একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর সারা দেশে পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বিজয় অর্জিত হলেও নাটোরে বিজয় আসে পাঁচ দিন পর ২১ ডিসেম্বর।
Published : 15 Mar 2024, 09:03 AM
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই নাটোরের লালপুরের ময়না গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা-জনতা। এতে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করা হয়; শহীদ হন কয়েকজন বাঙালিও।
এর প্রতিশোধ নিতেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও দোসররা নয় মাস ধরে শত শত বাঙালিকে হত্যার মধ্য দিয়ে নাটোরকে বধ্যভূমি বানিয়ে তোলে। নাটোরে বড় ধরনের সামরিক আস্তানা তৈরি করে আশপাশের জেলাগুলোতে গণহত্যা পরিচালনা করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টাতেই হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আল বদররা নাটোর সদর উপজেলার ছাতনী, ফুলবাগান, দত্তপাড়া, মোহনপুর, লালবাজার, কাপুড়িয়া পট্টি, শুকলপট্টি, মলিকহাটি, বড়াইগ্রামের বনপাড়া ক্যাথলিক মিশন, গুরুদাসপুরের নাড়িবাড়ি, সিংড়ার হাতিয়ানদহ, কলম এবং লালপুর উপজেলার গোপালপুরের নর্থ বেঙ্গল সুগার মিল চত্বরে গণহত্যা চালায়।
এর মধ্যে সদর উপজেলার ছাতনী গ্রামের গণহত্যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে নৃশংস ও হৃদয়বিদারক ঘটনা। একাত্তরে রাজধানী ঢাকার পর নাটোর পাকিস্তানি সেনাদের ‘২ নম্বর সামরিক সদর দপ্তর’ ছিল বলে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা দাবি করেছেন।
তারা বলছেন, ১৬ ডিসেম্বর থেকে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে পাকিস্তানি সেনারা নাটোরে এসে জড়ো হতে থাকে। নাটোর পিটিআই স্কুল, আনসার হল, রিক্রিয়েশন ক্লাব, এনএস কলেজ, নাটোর রাজবাড়ী, দিঘাপতিয়া রাজবাড়ী চত্বরের (উত্তরা গণভবন) ক্যাম্পগুলোতে আশ্রয় নেওয়া পাকিস্তানিরা মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলেও নাটোরের দিঘাপতিয়া রাজবাড়ী চত্বরে আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয় ২০ ডিসেম্বর গভীর রাত পর্যন্ত।
নাটোরে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার নওয়াব আহমেদ আশরাফ মিত্রবাহিনীর ১৬৫ মাউনটেন ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার রঘুবীর সিং পান্নুর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ত্র সমর্পণ করেন।
ফলে ১৬ ডিসেম্বর বাঙালির বিজয় অর্জন হলেও পাঁচদিন পর অর্থাৎ ২১ ডিসেম্বর নাটোর পুরোপুরি শত্রুমুক্ত হয়।
ময়না যুদ্ধ ও আহমেদপুরে প্রতিরোধ
একাত্তরের ২৯ মার্চ পাকিস্তানি সেনারা রাজশাহী যাওয়ার পথে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। এদের একটি দল পথ ভুলে বনপাড়া হয়ে নাটোরের লালপুরের ময়না গ্রামে ঢুকে সৈয়দ আলীর বাড়ির মেয়েদের জিম্মি করে।
এ খবর ছড়িয়ে পড়লে নাটোর ও লালপুরসহ আশপাশের মুক্তিযোদ্ধা, পুলিশ, আনসারসহ সর্বস্তরের মানুষ ময়না গ্রামে গিয়ে পাকিস্তানিদের চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলে। তখন যুদ্ধ শুরু হয়। যা ইতিহাসে ‘ময়নার যুদ্ধ’ নামে পরিচিত।
নাটোরের লেখক, গবেষক ও ক্রীড়াবিদ খালিদ বিন জালাল বলেন, “আমি বলব, ময়নার যুদ্ধ নাটোরের একটা বড় বিজয়। পাকিস্তানিরা নগরবাড়ি থেকে রাজশাহীর দিকে আসছিল। তখন বনপাড়ার দিকে প্রতিরোধ দেখে তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ভেতরের রাস্তা দিয়ে গোপালপুর হয়ে রাজশাহী যাওয়ার চেষ্টা করে। তখন লালপুরের ময়না গ্রামে তাদের সঙ্গে প্রতিরোধ যুদ্ধ হয়।”
নাটোরে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের ফটকে বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আফসার উল্লাহ, ওমর আলী প্রমাণিক, হোসেন আলী, শফিউল আলম খান টিপুসহ অন্তত ১৩ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কথা হয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
শফিউল আলম খান টিপু বলেন, “নাটোরে আর্মি ঢুকতেই একটা প্রতিরোধ তৈরি হয়। নাটোরের বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার মানুষ সেই প্রতিরোধে অংশ নেয়। পাকিস্তানিদের আহমেদপুর ব্রিজ দিয়ে নাটোর ঢুকতে না দেওয়ার জন্য হাতুড়ি, কোদাল, শাবল নিয়ে বহু মানুষ প্রতিরোধে যান, আহমদেপুর ব্রিজ ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করেন। পাকিস্তানি সেনারা এই পথে না এসে ভুল করে বনপাড়া হয়ে লালপুর-গোপালপুরের রাস্তায় ঢুকে পড়ে।
“লালপুরের ময়না গ্রামে সাধারণ জনতা একটা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তখন হানাদার বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় চারজন জনতার হাতে আটক হন এবং গণপিটুনিতে নিহত হন।”
পাকিস্তানি ও বাঙালি হতাহতদের সংখ্যা নিয়ে মতভেদ থাকলেও ময়না গ্রামের শহীদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভে ১৬ জন বাঙালির নাম উল্লেখ করা আছে।
লেখক খালিদ বিন জালালও ১৬ জন শহীদের বিষয়টিকে সমর্থন দিয়েছেন।
শফিউল আলম খান টিপু বলেন, “ময়নার ঘটনায় প্রতিশোধ নিতে পাকিস্তানি সেনারা ৫ মে লালপুরের গোপালপুর নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলে ঢুকে মিলের তৎকালীন প্রশাসক আনোয়ারুল আজিমসহ ৪২ জন শ্রমিক-কর্মচারীকে গুলি করে হত্যা করে।”
নাটোরে থেকেই উত্তরবঙ্গে গণহত্যা
একাত্তরে নাটোর ছিল পাকিস্তানি সেনাদের ‘দুই নম্বর সামরিক সদর দপ্তর’। তৎকালীন ‘গভর্নর হাউজ’ যা বর্তমানে ‘উত্তরা গণভবন’; সেখান থেকে পুরো উত্তরবঙ্গে নিয়ন্ত্রণে রাখে হানাদার বাহিনী।
‘নাটোরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ বইয়ের লেখক খালিদ বিন জালাল বলেন, নাটোরে পাকিস্তানিদের বড় ক্যাম্প ছিল এনএস কলেজে। তাদের বড় বড় কর্মকর্তা থাকতেন উত্তরা গণভবনে। এ ছাড়া রাজবাড়ী, আনসার হল, পিটিআই, দিঘাপতিয়া স্কুল ছাড়া শহরের বিভিন্ন জায়গায় ক্যাম্প থেকে নাটোরের আশপাশের জেলাগুলোতে সেনাদের পরিচালনা করা হত।
বাবার কাছ থেকে শোনা ঘটনার বরাত দিয়ে নাটোরের প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রমজান আলী প্রমাণিকের ছেলে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের জেলার যুগ্ম আহ্বায়ক মো. রফিকুল ইসলাম নান্টু বলেন, “পাকিস্তানি বাহিনী নাটোরে রাজা-বাদশার মত থেকেছে। যা ইচ্ছা তাই করেছে। তাদের ক্যাম্পগুলোতে বাইরে থেকে বাঙালিদের ধরে এনে নির্যাতন চালানো হত। অনেককে গুম করে দেওয়া হত।”
কোথায়-কীভাবে গণহত্যা
নাটোরের লেখক, গবেষক খালিদ বিন জালাল বলেন, “সদর উপজেলার ছাতনীতে জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষদের ধরে নিয়ে এসে ভোরে ফজরের আজানের আগে হত্যা করত পাকিস্তানি সেনারা। গণহত্যা নাটোর শহরের একাধিক স্থানে চালানো হয়েছে। এসব হত্যা বেশিরভাগ সময়ই গোপনে করা হত।”
খালিদ বলছিলেন, “নির্যাতন-নিপীড়ন ও ধর্ষণের ঘটনা অনেক ঘটেছে নাটোরে পাকিস্তানি হানাদারদের ক্যাম্পগুলোতে। যারা নাটোরে ছিলেন তাদের জীবন শতভাগ অনিরাপদ ছিল। এই মুহূর্তে বেঁচে আছে, পর মুহূর্তে বেঁচে থাকবে কি-না এর কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। রাত্রিতে কুকুর ডাকলে, পোটকা ফুটলে, গোলমালের শব্দ, কান্নাকাটি শুনলে মানুষ বিচলিত হয়ে যেত। দারুণ বিচলিত হয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে জঙ্গলে গিয়ে থাকতেন। নারীদের ধরে নিয়ে সেনাবাহিনী তাদের বাঙ্কারে আটকিয়ে রাখত। গ্রামে ঢুকে এটা ওটা চেয়ে নারীদের খোঁজ করত।”
তিনি বলেন, “একাত্তরের নাটোরে তখন খুব লুটপাট চলছে। লুটের মালও লুট হতে দেখেছি আমি। লুটের সূচনা প্রথম করে বিহারিরা। এরপর বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে নাটোরে লুটপাট করা হতো। যে যাই বলুক না কেন, আমার দেখা, নাটোরের বেশিরভাগ লোকই বাড়ি ফেলে চলে গিয়েছিলেন। চোর-চোট্টার জন্য প্রত্যেকটা বাড়ির দরজা খোলা থাকতো।”
বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. নজরুল ইসলাম বলেন, “দত্তপাড়ার পতেঙ্গাপাড়ায় স্থানীয়দের পাশাপাশি বাইরে থেকে ট্রাকে ভরে ভরে মানুষ এনে ব্রাশফায়ার করে মারছে। সেসব ট্রাকে লাশও আনা হত। প্রায় ৩০০ মানুষকে পতেঙ্গাপাড়ায় হত্যা করা হয়েছে। আহমেদপুর ব্রিজ, যেটা যুদ্ধের শুরুতে স্থানীয়রা গুড়িয়ে দিতে গিয়েছিল সেখানেও শতাধিক মানুষের ওপরে গণহত্যা চালানো হয়।”
তার ভাষ্য, “নাটোর ডাল সড়কের পরে জয় বাংলার হাটেও শতাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়।
“নাটোরের ফুলবাগান, খোলাবাড়িয়া, গুরুদাসপুরের নারীবাড়ি, বড়াইগ্রামের বনপাড়া ও জোনাইল, সিংড়ার কলমে গণহত্যা চালানো হয়। পুরো নাটোরই ছিল বধ্যভূমি। পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণে থাকায় নির্বিচারে পাকিস্তানি সেনার হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, ইচ্ছা হলেই মানুষ মেরে ফেলছে। নাটোরে আনুমানিক ১০ হাজার মানুষকে হত্যা করেছে হানাদার বাহিনী।”
২১ ডিসেম্বর নাটোর মুক্ত
১৬ ডিসেম্বর সারাদেশে পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বিজয় অর্জিত হলেও নাটোরে এর পাঁচ দিন পর ২১ ডিসেম্বর বিজয় আসে।
বাবার কাছ থেকে শোনা ঘট্নার বরাতে নাটোর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের যুগ্ম আহ্বায়ক রফিকুল ইসলাম বলেন, ১৬ ডিসেম্বর থেকে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে পাকিস্তানি সেনারা নাটোরে এসে জড়ো হতে থাকে। নাটোর পিটিআই স্কুল, আনসার হল, রিক্রিয়েশন ক্লাব, এনএস কলেজ, নাটোর রাজবাড়ী, দিঘাপতিয়া রাজবাড়ী চত্বরের (উত্তরা গণভবন) ক্যাম্পগুলোতে আশ্রয় নেওয়া হানাদাররা মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলেও নাটোরের দিঘাপতিয়া রাজবাড়ী চত্বরে আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হতে সময় গেলে যায় ২০ ডিসেম্বর গভীর রাত পর্যন্ত।
ফলে ২১ ডিসেম্বর নাটোর পুরোপুরি শত্রুমুক্ত হয়।
আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার নওয়াব আহমেদ আশরাফ মিত্রবাহিনীর ১৬৫ মাউনটেন ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার রঘুবীর সিং পান্নুর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ত্র সমর্পণ করেন।
এদিন পাকিস্তানি বাহিনীর ১৫১ অফিসার, ১৯৮ জন জেসিও, ৫ হাজার ৫০০ সেনা, ১ হাজার ৮৫৬ জন আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য এবং নয়টি ট্যাংক, ২৫টি কামান ও ১০ হাজার ৭৭৩টি ছোট অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে বলে জানান রফিকুল ইসলাম।
আরও পড়ুন
শূন্যরেখা ঘেঁষা নাকুগাঁও বধ্যভূমি, বিলীনের পথে গণহত্যার স্মৃতি
বিলোনিয়া যুদ্ধ: ইতিহাস ‘জানে না’ শিক্ষার্থীরা, নেই উদ্যোগও
১৯৭১: বহলায় একসঙ্গে ৪২ জনকে হত্যা করে হানাদাররা
১৯৭১: কাইয়ার গুদামে হত্যার পর লাশ ফেলা হত কুশিয়ারায়
বাবুর পুকুর গণহত্যা: মেলেনি স্বীকৃতি-ভাতা, ভেঙে পড়ছে স্মৃতিস্তম্ভ
‘সদ্য বাবা হলে যে আনন্দ, বিজয়ের খবর ছিল তার চেয়েও আনন্দের’
রাজাকারে ধরে নেয় দুই ভাইকে, তাড়নায় যুদ্ধে যান ১৩ বছরের স্বপন
১৯৭১: তীর-ধুনক নিয়েই রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও
১৯৭১: পানপট্টির সম্মুখ যুদ্ধে মুক্ত হয়েছিল পটুয়াখালী
জরাজীর্ণ গ্রন্থাগার-জাদুঘর, বীরশ্রেষ্ঠকে ‘স্মরণ’ কেবল মৃত্যুদিনে
একাত্তরে বরগুনা কারাগার হয়ে ওঠে গণহত্যা কেন্দ্র
কুমার নদে গাড়াগঞ্জ যুদ্ধ: ফাঁদে ফেলে হত্যা করা হয় ৮০ হানাদারকে
৬৩ জনের গণকবর লুপ্ত, স্মৃতি বলতে ‘মানকচু’
মুক্তিযুদ্ধে ডাকরায় ছয় শতাধিক হিন্দুকে হত্যার স্মৃতি তাড়া করে আজও