যুদ্ধের সময় বাবার মৃত্যুর খবর পেয়েও সঠিক সময় বাড়ি পৌঁছাতে না পারায় জানাজা ও কবর দিতে পারেননি লালমনিরহাটের এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।
Published : 09 Mar 2024, 11:39 AM
পরাধীনতা থেকে মুক্তির রক্তক্ষয়ী দীর্ঘ লড়াইয়ের মধ্যে যখন চূড়ান্ত বিজয়ের খবর এল, আজিজুল হকের কপোল বেয়ে তখন ঝরছিল আনন্দ অশ্রু; সহযোদ্ধাদের নিয়ে ফেটে পড়েন বাঁধভাঙা উল্লাসে।
বছরের পর বছর ধরে অত্যাচার-নিপীড়ন আর নয় মাস ধরে চালানো নৃশংসতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এমন দিনের অপেক্ষাতেই ছিলেন তারা।
নিজ মাটিতে খুঁটি গেড়ে একটি স্বাধীন পতাকা ওড়ানোর যে লড়াইয়ে জীবন বাঁজি রেখেছিলেন, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে বিজয়ের সেই খবরে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন লালমনিরহাটের এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।
সেই মুহূর্তের স্মৃতিচারণ করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে আজিজুল হক বলেন, “আনন্দ প্রকাশের ভাষা ছিল না। একজন নবজাতকের জন্মে পিতা যেমন আনন্দ পায়, তার চেয়ে বেশি আনন্দের ছিল মুহূর্তটি। দীর্ঘ যুদ্ধ, এত ত্যাগ, রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন দেশ পেলাম; এর চেয়ে বড় আনন্দ আর কিছু হতে পারে না।
“মুক্তিযুদ্ধের বিজয় আমাদের পতাকা দিয়েছে, মানচিত্র দিয়েছে, সার্বভৌমত্ব দিয়েছে।”
মুক্তিযুদ্ধে ৬ নম্বর সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করেন আজিজুল হক। বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের স্বীকৃতি হিসেবে ‘বীর প্রতীক’ খেতাব পাওয়া এই মুক্তিযোদ্ধা এখন থাকছেন লালমনিরহাট পৌর এলাকায় নিজ বাড়িতে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপে মুক্তিযুদ্ধে লড়াইয়ের ঘটনাপ্রবাহ ও বিজয় অর্জনের স্মৃতিচারণ করেছেন তিনি।
আজিজুল হক জানান, ১৯৭১ সালে রংপুর ইপিআরের ১০ নম্বর উইংয়ের সঙ্গে যুক্ত মুজাহিদ বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন তিনি। মার্চ মাসের মাঝামাঝিতে এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে লালমনিরহাট শহরে নিজ বাড়িতে যান। দশ দিনের মাথায় শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। তখন তিনি যুদ্ধে যোগ দেওয়ার চিন্তা শুরু করেন।
“সচেতন মানুষ হিসেবে বাঙালির মুক্তি কতটা জরুরি তা অনুভব করতে পেরেছিলাম। তাই স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে চাওয়া ছাত্র ও তরুণদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করি।”
সে সময় লালমনিরহাট হাই স্কুল মাঠে প্রায় অর্ধশত ছাত্র ও যুবককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ৩ এপ্রিল ফুলবাড়িয়া থেকে আসা অবাঙালি ইপিআরদের ছয়জনের একটি দলের সঙ্গে বাঙালি ইপিআর সদস্যদের যুদ্ধ হয় বর্তমান ইউএনও অফিসের সামনে। তাতে লুৎফুর রহমান নামে একজন বাঙালি ইপিআর সদস্য শহীদ হন। তিনি ছিলেন লালমনিরহাটের প্রথম শহীদ।
আজিজুল বলেন, অবাঙালি ইপিআর সদস্যরা শহর থেকে কিছুদূরে, বর্তমান বিজিবি ক্যাম্পের পার্শ্ববর্তী বড় মাঠের কাছে গেলে জনতা তাদের ঘেরাও করে। সেখানে ইপিআর সদস্যরা অস্ত্র নিয়ে মারমুখী অবস্থান নেয়। তবে তারা কোনো নিয়মিত বাহিনীর সদস্যদের কাছে আত্মসমর্পণ করবে রাজি হয়।
