তিনি কিশোর বয়সে যুদ্ধে গিয়েও বেশ কয়েকটি সম্মুখসমরে অংশ নিয়েছিলেন।
Published : 08 Mar 2024, 09:11 AM
দুই ভাইকে বিহারি-রাজাকাররা ধরে নিয়ে যাওয়ার পর আর খোঁজ মেলেনি। এ অবস্থায় প্রতিশোধের তাড়নায় মাত্র ১৩ বছর বয়সে যুদ্ধে যান রাজবাড়ী শহরের সজ্জনকান্দা এলাকার সাইফুল ইসলাম স্বপন।
কিশোর বয়সেই অংশ নিয়েছিলেন বেশ কয়েকটি সম্মুখযুদ্ধে।
বর্তমানে ৬৬ বছর বয়সি সাইফুল ইসলাম স্বপন আসবাবপত্রের ব্যবসায় নিয়ে আছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি জানান, মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন তিনি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র।
তার বড় ভাই ফিরোজ খান টোনা রাজবাড়ী কলেজে স্নাতক শ্রেণিতে পড়ছিলেন। আরেক ভাই আমিনুল ইসলাম বাবুল একই কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে পড়তেন। তখনও বিয়ে করেননি কেউ। ১৯৭১ সালে দুজনই যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে।
যুদ্ধের দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে স্বপন বলেন, “দুই ভাই যুদ্ধে গেলেন। একাত্তরের ২১ এপ্রিল রাজবাড়ীতে যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রবেশ করে, তখন আমরা বাড়ি থেকে পালিয়ে অন্যত্র চলে যাই। অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক হলে ফিরি।
“অপরদিকে, বড় দুই ভাই ১০ মে হঠাৎ বাড়িতে আসেন। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর তারা বিশ্রামে। এর মধ্যে ভাইয়েরা বাড়ি আসার খবর পেয়ে যায় হানাদার বাহিনী। ৬০-৭০ জন অবাঙালি বিহারির সঙ্গে পাকিস্তানি মিলিশিয়ারা অস্ত্র নিয়ে আমাদের বাড়িতে ঢোকে।”
স্বপন বলছিলেন, “সশস্ত্র মিলিশিয়াদের দেখে আমার দুই ভাই লুকিয়ে পড়েন। আমি বাবা-মায়ের সঙ্গেই ছিলাম। মিলিশিয়া বাহিনী আমাকে পিঠমোড়া করে বাঁধে। লুকানো অবস্থা থেকে দুই ভাইকে খুঁজে বের করে তাদেরও একইভাবে বেঁধে ফেলে। তিন ভাইকেই নিয়ে যেতে উদ্যত হল। তখন মা কান্নাকাটি ও চিৎকার শুরু করে একরকম জোর করেই আমাকে রেখে দিলেন।
“দুই ভাইকে কোথায় নিয়ে হত্যা করেছে, সে খোঁজ আর পাওয়া যায়নি। তাদের লাশও মেলেনি। চোখের সামনে দুই ভাইকে ধরে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে প্রতিশোধের আগুন বুকে জ্বলে ওঠে।
“পরের ঘটনা, অগাস্টের দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় সপ্তাহের একদিন যুদ্ধকালীন সদর উপজেলার এড়েন্দা কুঠিবাড়ি ক্যাম্প কমান্ডার বাকাউল আবুল হাসেমের সঙ্গে দেখা হয় রাজবাড়ী শহরেই। আমার মা সঙ্গে ছিলেন। মায়ের সামনেই আমাকে যুদ্ধে যেতে বললেন।
“তখন কমান্ডার বাকাউল আবুল হাসেম মাকে বললেন, ‘ওকে নিয়ে যাই?’ মা কিছুতেই আমাকে ছাড়বেন না।
“কমান্ডার মাকে বললেন, ‘আপনার দুই ছেলেকে তো বাঁচাতে পারেন নাই; ওকে নিয়ে যাই। বেঁচে থাকলে ফেরত আসবে।’ এ কথা বলার পর মা কাঁদলেন। এক পর্যায়ে আমাকে ছেড়ে দিলেন। আমি চলে যাই ক্যাম্প কমান্ডার বাকাউল আবুল হাসেমের সঙ্গে।”
স্বপন বলছিলেন, “আমাদের ক্যাম্প এড়েন্দা কুঠিবাড়ি। বিশাল বাড়ি। বাড়ির বাইরে থেকে বোঝা যায় না ভেতরে কেউ আছে। ওখানে আমি ট্রেনিং নিই। রাত জেগে ট্রেনিং ক্যাম্পও পাহারা দিতাম। বিভিন্ন সময় আমরা অপারেশনে বের হতাম।
“আলাদিপুর এলাকায় সব ছিল রাজাকার। সেখানে একটি অপারেশনে আমাদের সঙ্গে থাকা মুক্তিযোদ্ধা খুশি শহীদ হন।
“এ ঘটনার পর একদিন রাতে অপারেশন চালাই। নভেম্বরের শেষের দিকে ওই ক্যাম্প ছেড়ে রাজবাড়ী শহরে চলে আসি।
“রাজবাড়ীতে বিহারি, মিলিশিয়া, পাকিস্তানি আর্মি অবস্থান নিয়েছে। লোকোসেড, নিউ কলোনি এলাকায় ছিল তাদের অবস্থান। অনেক মুক্তিফৌজ আসছে জেনে আমরাও চলে আসি। এর আগে বারবাকপুর, মষিবাথান এলাকায় রাত কাটাই। রাজবাড়ী আসার পর মুক্তিযোদ্ধারা থানা থেকে অস্ত্রশস্ত্র নেয়।”
এ কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আরও বলেন, “আমার কাছে একটি এসএমজি ছিল। আস্তে আস্তে মুক্তিবাহিনী এসে জড়ো হতে থাকল। এরপর লোকোসেড ও নিউ কলোনির দিকে যখন অগ্রসর হই, দেখলাম ব্যাপক গোলাগুলি।
“বিভিন্ন গুপ্ত জায়গা থেকে গুলি আসতে শুরু করল। এ অবস্থায় আমরা সতর্ক অবস্থান নিই। আমরা অপেক্ষা করতে থাকি। মাগুরা, কামারখালী ঘাটের পাশে যেসব মুক্তিযোদ্ধা অংশগ্রহণ করেছিল তাদের কাছে কুইনস মর্টার ছিল। সেই মর্টারটা এসে গেল। থানার পাশে একটি পরিত্যক্ত ভবন ছিল। সেখানে মর্টারটা রেখে ছোড়া শুরু হয়। এরপর আমাদের দিকে গুলি আসা বন্ধ হল। পরে আমরা লোকোসেড ও নিউ কলোনির দিকে এগোতে থাকি।”
সেখানে ডিসেম্বরের ১৬ থেকে ১৮ তারিখ বিকাল পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয় দাবি করে বীর মুক্তিযোদ্ধা স্বপন আরও বলেন, “অনেক লোক হতাহত হন। আমাদের চারজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। আমার কমান্ডারের আঙুলে বেয়নেট লাগে। ইলিয়াস নামে এক মুক্তিযোদ্ধার মাথায় গুলি লাগে। হেলমেট থাকায় তিনি প্রাণে বেঁচে যান। বার্ধক্যজনিত কারণে বছর পাঁচেক আগে তিনি মারা গেছেন।
“বিহারিরা সদর উপজেলার পাচুরিয়া থেকে সূর্যনগর পর্যন্ত রেললাইনের উপর একটি মালগাড়ি রেখেছিল যেন একদিকের গুলি অন্য দিকে যেতে না পারে। এভাবেই ১৮ ডিসেম্বর স্বাধীন হয় রাজবাড়ী।”
