আনোয়ার উল আলম বেঁচে থাকার সময় নিজে দর্শনার্থীদের ঘুরে দেখাতেন জাদুঘরের বিভিন্ন স্মারক। ছবি দেখিয়ে বর্ণনা করতেন যুদ্ধদিনের ইতিহাস।
Published : 17 Mar 2024, 08:14 AM
টাঙ্গাইলে ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসমৃদ্ধ জাদুঘর দেখতে এসে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা ইতিহাসের নানা অধ্যায় জানতে পারছে।
ছবি, দলিল, স্মারক, বই এসবের মধ্য দিয়ে ইতিহাসপ্রেমি মানুষ মুক্তিযুদ্ধের জেলা পর্যায়ের নানা ঘটনার পাশাপাশি গৌরবোজ্জ্বল এই অধ্যায়ের জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কেও অবগত হচ্ছেন।
‘শহীদ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’ নামে প্রতিষ্ঠানটি তৈরি করেন সাবেক সচিব ও রাষ্ট্রদূত মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার উল আলম। প্রথমে টাঙ্গাইল শহরে পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এলাকায়, তার বাসভবনে এই জাদুঘর তৈরি করেছিলেন।
কিন্তু পারিবারিক কারণে জাদুঘরটি ওই স্থান থেকে শহরতলির এনায়েতপুরে স্থানান্তরের উদ্যোগ নেন। কিন্তু তিনি সেখানে নির্মাণকাজ শেষ করে যেতে পারেননি। ২০২০ সালের ৯ ডিসেম্বর তার মৃত্যুর পর পরিবারের সদস্যরা জাদুঘর নির্মাণের কাজ শেষ করেন।
জাদুঘরকে কেন্দ্র করে একদল তরুণ সংগঠিত হয়েছিলেন। তারাই এ জাদুঘরের কাজকে নানাভাবে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
এখানে যুদ্ধকালে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ, বিজয় অর্জনের পর বঙ্গবন্ধুর কাছে অস্ত্র জমা দেওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের আলোকচিত্র আছে। আরও রয়েছে, যুদ্ধকালীন ও বিজয়ের পর দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিবেদনের ছবি।
মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় মুক্তাঞ্চল থেকে আনোয়ারের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘রাণাঙ্গন’ পত্রিকার কপি, মুক্তাঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন দলিল, টাঙ্গাইল অঞ্চলে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেওয়া শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা, ভারতীয় বাহিনীর প্যারাস্যুট, মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে বিধ্বস্ত পাকিস্তানি জাহাজের অংশবিশেষসহ বিভিন্ন স্মারক।
যাত্রা শুরু
আনোয়ার উল আলম ২০০৬ সালে অবসর গ্রহণের পর টাঙ্গাইল শহরের পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পৈত্রিক ভিটায় দোতলা ভবন নির্মাণ করেন। এই ভবনের নিচ তলাতেই গড়ে তুলেছিলেন জাদুঘর। ২০১০ সালে সেটির উদ্বোধন করা হয়।
জাদুঘরটি যারা দেখতে আসতেন, তাদের বেশির ভাগই ছিলেন তরুণ প্রজন্মের; দেশ-বিদেশের অনেক বিশিষ্টজনও জাদুঘরটি পরিদর্শন করেছেন। আনোয়ার বেঁচে থাকার সময় নিজে দর্শনার্থীদের ঘুরে দেখাতেন জাদুঘরের বিভিন্ন স্মারক। ছবি দেখিয়ে বর্ণনা করতেন যুদ্ধদিনের ইতিহাস।
সরেজমিনে দেখা যায়, শহরতলির এনায়েতপুরে গ্রামীণ পরিবেশে একটি দোতলা বাড়ি। তার নিচতলার কক্ষগুলোতে সাজানো রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্ন। স্বাধীনতার আগে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত একুশের সংকলন, স্বাধীনতা আন্দোলন, মুক্তির সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি থেকে শুরু করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচার, নির্যাতনের চিত্র।
মহান উদ্যোগ
কাদেরিয়া বাহিনীর প্রশাসক বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু মো. এনায়েত করিম বলেন, আনোয়ার উল আলম শহীদ একজন প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা, কাদেরিয়া বাহিনীর বেসামরিক প্রধান। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে তিনি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
“এটি একটি মহান উদ্যোগ। শুধু যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করেই তিনি দায়িত্ব শেষ করেননি। আগামী প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরতে যুদ্ধকালীন অমূল্য আলোকচিত্র ও বিভিন্ন দলিল দিয়ে জাদুঘর গড়ে তুলেছেন। এই উদ্যোগ নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।”
টাঙ্গাইল থেকে আসা কলেজ শিক্ষার্থী আহসান খান মিলন (১৯) জাদুঘর প্রসঙ্গে বলেন, “এখানে এসে টাঙ্গাইলের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিবাহিনীর রণকৌশল, টাঙ্গাইলে মুক্তিবাহিনীর অবদানসহ অনেক বিষয় সম্পর্কে জানতে পেরেছি। এই জাদুঘরের আরও প্রচার হওয়া উচিত।”
কালিহাতী থেকে আসা দর্শনার্থী রকিবুল হাসান রায়হান (২১) বলেন, “আমার খুব ভাল লাগছে জাদুঘর দেখে, টাঙ্গাইলে এমন জাদুঘর আছে অনেকেই জানেন না। এই জাদুঘর টাঙ্গাইলের ইতিহাস সংরক্ষণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
জাদুঘরের প্রধান সমন্বয়ক মুঈদ হাসান তড়িৎ বলেন, “যে কেউ এই জাদুঘর পরিদর্শন করতে পারেন। ২০১০ সালে জাদুঘর প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৫ হাজারের বেশি দর্শনার্থী জাদুঘরটি পরিদর্শন করেছেন; এটিই টাঙ্গাইলের প্রথম জাদুঘর।
“টাঙ্গাইল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, মুক্তিযোদ্ধাদের চিঠি, দলিল, তৎকালীন সময়ের পত্রিকা, মিত্র বাহিনীর ব্যবহৃত প্যারাসুট, জাহাজের অংশ, টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর মুখপত্র রনাঙ্গণ পত্রিকার কপি ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাসহ মুক্তিযুদ্ধের বিস্তারিত ইতিহাস জাদুঘরটিতে সংরক্ষিত আছে।”
ডা. সাঈদা খান পাঠাগার
এ ছাড়া জাদুঘরের পাশেই প্রায় ১০ হাজার বই সমৃদ্ধ ডা. সাঈদা খান পাঠাগার রয়েছে বলে জানান মুঈদ হাসান তড়িৎ। এখানে নিয়মিত বই পড়ার ব্যবস্থার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধা ও নতুন প্রজন্মের সমন্বয়ে নিয়মিত পাঠচক্র, মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনা ও বিভিন্ন দিবসে নানা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়।
তিনি বলেন, “ভবিষ্যতে টাঙ্গাইলের বিভিন্ন স্থানে জাদুঘরটির ভ্রাম্যমাণ প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হবে।”
খুব কাছ থেকে আনোয়ার উল আলম শহীদের সান্নিধ্য পেয়েছেন জাদুঘরের স্বেচ্ছাসেবক টিম লিডার মির্জা তৌহিদুল ইসলাম সুলভ। তার কাছ থেকেই নিয়মিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শুনতেন, এরপর থেকেই জাদুঘরের সঙ্গে যুক্ত বলে জানান।
তিনি বলেন, “স্যার নেই। কিন্তু আমরাও এখন নতুন প্রজন্মকে জাদুঘরে সংরক্ষিত বিভিন্ন ইতিহাস জানাই।”
আগামী প্রজন্ম টাঙ্গাইল মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানবে, আনোয়ার উল আলম শহীদের মত দেশপ্রেমিকদের বীরত্বগাথা জানবে- এটাই জাদুঘর প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য, বলছেন জাদুঘরটির ট্রাস্টি ডা. সাঈদা খান।
তিনি বলেন, আনোয়ার উল আলম বলতেন, দেশটাকে সমৃদ্ধির পথে, প্রগতির পথে এগিয়ে নিতে হলে সবাইকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে হবে। নতুন প্রজন্ম যাতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে পারে, সেই চিন্তা থেকে তিনি এ জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেছেন।
আনোয়ার উল আলম টাঙ্গাইল জেলা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের একজন নেতা হিসেবে স্বাধীনতা-পূর্ব বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। যুদ্ধ শেষে তিনি বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে পরিচালক হিসেবে রক্ষী বাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর রক্ষী বাহিনীকে সেনাবাহিনীতে একীভূত করা হয়। আনোয়ার উল আলম শহীদ সেনাবাহিনীতে লেফট্যানেন্ট কর্নেল হিসেবে একীভূত হন। পরে তিনি কর্নেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন।
১৯৭৮ সালে তার চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়। কূটনীতিক হিসেবে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ মিশনে দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ তিনি স্পেনের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। চাকরিজীবনে যেখানে গেছেন, সেখানেই নিয়ে গেছেন মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দুর্লভ ছবি, যুদ্ধকালীন নানা দলিল-দস্তাবেজ।
আরও পড়ুন:
মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিতে আদমজীর ‘যমঘর’
‘ময়না প্রতিরোধ যুদ্ধের’ পর পুরো নাটোর হয়ে ওঠে ‘বধ্যভূমি’
শূন্যরেখা ঘেঁষা নাকুগাঁও বধ্যভূমি, বিলীনের পথে গণহত্যার স্মৃতি
বিলোনিয়া যুদ্ধ: ইতিহাস ‘জানে না’ শিক্ষার্থীরা, নেই উদ্যোগও
১৯৭১: বহলায় একসঙ্গে ৪২ জনকে হত্যা করে হানাদাররা
১৯৭১: কাইয়ার গুদামে হত্যার পর লাশ ফেলা হত কুশিয়ারায়
বাবুর পুকুর গণহত্যা: মেলেনি স্বীকৃতি-ভাতা, ভেঙে পড়ছে স্মৃতিস্তম্ভ
‘সদ্য বাবা হলে যে আনন্দ, বিজয়ের খবর ছিল তার চেয়েও আনন্দের’
রাজাকারে ধরে নেয় দুই ভাইকে, তাড়নায় যুদ্ধে যান ১৩ বছরের স্বপন
১৯৭১: তীর-ধুনক নিয়েই রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও
১৯৭১: পানপট্টির সম্মুখ যুদ্ধে মুক্ত হয়েছিল পটুয়াখালী
জরাজীর্ণ গ্রন্থাগার-জাদুঘর, বীরশ্রেষ্ঠকে ‘স্মরণ’ কেবল মৃত্যুদিনে
একাত্তরে বরগুনা কারাগার হয়ে ওঠে গণহত্যা কেন্দ্র
কুমার নদে গাড়াগঞ্জ যুদ্ধ: ফাঁদে ফেলে হত্যা করা হয় ৮০ হানাদারকে
৬৩ জনের গণকবর লুপ্ত, স্মৃতি বলতে ‘মানকচু’
মুক্তিযুদ্ধে ডাকরায় ছয় শতাধিক হিন্দুকে হত্যার স্মৃতি তাড়া করে আজও