১৯৭১ সালের ২৪ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা গয়ড়া গ্রামের ৬৩ জনকে হত্যা করে; পরে তাদের গণকবরে সমাহিত করা হয়।
Published : 02 Mar 2024, 12:05 PM
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মৃতি রক্ষায় নির্মিত যশোরের বধ্যভূমিগুলো যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে বিলুপ্ত হতে চলেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।
জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা শার্শার বেনাপোল ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডে পড়েছে গয়ড়া গ্রাম। বেনাপোল সদর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে কাগজপুর বাজার থেকে দক্ষিণে মোড় নিলেই গয়ড়া গ্রাম শুরু।
১৯৭১ সালের ২৪ এপ্রিল একদিনে পাকিস্তানি সেনারা গয়ড়া গ্রামের ৬৩ জনকে হত্যা করে এবং পুড়িয়ে দেয় সব বাড়িঘর। ওইদিন শহীদদের সমাহিত করা হয় কয়েকটি গণকবরে।
কিন্তু অযত্ন, অবহেলা ও অসচেতনতার কারণে এসব গণকবর আজ লুপ্ত হতে চলেছে। এ গ্রামে কোনো স্মৃতিফলকও নির্মাণ করা হয়নি।
শার্শা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মোজাফফর হোসেন বলেন, “গয়ড়া গ্রামে ১৯৭১ সালের ২৪ এপ্রিল থেকে মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানিদের মধ্যে পনের দিনের যুদ্ধে প্রায় দেড় শতাধিক সাধারণ মানুষ প্রাণ হারায়। সামনাসামনি ওই যুদ্ধে ১৫০ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় এবং ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
“গয়ড়া গ্রামে মসজিদের পশ্চিম পাশে, কিতাব আলির বাড়িতে, নূর মোহাম্মদের বাড়ির পুকুর পাড়ে ও বাবর আলির বাড়ির প্রাচীরের পাশে গণকবর আছে। কিন্তু এ গ্রামে কোনো স্মৃতফলক নেই। স্থানীয়রা পরে কাগজপুকুর বাজারে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেছে।”
মুক্তিযুদ্ধের সময় গয়ড়া গ্রামটি ছিল ৮ নম্বর সেক্টরের বেনাপোল সাব-সেক্টরের আওতায়। ওই সময় সাব-সেক্টর কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম ও ক্যাপ্টেন তৌফিক-ই-ইলাহী।
ওই সেক্টরের কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরী কাগজপুকুরের যুদ্ধ সম্পর্কে ‘যশোর জেলার ইতিহাস’ বইয়ে লিখেছেন, দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের সদর দপ্তর ১৮ এপ্রিল ইছাখালী থেকে বেনাপোলে স্থানান্তরিত করা হয়। সেদিনই রণাঙ্গনের সর্বাধিনায়ক মেজর ওসমান বেনাপোলের পূর্বদিকে কাগজপুকুর ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) এর দুটি কোম্পানি নিয়ে প্রতিরক্ষাব্যুহ রচনা করেন।
“২৩ এপ্রিল বিকালে পাকিস্থানিরা কাগজপুকুর আক্রমণ করলে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরক্ষা গুটিয়ে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়। পরে মুক্তিযোদ্ধারা বেনাপোলের পূর্ব সীমানায় রাস্তার দুই পাশে দুই কোম্পানি অবস্থান নেয়। এ সময় তাদের কাছে কোনো ‘ফিল্ড টেলিফোন’ বা ‘ওয়্যারলেস’ না থাকায় তারা প্রতিরক্ষা পজিশনগুলি কখনই সমন্বয় করতে পারেনি।
“এদিকে বেনাপোলের পূর্ব সীমানায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষাব্যুহকে সুরক্ষা করার সময় ও সুযোগ না দিয়ে মাত্র ১২ ঘণ্টার ব্যবধানে ২৪ এপ্রিল ভোর ৪টায় পাকিস্থানি বাহিনীর দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্য মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর হামলা করে। মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণপন চেষ্টা করেও তাদের অবস্থানে টিকে থাকতে পারেনি। মেজর ওসমানের নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার জন্য তিন ইঞ্চি মর্টারসহ একটি সার্পোট প্লাটুন পাঠানো হয়। কিন্তু মর্টারের আঘাতেও তাদের পাক সেনাদের অগ্রাভিযান বন্ধ করা সম্ভব হয়নি।”
'যশোর জেলার ইতিহাস’ বইয়ে মুক্তিযোদ্ধা হাফিজ উদ্দিন আহমেদ গয়ড়া ও কাগজপুকুরের যুদ্ধের লড়াই প্রসঙ্গে লিখেছেন, “এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের ধোকা দেওয়ার জন্য পাক সেনাদের কিছু অংশ ইপিআর বাহিনীর পোশাক পরে অগ্রসর হচ্ছিল। নায়েক সুবেদার মুজিবুর রহমান মেজর সাহেবের নির্দেশ না মেনেই একখানা সামরিক জিপ ভর্তি অ্যামুনিশন (গোলাবারুদ) নিয়ে রওনা হন মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতে।
“প্রবল গোলাগুলি ও রকেট বৃষ্টির মধ্যে নিজের জীবন বিপন্ন করে প্রতিটি পরিখায় (দুর্গ) গোলাবারুদ পৌঁছে দিয়ে তিনি দেখেন, অসংখ্য শত্রুসেনা সামনে থেকে আসছে। পরিখার আশপাশে প্রবল গোলাবৃষ্টি হচ্ছে। একজন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় গানের পাশে শহীদ হয়ে পড়ে আছেন। বাকি দুজন টিকতে না পেরে গানের লক খুলে নিয়ে পিছু হটেছেন। এরপর নায়েক সুবেদার মুজিবুর রহমান নিজেই শত্রুর দিকে গুলি চালাতে শুরু করেন। এমন সময় একটি বুলেটে মৃত্যুবরণ করেন তার সাহায্যকারী সৈনিক।
“তখন লাশটি একটু দুরে সরিয়ে তিনি মুজিবুর একাই শত্রুসেনাদের মোকাবেলা করতে থাকেন। এক সময় তার গানের বেল্ট শুন্য হয়ে যায়। তখন মুজিবুর ‘আল্লাহু আকবর’ ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি সহকারে খালি হাতে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। সঙ্গে সঙ্গে একঝাঁক গুলি ঝাঁঝরা করে দেয় মুজিবুরের বুকের পাঁজর। এরপর পাকবাহিনীর আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে কাগজপুকুরের পতন ঘটে। পরে সরকার মুজিবুর রহমান ‘বীর বিক্রম’ উপাধি প্রদান করে।”
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা দীন ইসলাম বলেন, “রাজাকারদের ছক অনুযায়ী পাকিস্থানি সেনারা গয়ড়া গ্রাম আক্রমণ করে। তখন প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেও স্বল্পসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা ও ইপিআর বাহিনীর সদস্যরা সম্মুখযুদ্ধে টিকে থাকতে পারেনি। এ সময় ওদের পথে বাধা সৃষ্টির জন্য ইপিআর বাহিনী কন্যাদহ খালের উপরের ব্রিজটি উড়িয়ে দেয়; কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি।
“গ্রামের সাধারণ মানুষকে রক্ষার জন্য ইপিআরের কেউ কেউ এ সময় গ্রামে ঢুকে তাদেরকে পালিয়ে যেতে বলেন। তখন মুহুর্মুহু গুলি চলছে। অনেকে পালানোর সুযোগও পাননি।
পাকিস্তানি সেনারা গয়ড়া গ্রামে ঢুকেই কিতাব আলির বাড়িতে প্রথম হামলা চালায়। এ সময় কিতাব আলি, তার ছেলে কেরামত আলি ও আব্দুর রহমান, দুই ভাই লুৎফর রহমান ও ওসমান আলি এবং তার মেয়েকে গুলি করে হত্যা করে বলে জানান দীন।
৯৮ বছর বয়সী বৃদ্ধ নূর মোহাম্মাদ বলেন, “কিতাবের বাড়ির পশ্চিমপাশের বাড়িটি ছিল আমাদের। ওদের বাড়িতে হামলার পর পাকিস্তানি সেনারা আমাদের বাড়ি এসে প্রথমে হত্যা করে আমার শাশুড়ি লতিফুর নেছাকে। পরে আমার স্ত্রী পরী বেগম, ছয় মাস বয়সী ছেলে, ভাইবউ আছিয়া খাতুন ও সাইফুন নেছাকে হত্যা করে।
“আমি পালাতে পারলেও ওরা পালাতে পারেননি। পাকিস্তানি সেনারা চলে যাওয়ার পর এসে সবার রক্তাক্ত লাশ পড়ে থাকতে দেখি। পরে পাশের বাড়ির মমতাজকে সঙ্গে নিয়ে পুকুরের কোণায় তাদের একসঙ্গে কবর দেই।”
“এখন সেখানে চিহ্ন বলতে রয়েছে কতগুলো মানকচুর গাছ”, বলেন তিনি।
শার্শা উপজেলা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল হক মঞ্জু বলেন, ১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল সকালে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ ব্রিটিশ এমপি ডগলাস ম্যানকে নিয়ে যশোরের বেনাপোল সফর করেন। তাজউদ্দীন আহমেদ চলে যাওয়ার ১৫ মিনিট পর যশোর-বেনাপোল সড়কের কাগজপুকুরে মুক্তিবাহিনী অবস্থানের মধ্যে পাকবাহিনী গোলন্দাজ সহায়তা নিয়ে প্রচণ্ড আক্রমণ করে। তাদের আক্রমণে মুক্তিবাহিনীর বেশ কয়েকজন হতাহত হয়।
“এমন সময় হঠাৎ পেছন দিক থেকে জিপ চালিয়ে লেফটেন্যান্ট হাফিজের কাছে আসেন ভারতের ১৮ বিএসএফ এর কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কমান্ডেড মেঘ সিং। তিনি যুদ্ধে আহতদের অবিলম্বে ভারতের পেট্রাপোল পাঠানোর নির্দেশ দিয়ে চলে যান। ভারতে ফিরে তিনি ক্যাপ্টেন ভারমার কমান্ডে ছয়টি ৩ ইঞ্চি মর্টারসহ একটি ইউনিট এখানে পাঠিয়ে দেন। যৌথ দল পাকিস্তানিদের এ যাত্রায় প্রতিরোধে সক্ষম হয়।”
উপজেলা চেয়ারম্যান বলেন, “মেঘ সিংহ এর সাহায্যের জন্য সেদিন পাকিস্তানি সেনাদের অনেক হতাহত হয়। পরবর্তী ১৫ দিন তারা আর কোনো আক্রমণ চালায়নি। এই সাফল্যের ওপর লেফটেন্যান্ট হাফিজকে পরে বীর বিক্রম খেতাব দেওয়া হয়।”
শার্শা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল হক মঞ্জু বলেন, ১৯৭১ এর ২৪ এপ্রিল ওই হত্যাকাণ্ড হয়। ওইদিন নিহতদের কয়েকটি গণকবরে সমাহিত করা হয়। অযত্ন, অবহেলা ও অসচেতনতার কারণে এসব গণকবর লুপ্ত হতে চলেছে।
“আমরা এই উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সম্বলিত যেসব স্থাপনা রয়েছে বা যেসব বিষয়গুলো রয়েছে সেগুলো সংরক্ষণের জন্য ব্যবস্থা নিচ্ছি। এরই মধ্যে কিছু কিছু জায়গায় কার্যক্রম গ্রহণ করেছি।”
বেনাপোল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বজলুর রহমান বলেন, “গণকবরগুলো সরকারিভাবে সংরক্ষণের জন্য আমি কয়েকবার প্রস্তাবনা দিয়েছি; কিন্তু সেটা আজও হয়নি। অযত্ন ও অবহেলার কারণে এসব গণকবর লুপ্ত হতে চলছে।
“স্থানীয় কাগজপুকুর বাজারে একটি স্মৃতিস্তম্ভ হলেও এ গ্রামে কোনো স্মৃতিফলক করা হয়নি। আমি চাই ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য দ্রুত কবর স্থানগুলো চিহ্নিত করে সংরক্ষণ করা হোক।”