ওই কিশোর মুক্তিযোদ্ধা ১৯৮৬ সালে ঢাকার নবাবগঞ্জে বিয়ে করেন। স্ত্রী ও দুই ছেলে নিয়ে এখন তার সংসার। বড় ছেলে বাবার মতই ব্যবসায়ী, ছোট ছেলে প্রকৌশলী। যদিও স্বপনের বাবা ও মা আর জীবিত নেই।
আবেগাপ্লুত কণ্ঠে তিনি বললেন, “দেশ স্বাধীন হল। একসঙ্গে দুই সহোদর হারানোর বেদনা নিয়ে আজও বেঁচে আছি।”
রাজবাড়ী শহরের বড়পুল এলাকার ব্যবসায়ী খায়রুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, তাদের বাড়িটা ছিল পৌরসভার পাশে। পাকিস্তানি বাহিনী রাজবাড়ী আসার পরে বিভিন্ন সময়ে বাড়ি থেকে পালাতে বাধ্য হন। রাজবাড়ী শহর থেকে জেলার বাণিবহ, রামকান্তপুর, বহরপুর বিভিন্ন স্থানে চলে যেতেন। আবার যুদ্ধের তীব্রতা যখন কমে তখন ফিরে আসতেন।
খায়রুল ইসলাম বলেন, “একদিন মুরগি ফার্ম এলাকায় দেখলাম, মুক্তিযুদ্ধের একটি দল। এ দলের ভেতরে একটি ছেলে আমার সমবয়সি। কাছে গিয়ে দেখেন, স্বপন। ওর হাফপ্যান্ট পরা ছিল। শার্ট ইন করা। মাথায় একটি সবুজ রঙের হেলমেট। পিঠে একটি এসএমজি। দেখে খুব ভালো লাগল। স্বপন মুক্তিযুদ্ধ করছে।”
এড়েন্দা কুঠিবাড়ি ক্যাম্পের কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা বাকাউল আবুল হাসেম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “স্বপনের দুই ভাইকে বিহারিরা আগেই মেরে ফেলে। বড় ভাই ফিরোজ খান ছিল আমার ক্লাসমেট।
“রাজবাড়ীতে যখন পুরোদমে যুদ্ধ চলছে, সেসময় আমরা শহরে আসি। একদিন রাজবাড়ী হাসপাতাল পরিদর্শন করে সজ্জনকান্দার রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম। পথে কিশোর স্বপনকে দেখতে পাই তার মায়ের সঙ্গে।
“কী ভেবে যেন তাকে যুদ্ধে যেতে বললাম, সেও রাজী হয়ে গেল। স্বপনের মায়ের কাছে ছেলেকে নিয়ে যেতে বললে তিনি কিছুতেই রাজী হচ্ছিলেন না।
“শেষে বললাম, দুই ছেলেকে তো মেরেই ফেলেছে। ওকে আমার কাছে দিন; নিরাপদে রাখব। এরপর স্বপনকে নিয়ে ক্যাম্পে গেলাম। তাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে অস্ত্র চালানো শেখান হল। যুদ্ধে বেশ কয়েকটি অপারেশনেও অংশ নেয় সে।”
আরও পড়ুন:
১৯৭১: তীর-ধুনক নিয়েই রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও
১৯৭১: পানপট্টির সম্মুখ যুদ্ধে মুক্ত হয়েছিল পটুয়াখালী
মুক্তিযুদ্ধে ডাকরায় ছয় শতাধিক হিন্দুকে হত্যার স্মৃতি তাড়া করে আজও
৬৩ জনের গণকবর লুপ্ত, স্মৃতি বলতে ‘মানকচু’
কুমার নদে গাড়াগঞ্জ যুদ্ধ: ফাঁদে ফেলে হত্যা করা হয় ৮০ হানাদারকে
জরাজীর্ণ গ্রন্থাগার-জাদুঘর, বীরশ্রেষ্ঠকে ‘স্মরণ’ কেবল মৃত্যুদিনে