, নিরাপদে থাকার জন্য আমরাও মুক্তিযোদ্ধাদের মত বাড়ি চাই সরকারের কাছে।”
একই দাবি জানিয়েছেন আরেক জীবিত ‘বীরকন্যা’ কালিদাসী পাল।
তিনি বলেন, “আমরাও তো স্বীকৃতি পেয়েছি নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। তাহলে আমাদের কেন সরকারিভাবে বাড়ি দেওয়া হবে না? আমি বিশ্বাস করি, প্রধানমন্ত্রী আমাদের দিকে নজর দেবেন।”
রানীনগর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, “আতাইকুলার ১০ জন বীরকন্যাকে সরকার গেজেটভুক্ত করেছেন।”
যুদ্ধকালীন ত্যাগের স্বীকৃতি স্বরূপ গেজেটভুক্ত বীরকন্যাদের বীরনিবাস নির্মাণ করে দেওয়ার জন্য সরকারের দৃষ্টি ও হস্তক্ষেপ কামনা করে তিনি বলেন, “জেলায় আরো ২৬ জনের আবেদনের তদন্ত হয়েছে। আশা করছি, খুব দ্রুতই এই বীরকন্যাদেরও গেজেটভুক্ত করা হবে।”
দাবি জানানো নারীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে যাচাই-বাচাই করে স্বীকৃতির পাশাপাশি স্বীকৃতিপ্রাপ্ত গৃহহীন ও দরিদ্র বীরকন্যাদের পর্যায়ক্রমে বীরনিবাস নির্মাণের ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান, নওগাঁ জেলা প্রশাসক গোলাম মওলা।
আরও পড়ুন: