“১৯৭১ সালে যারা মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছিল; শেখ মুজিবকে ভোট দিয়েছিল, তাদের ওই দু’দিনে হত্যা করা হয়।”
Published : 04 Mar 2024, 09:15 AM
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বরগুনাবাসীর জন্য রক্তাক্ত স্মৃতি বিজড়িত দুটো দিন ২৯ ও ৩০ মে। এ দুটি দিনে বরগুনা জেলখানায় আটকে রাখা নিরীহ বাঙালিদের গুলি করে হত্যা করা হয়।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর রোষানলের শিকার হয়ে অনেক বাঙালি মুসলমান সেদিন কবরে ঠাঁই পাননি, হিন্দুরা পাননি আগুনের ছোঁয়া। একই গর্তে তাদের মাটিচাপা দেওয়া হয়।
বরগুনা শহরের পৌর এলাকার শহীদ স্মৃতি সড়ক দিয়ে দক্ষিণ দিকে হেঁটে গেলে চোখে পড়বে লাল রঙের পাঁচিল ঘেরা জেলখানা। এর দক্ষিণ পাশে শহীদদের গণকবর। একাত্তরে সেখানে বরগুনার মুক্তিকামী মানুষদের মাটিচাপা দেওয়া হয়।
তাদের স্মৃতির উদ্দেশে ১৯৯২ সালে সেখানে একটি সৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। শ্বেত পাথরে লেখা আছে শহীদদের নাম।
জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আনোয়ার হোসেন মনোয়ার বলেন, “১৯৭১ সালে যারা মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছিল; শেখ মুজিবকে ভোট দিয়েছিল, তাদের ওই দু’দিনে হত্যা করা হয়।”
তিনি বলেন, “ইতিহাস বলছে, একাত্তরের ২৬ এপ্রিল তৎকালীন বরগুনা মহকুমা পাকিস্তানি বাহিনী দখলে নেওয়ার খবরে মুক্তিকামী জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে স্পিডবোট নিয়ে নদী পথে সদরের দিকে রওনা হয়। কিন্তু হাতে পর্যাপ্ত অস্ত্র না থাকায় তারা ফিরে যেতে বাধ্য হন।”
সাবেক এ জেলা কমান্ডার বলেন, “কোনো প্রতিরোধ দেখতে না পেয়ে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও পাকিস্তানপন্থি অন্যরা বরগুনা শহর দখল করে।
“পরে সাবেক মুসলিম লীগ নেতা এম এন এ আবদুল আজিজ মাস্টার ও পাথরঘাটার তাহের উদ্দিন হাওলাদার পটুয়াখালী থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে বরগুনা নিয়ে আসেন।”
মনোয়ারের ভাষ্য, তখন বরগুনা শহর ছিল প্রায় জনমানবশূন্য। ১৪ মে এসডিওর জেটিতে পাকস্তানি বাহিনী অবস্থান নিয়ে কোর্ট বিল্ডিং এলাকায় কিছু লোক জড়ো করে ভাষণ দেয়।
পরদিন ১৫ মে পাথরঘাটা থানার বেশ কয়েকজনকে ধরে এনে বিষখালী নদীর তীরে ব্রাশফায়ার করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
সেদিন মুক্তিযোদ্ধাদের আহাজারি ও স্বজনহারাদের কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। বিষখালী নদীর পানি রক্তে লাল হয়ে যায়। সেই হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্ব দেন পটুয়াখালী জেলার সামরিক আইন প্রশাসক মেজর নাদের পারভেজ।
ওই সময় পাথরঘাটার ব্যবসায়ী লক্ষণ দাস, তার ছেলে কৃষ্ণ দাস, অরুণ দাস ও স্বপন দাসকে ধরে এনে বরগুনা কারাগারে আটক রাখা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থানের কারণে বরগুনা থানায় কর্মরত ওই সময়ের ওসি আতিকুল্লাহ, দারোগা আবদুল মজিদ, সিপাহি আড়ি মিয়া ও আবদুল জব্বারকে পটুয়াখালীতে নিয়ে হত্যা করা হয়।
ছাত্র ইউনিয়ন নেতা কাকচিড়ার মুক্তিযোদ্ধা মজিবর রহমান কনককে হত্যা করা হয় বরগুনার পুরাতন খেয়াঘাটে নিয়ে। মনোয়ারও সে সময় একই সংগঠন করতেন।
তিনি বলেন, পাকিস্তানি বাহিনীর হানায় বরগুনা শহর ধীরে ধীরে জনশূন্য হতে থাকে। তখনই হানাদারেরা মরণফাঁদ পাতে।
তাদের সহযোগীদের কাছ থেকে ঘোষণা আসে, বর্ণ হিন্দুদের কিছুই বলা হবে না। এই ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী বরগুনা ছেড়ে পটুয়াখালী চলে যায়।
ঘোষণায় আশ্বস্ত হয়ে হিন্দুরাসহ আওয়ামী লীগ সমর্থকরা বরগুনা শহরে যার যার বাসায় ফেরেন। এর মধ্যেই ২৬ মে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাপ্টেন সাফায়াত চারজন সহযোগীকে নিয়ে স্পিডবোটে করে গোপনে বরগুনায় আসেন।
তাদের আসার খবর সেদিন কেউ পাননি। পরদিন সকাল থেকে ২-৩ জন করে লোক ধরা শুরু হয়। দুপুরে বৃষ্টি হয়। বৃষ্টির মধ্যেই লোকজন পালাতে থাকে।
তখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সদস্যরা বিহারি ধুনকর (লেপ-তোশক তৈরির কারিগর) ইমাম হোসেনের মত সহযোগীদের নিয়ে নাথপাড়া, পশ্চিম বরগুনা ও শহর এলাকা ঘেরাও করে শতাধিক নারী-পুরুষকে বেঁধে জেলখানায় নিয়ে যায়।
পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্য ও তাদের সহযোগীরা সিঅ্যান্ডবির ডাকবাংলোকে ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করে। রাতে অনেক মা-বোনকে জেলখানা থেকে সেখানে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়। সকালে আবার তাদের জেলখানায় পাঠানো হয়।
এসব ঘটনার নীরব সাক্ষী জেলার মাইঠা গ্রামের ফারুকুল ইসলাম। দুদিনে জেলখানায় পাঁচবার গুলি চালালেও অলৌকিকভাবে বেঁচে যান এই প্রত্যক্ষদর্শী। যদিও তার দুই ভাই নাসির ও শানুকে মেরে ফেলা হয়।
ফারুকুল ইসলাম বলেন, একাত্তরের ২৮ মে পটুয়াখালী জেলা সামরিক আইন প্রশাসক মেজর নাদের পারভেজ বরগুনায় আসেন। পরদিন বরগুনা জেলখানায় প্রহসনমূলক বিচারের ব্যবস্থা করে গণহত্যা শুরু হয়।
জেলখানার উত্তর-পশ্চিম পাশে বরগুনা জেলা স্কুল। প্রতিদিনের মত সেদিনও ছাত্ররা স্কুলে এসেছিল। ক্লাস শুরুর ঘণ্টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড গুলির শব্দে শহরময় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সবাই ছুটোছুটি শুরু করে দেয়।
বরগুনা জেলখানায় গুলিবিদ্ধ হয়ে তখন একের পর এক লোকজন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে লাগল।
প্রথম দিন তারা ৫৫ জনকে হত্যা করে। অনেকে সেদিন গুলি খেয়ে আধামরা অবস্থায় পড়ে ছিলেন। কিন্তু তাদেরও শেষ রক্ষা হয়নি। পরের দিন আবারও ২১ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
জেলখানায় হত্যা করে তাদের সবাইকে একটি গর্তে মাটিচাপা দেওয়া হয়।
মুক্তিযোদ্ধা শুকরঞ্জন শীল জানান, কেষ্ট ডাক্তার নামে পরিচিত কৃষ্ণ দাস গুলিবিদ্ধ হয়েও বেঁচেছিলেন। তবে হামাগুড়ি দিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের রাস্তা পার হওয়ার সময়ে তাকে ধরে কোদালের হাতল দিয়ে মাথা গুঁড়িয়ে হত্যা করা হয়।
এভাবে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল পাথরঘাটার লক্ষণ দাস ও তার ছেলে অরুণ দাসকেও।
অনেককে পটুয়াখালী নিয়েও হত্যা করা হয়। তাদের অনেকের নাম আজও জানা যায়নি।
বরগুনা সদর ইউনিয়নের তখনকার চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমান পনুকে পটুয়াখালী নিয়ে হত্যা করা হয় বলে জানান তার ছেলে মনিরুল ইসলাম।
তিনি বলেন, তার বাবাকে পাকিস্তানি বাহিনী ধরে পটুয়াখালী নিয়ে যায়। পরে তাদের আর সন্ধান মেলেনি।
এ ছাড়া আয়লা-পাতাকাটা ইউনিয়ন পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান আবদুর রশিদ মাজেদ ও মুক্তিযোদ্ধা স্থানীয় আবু তাহেরকে খাকদোন নদীর তীরে এসডিওর ঘাটে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।
আবদুর রশিদ মাজেদের ছেলে আইনজীবী মজিবুর রহমান ফরহাদ বলেন, তার বাবাকে তৎকালীন এসডিও ঘাটে নিয়ে গুলি করে হত্যার পর লাশ খাকদোন নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।
কারাগারে ৭৬ জন ও অন্য জায়গায় আটজনসহ মোট ৮৪ জনের নাম খচিত বরগুনা গণকবরের পাশে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে।