জরাজীর্ণ গ্রন্থাগার-জাদুঘর, বীরশ্রেষ্ঠকে ‘স্মরণ’ কেবল মৃত্যুদিনে

“২০১৫-১৬ সালের পর থেকে লাইব্রেরিতে কোনো পাঠক আসেন না। লাইব্রেরির দুটি দরজার একটি খোলা যায় না; দেয়ালের অবস্থাও নাজুক।”

সাইদ মেমনবরিশাল প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 March 2024, 05:05 AM
Updated : 5 March 2024, 05:05 AM

দশটি বইয়ের আলমারির সঙ্গে দুটি টেবিল আর কয়েকটি চেয়ার। একটি আলমারিতে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের ব্যবহৃত একটি ব্যাগ, বালিশের কভার, একটি কাপ-প্লেট, মায়ের কাছে লেখা দুটি এবং মামার কাছে লেখা একটি চিঠি পড়ে আছে। 

ভেঙে গেছে গ্রন্থাগার চত্বরের চারপাশে লোহার বেষ্টনি; কিছু স্থানে আবার বেষ্টনি-ই নেই। নিয়মিত পরিষ্কার না করার কারণে ঝোপঝাড়ে ভরে রয়েছে; ভবনের ছাদের দেয়ালে জন্মেছে আগাছা। 

পরিচর্যার অভাবে জরাজীর্ণ দশা হয়েছে বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলায় বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগারের।  

১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদারের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। কেবল এ দিনটিতেই এখানকার মানুষ খুব ঘটা করে তাকে স্মরণ করে; সভা হয়। কখনো সরকারিভাবে আবার কখনো বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের উদ্যোগে। বছরের বাকি সময়ে কেউ আর তার খোঁজ রাখে না ।

আক্ষেপের সুরে কথাগুলো বলছিলেন, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের একমাত্র ছোট ভাই মঞ্জুর আহম্মেদ বাচ্চু।  

মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি হিসেবে যে সাত বীরকে মরণোত্তর বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল; তাদেরই একজন ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। সবচেয়ে কম বয়সী বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব পাওয়া এ বীরযোদ্ধা পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে চাঁপাইনবাবগঞ্জে যুদ্ধ করে শহীদ হন।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সীমান্তবর্তী ঐতিহাসিক সোনা মসজিদ চত্বরে রয়েছে তার সমাধি। মসজিদের পূর্ব আঙিনার দক্ষিণ পাশে বর্ণিল পাথরে বাঁধাই করা দুটি সমাধির একটি তার। মসজিদের দেয়ালের বাইরে নির্মাণ করা হয়েছে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর স্মৃতিসৌধ। এ ছাড়া বরিশালের বাবুগঞ্জে তার সম্মানে ইউনিয়নের নামকরণ করা হয়েছে ‘জাহাঙ্গীর নগর’ ইউনিয়ন।

মহিউদ্দিনের নামে স্মৃতি জাদুঘর আর গ্রন্থাগার নির্মাণ করা হলেও বীরদের শ্রেষ্ঠ এ সেনানীর স্মৃতি নিজ জেলায় উপেক্ষিত। এ বীর মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা নতুন প্রজন্মের কাছে জানাতে কোনো কর্মসূচি পালন করা হয় না নিজ গ্রামে কিংবা বরিশালেও। স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসের কোনো অনুষ্ঠানেও বিশেষ আয়োজন হয় না তাকে নিয়ে।

সব মিলিয়ে তার বীরত্বগাথা ইতিহাস জানাতে নতুন প্রজন্মের জন্য গড়ে তোলা বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর ধ্বংসের পথে। 

মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের ভাই বাচ্চু বলেন, “২০০৮ সালে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ১৬ বছরে মাত্র একবার চুন করা হয়েছে। উদ্বোধনের পর বরিশাল জেলা পরিষদ সহকারী লাইব্রেরিয়ান ও তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ দেয়। বেতনও দেওয়া হত জেলা পরিষদ থেকে। গত ১৬ মাস ধরে বেতন বন্ধ রয়েছে; তাই লোকবলের অভাবে গ্রন্থাগার ও জাদুঘর খোলা হয় না। 

“বেতন-ভাতার জন্য অন্তত ১০ বার জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের কাছে গিয়েছি। তারা দেই দিচ্ছি বলে জানিয়েছেন। কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি।” 

বরিশাল শহর থেকে ‍৩৫ কিলোমিটার দূরে বাবুগঞ্জ উপজেলার জাহাঙ্গীর নগর ইউনিয়নে মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগারের অবস্থান। বর্তমানে গ্রন্থাগারটির দেখভাল করছেন মো. সালাহউদ্দিন হাওলাদার। 

সালাহউদ্দিন বলছেন, তার বাবা হাজী সিদ্দিকুর রহমান হাওলাদার গ্রন্থাগারের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। ২০২২ সালের ২৯ মে তার মৃত্যুর পর থেকে তিনি তত্ত্বাবধায়ক ও সহকারী লাইব্রেরিয়ানের দায়িত্ব পালন করছেন।

“লাইব্রেরি দেখভালের পাশাপাশি স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে পড়াশুনা করছি। আমাকে তত্ত্বাবধায়ক পদে নিয়োগ দেওয়ার কথা থাকলেও এখনও পর্যন্ত হচ্ছে না।” 

তিনি বলেন, “২০১৫-১৬ সালের পর থেকে লাইব্রেরিতে কোনো পাঠক আসেন না। লাইব্রেরির দুটি দরজার একটি খোলা যায় না; দেয়ালের অবস্থা নাজুক আর আস্তরণে নোনা ধরেছে। 

“লাইব্রেরিতে ১ হাজার ৭৭৫টি বই ছিল, এখন আছে ১১০০-১২০০ রয়েছে। বই কে বা কারা নিয়েছে, তা আমি জানি না। বই হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে লাইব্রেরিও খুলি না।”   

জাহাঙ্গীর নগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কামরুল ইসলাম হিমু বলেন, “বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী পালনে সরকারি কোনো নির্দেশনা নেই; তাই আমরা পালন করি না। এজন্য পরিবারের উদ্যোগ প্রয়োজন। কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না। উদ্যোগ নিলে আমরা অবশ্যই থাকতাম।”

বীর এ যোদ্ধাকে নিয়ে কোনো কর্মসূচি পালন না হওয়ার বিষয়টিকে নিজের ব্যর্থতা দাবি করে ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, “আমাদের নৈতিক অবক্ষয় হয়েছে। তাই তার মৃত্যুবার্ষিকী ও জন্মবার্ষিকীতে আলোচনা সভা হয় না। তার সম্পর্কে অতকিছু জানিও না।” 

তিনি বলেন, “বীর এ যোদ্ধার স্ত্রী ও সন্তান নেই, যারা আছেন তারা তাকে নিয়ে কর্মসূচি পালনে তেমন আগ্রহী নয়। কয়েকদিন আগে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এসেছিলেন। তখন মহিউদ্দিনের পরিবার একটি বাসভবন করার বিষয় নিয়ে বেশি আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন।

“কিন্তু আমি তার কাছে গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর বর্ধিত এবং আধুনিকায়নের দাবি করেছি। এ ছাড়া এগুলোর সংস্কার এবং বেতন-ভাতা দেওয়ার দাবি করা হয়েছে।” 

গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরের পাশেই বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর মাধ্যমিক বিদ্যালয়। স্কুলটির নবম শ্রেণীর ছাত্রী বৃষ্টি বলে, “লাইব্রেরিতে এসেছিলাম। এখন তো বন্ধ থাকে।” 

স্কুলটির প্রধান শিক্ষক মো. আবুল কালাম বলেন, “প্রতি বছর আমরা বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের মৃত্যুবার্ষিকীতে স্কুলে অনুষ্ঠান করি। তাকে নিয়ে সেসময় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা হয়। তবে এ বীর মুক্তিযোদ্ধার বাড়ির সামনে যে যাদুঘর রয়েছে, সেটা আরও সমৃদ্ধ করতে হবে। তাহলে এখানে অনেক গুণীজন আসবেন, সাধারণ মানুষ আসবেন। তারা বীরশ্রেষ্ঠ সম্পর্কে জানতে পারবেন।” 

তিনি বলেন, দ্রুত এর সংস্কার কাজ শুরু হবে বলে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সচিব এসে জানিয়েছিলেন। 

এ জাদুঘরে আরও বই সংরক্ষণ করা উচিত মন্তব্য করে তিনি বলেন, “খুব অল্প বয়সে তিনি শহীদ হয়েছেন। তার তেমন কিছু ছিল না। যা ছিলো জাদুঘরে রয়েছে। আরও কিছু থাকলে, সেটাও সংরক্ষণ করা উচিত।”

বীর এ যোদ্ধা সম্পর্কে যা বলেন ভাই বাচ্চু 

মৌলভী আব্দুল মোতালেব হাওলাদারের সন্তান বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ১৯৪৯ সালের ৭ মার্চ বাবুগঞ্জ উপজেলার রহিমগঞ্জ গ্রামে জন্ম নেন। মহিউদ্দিন ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে (কাকুলে) জেন্টলম্যান ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের ১৭৩ ব্যাটালিয়ন ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে ছিলেন। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে আরও চার সেনা কর্মকর্তাকে নিয়ে ব্যাটালিয়ন থেকে পালিয়ে আসেন তিনি। 

পরে সীমান্ত পেরিয়ে তারা ভারতে প্রবেশ করেন। সেখান থেকে বাংলাদেশে এসে মেজর জেনারেল ওসমানীর সঙ্গে দেখা করেন। তিনি তাকে ৭ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব দেন। দায়িত্ব পেয়ে তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জে যুদ্ধ করেন। 

ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশ তখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে। ১৪ ডিসেম্বর ভোরে মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ও তার সহযোদ্ধাদের দলটি চাঁপাইনবাবগঞ্জের রেহাইচরের মধ্য দিয়ে মহানন্দা নদী পার হয়। তারা তখন অতর্কিত হামলা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর তিনটি ট্রেঞ্চ দখল করে নেন। চতুর্থটি দখল করার সময় শত্রুপক্ষের একটি গুলি গিয়ে মহিউদ্দিনের মাথায় বিদ্ধ হলে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। পরে ১৫ ডিসেম্বর সোনা মসজিদে তাকে দাফন করা হয়।  

মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের বরিশাল মহানগরের সাধারণ সম্পাদক এহসান রাব্বি বলেন, “বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর বরিশালবাসীর গর্ব। আমরা অনেকেই তার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীর দিন কবে তাও জানি না। এটা সত্যিই দুঃখজনক।” 

জাহাঙ্গীর নগর ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মো. হারুন অর রশিদ বলেন, “ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কার্যালয় করার জন্য জমি চেয়েছি। তারা খালের মধ্যে জমি দিয়েছে। যতটুকু টাকা পেয়েছিলাম, তা দিয়ে যতটুকু পেরেছি করেছি।” 

হারুন অর রশিদের অভিযোগ, “বীরশ্রেষ্ঠের ভাই বাচ্চুকে বিভিন্ন সময় বলেছি, কার্যালয় করার জন্য সহায়তা আনতে। কিন্তু তিনি উন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখেননি। তিনি সব সময় তাবলিগ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তিনি এক সময় নিজে উদ্যোগ নিয়ে মৃত্যুবার্ষিকীতে দোয়া মোনাজাতের আয়োজন করেছিলেন। বর্তমানে সামর্থ্য না থাকায় করেন না।” 

বীর মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন মানিক বীরপ্রতীক বলেন, “বরিশাল জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডের কমিটি নেই ২০১৪ সাল থেকে। যারা আছেন তাদের সিংগভাগ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি। তাই তাদের মধ্যে দুঃখ-বেদনাও কম; দায়িত্বও নেই। কিভাবে নিজেরা সুবিধা নেবে, তারা সেই সুযোগ খোঁজে।”

মহিউদ্দিন মানিক বলেন, “কোনো কিছু পরিবার থেকে শুরু করতে হয়। বীরশ্রেষ্ঠের পরিবার কোনো উদ্যোগ নেয় না। তারা যদি উদ্যোগ নিত তাহলে অবশ্যই মুক্তিযোদ্ধারা আসতেন।” 

বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর গ্রন্থাগারের বেতন-ভাতা প্রসঙ্গে বরিশাল জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডার ও জেলা প্রশাসক শহীদুল ইসলাম বলেন, “এটা পরিচালনার দায়িত্ব বরিশাল জেলা পরিষদের। বেতন-ভাতা তারা দেয়। যদি না দেয় তাহলে আমি প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে বলে ব্যবস্থা করব।” 

জানতে চাইলে বরিশাল জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর বলেন, “এটা অফিসিয়াল জিনিস। এটা নিয়ে যা করার, আমাকে করতে দিন।” 

আরও পড়ুন:

Also Read: একাত্তরে বরগুনা কারাগার হয়ে ওঠে গণহত্যা কেন্দ্র

Also Read: কুমার নদে গাড়াগঞ্জ যুদ্ধ: ফাঁদে ফেলে হত্যা করা হয় ৮০ হানাদারকে

Also Read: ৬৩ জনের গণকবর লুপ্ত, স্মৃতি বলতে ‘মানকচু’

Also Read: মুক্তিযুদ্ধে ডাকরায় ছয় শতাধিক হিন্দুকে হত্যার স্মৃতি তাড়া করে আজও