১৯৭১: বহলায় একসঙ্গে ৪২ জনকে হত্যা করে হানাদাররা

বিজয়ের তিন দিন আগে দিনাজপুরে হত্যার শিকার ৪২ জনের পরিবার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছে।

দিনাজপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 March 2024, 03:27 AM
Updated : 12 March 2024, 03:27 AM

১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় গ্রামের ধর্মপ্রাণ মানুষ মাগরিবের নামাজ পড়তে মসজিদে যাচ্ছিলেন। সেই সময় ৪২ জনকে ধরে একসঙ্গে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। 

বিজয়ের মাত্র তিন দিন আগে দিনাজপুরের বিরল উপজেলার বিজোড়া ইউনিয়নের বহলা গ্রামে নারকীয় এ হত্যাযজ্ঞ সেদিন পুরো জেলার মানুষকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের ৫৩ বছর পর আজও সেই স্মৃতি গ্রামবাসীকে তাড়িয়ে বেড়ায়। 

সেই থেকে ঘটনাটি সবার কাছে ‘বহলা ট্র্যাজেডি’ নামে পরিচিত। 

গ্রামবাসী জানায়, ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় দিনাজপুর থেকে বিরলগামী একটি ট্রেন বহলা গ্রামে পৌঁছায়। সেটি লক্ষ্য করে রকেট শেল নিক্ষেপ করেন মুক্তিযোদ্ধারা। এতে ওই ট্রেনে থাকা পাকিস্তানি সেনারা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। পরে স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় ওইদিন সন্ধ্যায় বহলা গ্রামে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি সেনারা। গ্রামটি প্রায় পুরুষশূন্য হয়ে পড়ে। 

সেদিনের ওই হত্যাকাণ্ডে শহীদ হন খলিল উদ্দিন। তার ছেলে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন জানান, সেই সময় তার বয়স ছিল ১২ বছর। ঘটনার দিন সন্ধ্যার আগে পাকিস্তানি সেনারা স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় গ্রামে প্রবেশ করেন। পরে পুরো গ্রাম ঘিরে ফেলে তারা। 

সেই সময় গ্রামের লোকজন কেউ বাইরে ঘোরাফেরা করছিলেন কেউবা মাগরিবের নামাজ পড়তে মসজিদে যাচ্ছিলেন। যাকে যেখানে পেয়েছে ধরে এনে রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যাযজ্ঞ চালায় তারা। 

আমজাদ হোসেন বলেন, পাকিস্তানি বাহিনী সেই ৪২ জনের লাশ তাদের বাড়ির কাছে খড় দিয়ে ঢেকে রেখে চলে যায়। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে গ্রামবাসী ফিরে এসে ঘটনাস্থলে একটি বড় গর্ত করে ৪২ জন শহীদের অর্ধগলিত লাশ মাটি চাপা দেয়। 

স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর ২০১৪ সালে সেই গণকবরের পাশে তৎকালীন নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর হস্তক্ষেপে একটি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয় বলে জানান তিনি। 

গণকবরটি চলতি বছর সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়ে কাজ শুরু করা হয়েছে। তবে হত্যার শিকার ৪২ পরিবার আজও রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদ পরিবারের স্বীকৃতি পায়নি বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ইউপি চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন। 

ওই হত্যাকাণ্ডে নিহত নূর মোহাম্মদের ছেলে তবিবুর রহমান, জয়নাল আবেদীনের ছেলে আজাহার, আমিন উদ্দিনের ছেলে মিজানুর রহমান জানান, বিজয়ের তিন দিন আগে তাদের পরিবারের এতগুলো মানুষকে হত্যা করা হলো অথচ রাষ্ট্র তাদের শহীদের স্বীকৃতি দিল না। 

ওই ৪২ জনকে শহীদ পরিবারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়ে দিনাজপুর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মকসেদ আলী মঙ্গলীয়া বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় এতবড় একটি বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ সেদিন সবাইকে কাঁদিয়েছিল। তবে স্বাধীনতার এত বছর পরও রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের কোনো স্বীকৃতি না পাওয়ায় সত্যি দুঃখজনক। 

আরও পড়ুন:

রাজাকারে ধরে নেয় দুই ভাইকে, তাড়নায় যুদ্ধে যান ১৩ বছরের স্বপন

১৯৭১: তীর-ধুনক নিয়েই রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও

১৯৭১: পানপট্টির সম্মুখ যুদ্ধে মুক্ত হয়েছিল পটুয়াখালী

মুক্তিযুদ্ধে ডাকরায় ছয় শতাধিক হিন্দুকে হত্যার স্মৃতি তাড়া করে আজও

৬৩ জনের গণকবর লুপ্ত, স্মৃতি বলতে ‘মানকচু’

কুমার নদে গাড়াগঞ্জ যুদ্ধ: ফাঁদে ফেলে হত্যা করা হয় ৮০ হানাদারকে

জরাজীর্ণ গ্রন্থাগার-জাদুঘর, বীরশ্রেষ্ঠকে ‘স্মরণ’ কেবল মৃত্যুদিনে

একাত্তরে বরগুনা কারাগার হয়ে ওঠে গণহত্যা কেন্দ্র