একাত্তরের ২৭ মার্চ ঝিনাইদহের গাড়াগঞ্জ কুমার নদের সেতুর দক্ষিণ পাশে রাস্তা কেটে নকল সড়ক করে গভীর খাদ তৈরি করে রাখে মুক্তিকামী বাঙালিরা।
Published : 03 Mar 2024, 09:47 AM
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝিনাইদহে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যে কয়টি গৌরবোজ্জ্বল বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ হয়েছে তার মধ্যে শৈলকুপার কুমার নদের সেতুতে হওয়া গাড়াগঞ্জ যুদ্ধ অন্যতম।
৩০ মার্চ রাত ও ৩১ মার্চ দিনে ওই যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুক্তিকামী বাঙালির বিজয় জনতার মনোবল আরও বাড়িয়ে দেয়।
গাড়াগঞ্জ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় মাইলফলক হয়ে আছে। এ যুদ্ধে অন্তত ৭০ থেকে ৮০ জন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সদস্যকে গুলি, কুপিয়ে, পিটিয়ে ও পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষ। যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গাড়ি ও অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে।
একাত্তরের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের পর ঝিনাইদহে মুক্তিকামীরা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। বিভিন্ন স্থানে ছাত্র-যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন আনসার ও প্রাক্তন সৈনিকরা।
এর মধ্যে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির উপর আক্রমণ করে হত্যা করার খবর আসতে থাকে।
ঝিনাইদহের ট্রেজারি খুলে অস্ত্র-গুলি তুলে দেওয়া হয় ছাত্র-জনতার হাতে। শুরু হয় সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রস্তুতি। ২৫ মার্চ রাতে যশোর সেনানিবাস থেকে একটি সেনা কনভয় সুসজ্জিত হয়ে ঝিনাইদহের উপর দিয়ে কুষ্টিয়া যায়। তারা মোহিনী মিল, পুলিশ লাইন ও জিলা স্কুলে ঘাঁটি গাড়ে।
২৯ মার্চ ভোরে কুষ্টিয়ায় পাকিস্তানি সেনা অবস্থানের উপর আক্রমণ হানার প্রস্তুতি নেওয়া হয়। চুয়াডাঙ্গাতে স্থাপন করা হয় সামরিক কমান্ড। কিন্তু নানা বিবেচনায় একদিন পিছিয়ে ৩০ মার্চ ভোরে তৎকালীন ইপিআর, পুলিশ, আনসার বাহিনী ও ছাত্র-জনতা সংগঠিত হয়ে সেখানকার পাকিস্তানি সেনা অবস্থানগুলোতে আক্রমণ শুরু করে।
কুমারখালী থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধারা প্রথমে মোহিনী মিল ঘাঁটি আক্রমণ করে। কয়েক ঘণ্টার যুদ্ধে এ ঘাঁটির পতন হয়।
এরপর তুমুল যুদ্ধে বিকালে পুলিশ লাইনের পাকিস্তানি ঘাঁটির পতন ঘটে। পাকিস্তানি সেনারা জিলা স্কুলে জড়ো হয়। তাদের ওপর আক্রমণের তীব্রতা বেড়ে যায়। এর মধ্যে রাত ৮টার দিকে জিলা স্কুল ঘাঁটি ছেড়ে যশোর সেনানিবাসের দিকে পালাতে থাকে পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা।
এদিকে সাধারণ জনতা ২৭ মার্চ গাড়াগঞ্জ কুমার নদের সেতুর দক্ষিণ পাশে রাস্তা কেটে গভীর খাদ তৈরি করে।
তার উপর বাঁশের চাটাই বিছিয়ে দেয়। চাটাইয়ের উপর আলকাতরার প্রলেপ দিয়ে নকল সড়ক তৈরি করে। আর মুক্তিকামী আনসার ও পুলিশ সদস্যরা সেতুর দুই পাশে বাংকার তৈরি করে অবস্থান নেন।
৩০ মার্চ রাত ৯টার দিকে পাকিস্তানি সেনারা যশোর সেনানিবাসে পালানোর সময় ওই ফাঁদে পড়ে। সামনে থাকা দুটি গাড়ি ফাঁদের গর্তে পড়ে। বাকি গাড়িগুলো সেতুর উপর থেমে যায়। এ সময় পাকিস্তানি সেনারা দুটি মর্টার শেল নিক্ষেপ করেন।
এদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধারা গুলি বর্ষণ শুরু করেন। চারিদিক থেকে হাজার হাজার জনতা গগনবিদারি ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে থাকে। এতে পাকিস্তানি বাহিনী হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। তারা স্তব্ধ হয়ে যায়। ঝোপ-জঙ্গলে লুকিয়ে পড়ে। পরের দিন ভোরের আলো ফুটলে তাদের উপর আবার আক্রমণ শুরু হয়।
পাকিস্তানি বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। জনতা ধাওয়া করে। পাকিস্তানি সেনাদের গুলি করে, কুপিয়ে, পিটিয়ে ও নদীতে ডুবিয়ে হত্যা করা হয়। জনতা হানাদার বাহিনীর লেফট্যানেন্ট আতাউল্লা খানকে আটক করে।
এরপর তাকে শৈলকুপাতে এনে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। পরে তাকে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। এ যুদ্ধ জয়ের খবর ভারতীয় ও বিদেশি সংবাদ মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পায়।
গাড়াগঞ্জ সেতুর পাশে মহেশপুর গ্রামের বাসিন্দা মজিবর রহমান জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ২২ বছর। সেতুর দক্ষিণ পাশে গভীর খাদ কাটা হয়। আশপাশের লোকজন এ খাদ কাটে। গ্রাম থেকে বাঁশ কেটে এনে চাটাই বানানো হয়। আলকাতরা চাটাইয়ের উপর দেওয়া হয়। এতে বোঝার উপায় ছিল না এ পাকা রাস্তা নয়।
তিনি বলেন, দিন-রাত আনসার ও পুলিশ সদস্যরা বাংকারে বসে নজর রাখত। গ্রাম থেকে মানুষ খাবার এনে তাদের খাওয়াত। ৩০ মার্চ রাতে হঠাৎ খাদে গাড়ি পড়ার বিকট শব্দ পান। সামনের দুটি গাড়ি ফাঁদে পড়ে। বাকি সাত-আটটি গাড়ি দাঁড়িয়ে যায়। বাংকারে থাকা পুলিশ ও আনসার সদস্যরা গুলি চালাতে থাকে। এরমধ্যে হানাদাররা দুটি গোলা বর্ষণ করে। তারপর তারা থেমে যায়।
মজিবর রহমান বলেন, রাতের আঁধারে হাজার হাজার মানুষ ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে থাকে। সকাল হলে হাজার হাজার মানুষ পাকিস্তানি সেনাদের তাড়া করে। তারা পশ্চিমের দিকে দৌড়াতে থাকে। আর জনতা গুলি, কুপিয়ে, পিটিয়ে তাদের হত্যা করতে থাকে। কাউকে কাউকে পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করা হয়।
ওই যুদ্ধে অংশ নেওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা বলেন, জনতা ৭০ থেকে ৮০ জন পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যকে পিটিয়ে, কুপিয়ে, গুলি করে হত্যা করেছে। এতে জনতার মনোবল বেড়ে যায়।
গাড়াগঞ্জ যুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী উপজেলার মহেশপুর গ্রামের আমজাদ হোসেন জানান, তখন তিনি ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। লোকজন পাকিস্তানি সেনাদের ধাওয়া করে নিয়ে যায় মাইলমারি গ্রামে। সেখানে ২০-২২ জনকে হত্যা করা হয়।
তিনি বলেন, “একদল পাকিস্তানি সেনাকে নৌকায় উঠানো হয়। এরপর নৌকা ছিদ্র করে দেওয়া হয়। নৌকা ডুবে মারা যায় কয়েকজন সেনা।”
গাড়াগঞ্জ যুদ্ধের কমান্ডার ছিলেন বেড়বাড়ি গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা।
তিনি বলেন, সেতুর আশপাশে বাংকার তৈরি করে তারা তার ভেতর অবস্থান নিয়েছিলেন। রাত ৯টার দিকে হানাদার বাহিনীর সামনে থাকা দুটি গাড়ি ফাঁদে পড়ে। অন্য গাড়িগুলো সেতুর উপর দাঁড়িয়ে যায়। তারা দুটি কামানের গোলা ছুড়ে থেমে যায়।
“এরপর আমরা গুলি বর্ষণ করতে থাকি। ভোর হলে পাকিস্তানি সেনাদের খুঁজে খুঁজে বের করে মেরে ফেলা হয়। পাকস্তানি বাহিনী চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ৭০ থেকে ৮০ জন পাকিস্তানি সেনা এ যুদ্ধে নিহত হয়।”
স্বাধীনতার অনেক বছর পর মুক্তিযোদ্ধাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধ জয়ের স্মৃতি হিসাবে সেতুর পাশে বিজয় স্তম্ভ নির্মাণ করা হয় বলে জানান তিনি।
আরও পড়ুন:
৬৩ জনের গণকবর লুপ্ত, স্মৃতি বলতে ‘মানকচু’
মুক্তিযুদ্ধে ডাকরায় ছয় শতাধিক হিন্দুকে হত্যার স্মৃতি তাড়া করে আজও