খবর পেয়ে তিনিসহ কয়েকজন সেখানে গেলে অবরুদ্ধ অবাঙালি ইপিআর সদস্যরা আত্মসমর্পণ করেন। তবে বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে সেখানে পাঁচজন নিহত হয়।
আজিজুল হক যুদ্ধ করেন ৬ নম্বর সেক্টরে। এই সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন নওয়াজিশ উদ্দিন। সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টরের অধীনে ফুলবাড়ী-ভুরুঙ্গামারী-উলিপুর এলাকায় যুদ্ধ করার জন্য আজিজুলকে কোম্পানি কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়।
তিনি বলেন, ক্যাপ্টেন নওয়াজিশ নভেম্বরে নাগেশ্বরী-ভুরুঙ্গামারী সড়কের সন্তোষপুরের পার্শ্ববর্তী স্থানে রাস্তা ধসিয়ে দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশ দেন। রেকি ও অন্যান্য প্রস্তুতি শেষে ১৪ নভেম্বর সন্তোষপুরের কাছে সড়ক ধ্বংস করে দেন তারা।
“১৬ নভেম্বর সকালে সন্তোষপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর দুজন সশস্ত্র সেনা সদস্যকে দেখতে পাই। পরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদের ধরে ফেলি। তাদের একজনের নাম আতা মোহাম্মদ, ৪৮ ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টের সৈনিক। অন্যজন সেপাই আসলাম খান নেওয়াজি। তারা ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সদস্য ছিলেন।”
ওই দুই সৈন্যকে যুদ্ধবন্দি হিসেবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে সোপর্দ করা হয়। এ ঘটনায় সাব-সেক্টর কমান্ডার প্রথমে রাগ করলেও পরে বুদ্ধি ও কাজের প্রশংসা করেন বলে জানান আজিজুল।
স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব ও সাহসিকতার স্বীকৃতিতে আজিজুল হককে ‘বীর প্রতীক’ খেতাব দেয় বাংলাদেশ সরকার।
তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল বাবা-মা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে ভারতের জলপাইগুড়িতে নিজেদের পুরনো বাড়িতে যান। কিন্তু সেসময় ফলন ভালো না হওয়াসহ নানা সংকটে ভারতে খুব কষ্ট ছিল। পরে বাবা-মাকে আত্মীয়ের বাড়িতে রেখে সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টর হেডকোয়ার্টার্সে যোগ দেন। সেখানে এক মুক্তিযোদ্ধাকে প্রশিক্ষণ দেন।
ওই সময় মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টর পরিদর্শনে গেল আজিজুলসহ অন্য মুক্তিযোদ্ধারা তাকে গার্ড অব অনার দেন।
যুদ্ধের সময় বাবার মৃত্যুর খবর পেলেও সঠিক সময়ে পৌঁছাতে না পেরে দাফনে অংশ নিতে পারেননি আজিজুল।
মুক্তি সংগ্রামের এত বছর পর স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্য কতটুকু অর্জন হয়েছে– এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের বিজয় আমাদের পতাকা দিয়েছে, মানচিত্র দিয়েছে, সার্বভৌমত্ব দিয়েছে। সব নাগরিককে এখন দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এখনো অনেক স্বাধীনতাবিরোধী রয়েছে; যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে।
“দেশ থেকে দুর্নীতি, অপরাধ আরো কমিয়ে আনতে হবে, তবেই সফলতা পাওয়া যাবে এবং ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ে উঠবে। আর এজন্য তরুণ ও আগামী প্রজন্মের এগিয়ে আসা উচিৎ।”
আজিজুল হকের জন্ম ১৯৪৫ সালে। তার বাবা ছখি উদ্দিন আহমেদ এবং মাতা আছিয়া খাতুন। ব্যক্তি জীবনে তার স্ত্রী, এক মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে।