১৯৭১: তীর-ধুনক নিয়েই রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও

“সেদিন সন্ধ্যার আগেই ৫০০ থেকে ৬০০ মরদেহ পেট্রোল ঢেলে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে আগুন।”

আফতাবুজ্জামান হিরুরংপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 March 2024, 04:22 AM
Updated : 7 March 2024, 04:22 AM

রংপুরের মানুষের জন্য অবিস্মরণীয় ও বীরত্বগাথার দিন ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ। মুক্তিযুদ্ধে এই দিনে বাঁশের লাঠি, তীর-ধনুক নিয়ে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করে অনন্য ইতিহাসের জন্ম দিয়েছিল অকুতোভয় বীর বাঙালি।

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দুই দিন পর রংপুরের মুক্তিকামী মানুষ ক্যান্টনমেন্ট দখলের সিদ্ধান্ত নেয়। সেদিন রংপুরের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ একজোট হয়ে ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করে।

সেদিন সাধারণ মানুষের সঙ্গে মুক্তিকামী ওঁরাও, সাঁওতাল আদিবাসীরা লাঠি, তীর-ধনুক নিয়ে আক্রমণ করে সৃষ্টি করে অনন্য ইতিহাস।

দিনটি ‘ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে রংপুরে।

মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক সদরুল আলম দুলু বলেন, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ অনেকটা আকস্মিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দুদিন পরই প্রায় খালি হাতে পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটি ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করে রংপুরের মানুষ।

যদিও রংপুরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই পাকিস্তান সরকারের শাসন, শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছিল। ৩ মার্চ রংপুরে মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয় শিশু শংকু সমজদার।

২৪ মার্চ নিসবেতগঞ্জ এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর একটি গাড়িতে হামলা করে অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে আব্বাসী নামে এক সেনা সদস্যকে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে স্থানীয় শাহেদ আলী নামে এক কসাই।

এ নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে গোটা শহরে। বাড়তে থাকে পাকিস্তানি সেনাদের ক্রোধ আর প্রতিশোধের মহড়া।

২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরীহ বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে ২৬ মার্চ থেকে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। এর দুদিন পর অর্থাৎ ২৮ মার্চ রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করা হয়।

সে দিনের ঘেরাওয়ে অংশ নেওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মুক্তির নেশায় পাগল এসব মানুষদের সংগঠিত করেন তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সিদ্দিক হোসেন এমপি, আব্দুল গণি, তৈয়বুর রহমান, মুখতার এলাহি, আবুল মনছুর, ইছহাক চৌধুরী, ন্যাপ নেতা সামছুজ্জামান ও কমিউনিস্ট নেতা ছয়ের উদ্দিনসহ আরও অনেকে।

সেদিন বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা গ্রামের হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ মানুষ তীর-ধনুক, দা-কুড়াল, বল্লম ও বাঁশের লাঠি হাতে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টের আশপাশের এলাকাসহ ঘাঘট নদীর তীরে জমায়েত হয়। শুরু হয় পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সম্মুখ লড়াই।

নৃগোষ্ঠী ওঁরাও, সাঁওতাল সম্প্রদায়ের তীরন্দাজরা এই আক্রমণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে তারা রংপুর ক্যান্টনমেন্টে প্রবেশের চেষ্টা করে। এ সময় ক্যান্টনমেন্ট থেকে আসতে থাকে বৃষ্টির মত গুলি। এই সম্মুখযুদ্ধে নাম জানা, অজানা অনেক নিরস্ত্র মানুষ পাকিস্তানি হানাদারদের গুলিতে শহীদ হন। আহত হন অগণিত। এখন এসব শহীদ পরিবার ও আহত ব্যক্তিদের খোঁজ রাখে না কেউ। অনেক আহত ব্যক্তি পঙ্গুত্ববরণ করে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

২৮ মার্চ ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করতে গিয়ে শহীদ হন রাণীপুকুর ইউনিয়নের দৌলত নূরপুর গ্রামের আয়নাল হক।

প্রত্যক্ষদর্শী ও সেসময় রংপুর ক্যান্টনমেন্টে কর্মরত ২৯ ক্যাভেলরি রেজিমেন্টের মেজর নাসির উদ্দিন তার ‘যুদ্ধে যুদ্ধে স্বাধীনতা’ গ্রন্থে সেদিনের বর্ণনায় লিখেছেন- “যে দৃশ্য আমি দেখলাম, তা চমকে যাওয়ার মতোই। দক্ষিণ দিক থেকে হাজার হাজার মানুষ সারি বেঁধে এগিয়ে আসছে সেনা ছাউনির দিকে। তাদের প্রত্যেকের হাতেই দা-কাঁচি, তীর-ধনুক, বর্শা, বল্লমের মতো অতি সাধারণ সব অস্ত্র।

“বেশ বোঝা যাচ্ছিল এরা সবাই স্থানীয়। সারি বাঁধা মানুষ পিঁপড়ার মতো লাঠিসোঁটা বল্লম হাতে ক্রমেই এগিয়ে আসছে ক্যান্টনমেন্টের দিকে।

“এ সময় ক্যান্টনমেন্ট থেকে গোটা দশেক জিপ বেরিয়ে আসে এবং মিছিল লক্ষ্য করে শুরু হয় একটানা মেশিনগানের গুলি বর্ষণ। মাত্র পাঁচ মিনিটে চারিদিক নিস্তব্ধ হয়ে যায়। হাজার হাজার লাশ পড়ে থাকে মাঠে।

“গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মাঠের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা মানুষগুলোকে টেনে-হিঁচড়ে এনে এক জায়গায় জড়ো করা হলো পুড়িয়ে ফেলার জন্য। কিন্তু তখনও যারা বেঁচে ছিলেন তাদের গোঙানিতে বিরক্ত হয়ে উঠেছিল পাঞ্জাবি জান্তারা। এ অবস্থাকে আয়ত্তে আনার জন্য বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে চিরতরে তাদের থামিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে উঠল।”

তিনি বর্ণনা করেছেন, “আহতদের আর্তনাদে গোটা এলাকার আকাশ বাতাস যেন ভারি হয়ে উঠল। সেদিন সন্ধ্যার আগেই ৫০০ থেকে ৬০০ মরদেহ পেট্রোল ঢেলে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে আগুন। এ আগুন অন্য যেকোনো আগুনের চেয়ে অনেক বেশি লাল। অনেক বেশি দহন করে এই বহ্নিশিখা। খুব কাছ থেকেই সেই আগুন আমি দেখছি। দেখছি, কেমন করে জ্বলছে স্বাধীনতাপ্রিয় অসহায় মানব সন্তান।”

রংপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোসাদ্দেক হোসেন বাবলুর সঙ্গে কথা হয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।

তিনি জানান, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর দেশের মানুষ সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি নেয়। রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাওয়ের দিনক্ষণ ঠিক হয় ২৮ মার্চ। ঘেরাও অভিযানে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে স্থানীয় বিভিন্ন হাট-বাজারে ঢোল পেটানো হয়। এতে সাড়া দেন সাধারণ মানুষ। হানাদারদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয় সব শ্রেণি-পেশার মানুষ।

তিনি জানান, ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ সকাল থেকে রংপুরের বিভিন্ন এলাকার থেকে সংগঠিত হয়ে ক্যান্টনমেন্টের আশপাশে জড়ো হন হাজারো জনতা। এদিন আদিবাসীরা তীর-ধনুক নিয়ে নেমে পড়েন। এর মধ্যে ওঁরাও, সাঁওতাল সম্প্রদায়ের তীরন্দাজরা সেদিন তীর-ধনুক, বল্লম, দা, বর্শা নিয়ে যোগ দিয়েছিল ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণে।

সেদিন এই সম্মুখযুদ্ধে নাম না জানা অনেক নিরস্ত্র মানুষ পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে শহীদ হন। আহত হন অগণিত। তাই দিবসটি স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।