বাবুর পুকুর গণহত্যা: মেলেনি স্বীকৃতি-ভাতা, ভেঙে পড়ছে স্মৃতিস্তম্ভ

১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু স্বাক্ষরিত চিঠিতে আত্মদানকারী শহীদদের ‘বীর’ আখ্যায়িত করে প্রত্যেকের পরিবারকে দুই হাজার টাকা দেওয়া হয়।

জিয়া শাহীনবগুড়া প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 March 2024, 03:57 AM
Updated : 10 March 2024, 03:57 AM

মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫৩ বছর পেরিয়ে গেলেও বগুড়ার বাবুর পুকুর বধ্যভূমিতে শায়িত ১৪ শহীদের ১২ জনের পরিবার কোনো স্বীকৃতি পায়নি।

অথচ ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত চিঠিতে তাদের আত্মদানকে ‘বীর’ হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রত্যেকের পরিবারকে দুই হাজার টাকা দেন।

বগুড়া শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে শাজাহানপুর উপজেলার বগুড়া নাটোর মহাসড়ক লাগোয়া বাবুর পুকুর বধ্যভূমিটি অবস্থিত।

সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বধ্যভূমির ফটক বন্ধ থাকলেও পকেট গেইটটি খোলা। সেখানে গরু, ছাগল ও কুকুরের অবাধ বিচরণ।

বধ্যভূমির প্রাচীর এখন ব্যবহার হচ্ছে স্থানীয়দের কাপড় শুকানোর কাজে। পাশেই বিশাল পুকুর। বধ্যভূমি থেকে একটি সিঁড়িও নেমে গেছে পুকুরে।

পুকুর পাড়ে মাছচাষির একটি ছোট্ট খুপরি ঘর। আগে সেখানে কোনো ঘরবাড়ি না থাকলেও এখন তিনটি বাড়ি এবং একটি হিমাগার তৈরি হয়েছে। এলাকাটি নির্জন। সব সময় সুনশান নিরবতা বিরাজ করে। রাতে শুধু মাছচাষির সেই খুপরি ঘরটি আলোকিত থাকে। কিন্তু আলো নেই বধ্যভূমিতে। বধ্যভূমির দেওয়ালের কিছু অংশ ভেঙে পড়েছে।

ভেঙে পড়েছে কবরের সানবাঁধা মেঝেও। সেখানে গিয়েও দেখা মেলেনি বধ্যভূমির দেখভালের কোনো লোকজন। বগুড়া জেলা পরিষদ নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ এবং বধ্যভূমিতে শায়িতদের একটি তালিকা ঝুলানো রয়েছে।

সেখানে ১৩ জনের নাম উল্লেখ এবং একজন অজ্ঞাত লেখা রয়েছে। তারা হলেন- ন্যাপকর্মী ওয়াজেদুর রহমান টুকু, ছাত্র ইউনিয়ন বগুড়া জেলা শাখার তৎকালীন সভাপতি মাহফুজুর রহমান ওরফে মান্নান, তার ছোট ভাই ছাত্র ইউনিয়ন নেতা আব্দুল হান্নান, ছাত্রলীগ নেতা মোফাজ্জল হোসেন আবুল, সাইফুল ইসলাম, আব্দুস সবুর, ফজলুর রহমান, আলতাফ হোসন, বাদশা শেখ, শহীদ নুরজাহান লক্ষ্মী, বাচ্চু শেখ, আব্দুল কুদ্দুস মন্টু, তার ভাই জালাল উদ্দিন।

১৯৭২ সালের ১২ অগাস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শহীদ প্রত্যেক পরিবারের স্বজনদের দুই হাজার টাকার চেক প্রদান করেন।

সেই চিঠিতে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, “আমি গভীর দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, আমার আন্তরিক সমবেদনা। আপনার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতিও রইল আমার প্রাণঢালা সহানুভূতি। এমন নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক পিতা, পুত্র, স্বামী, মা, স্ত্রী হওয়ার গৌরব লাভ করে সত্যি আপনি ধন্য হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে আপনার পরিবারের সাহার্যার্থে ২ হাজার টাকার চেক প্রেরিত হলো চেক নম্বর- মিত্র ০০২৯৯৮। আমার প্রাণভরা ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা নিন।”

বাবুর পুকুর গণহত্যা

একাত্তরের নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে তুমুল লড়াই শুরু হলে ঠনঠনিয়া এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা এলাকার রাজাকারদের নির্মূলের পরিকল্পনা করেন।

মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত হওয়ার খবর এলাকার ‘শান্তি কমিটির’ লোকজনের কাছে পৌঁছে যায়। নিজেদের রক্ষায় তারা মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের সহায়তাকারীদের নির্মূলের পাল্টা ছক কষে। তারই ধারাবাহিকতায় ১১ নভেম্বর গভীর রাতে রমজান মাসের সেহেরির খাওয়ার মুহূর্তে তাদের দেখিয়ে দেখা পথ অনুসরণ করে কয়েকশ পাকিস্তানি সেনা চারদিক থেকে ঠনঠনিয়ার শহীদ নগর, পশারীপাড়া, শাহ্পাড়া ও তেতুলতলা এলাকা ঘিরে ফেলে। ততক্ষণে সেহরি খাওয়া শেষ।

অনেকেই ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ঠিক সেই সময় পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা ওই এলাকার টেলিফোন অপারেটর নূরজাহানসহ একে একে আরও ২০ জনকে বাড়ি থেকে হাত ও চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে যায়।

তাদেরকে জিপে ও ট্রাকে তুলে বাবুর পুকুরের সড়কে নিয়ে লাইনে দাঁড় করায়। এরপর দুই কিশোর ও পাঁচ বৃদ্ধকে ছেড়ে দিয়ে বাকি ১৪ জনকে পুকুরের পাড়ে নিয়ে একে একে গুলি করে হত্যা করে। শহীদ ১৪ জনের মধ্যে ১৩ জনের নাম জানা গেছে।

বাবুর পুকুর গণহত্যায় শহীদ হন মোফাজ্জল হোসেন আবুল। তার ছোট ভাই আশরাফ আলী সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী।

তিনি বলছিলেন, “আমার ভাই ও আমাকে হাত-চোখ বেঁধে জিপ গাড়িতে উঠানো হয়। তারপর নিয়ে যাওয়া হয় বাবুর পুকুর এলাকায়। সেখানে গিয়ে শিশু ও বৃদ্ধদের পৃথক করা হয়, তারপর ওই ১৪ জনকে লাইনে দাঁড় করে গুলি করে হত্যা করা হয়।”

আশরাফ আলী বলেন, “গুলি করার আগে আমার চোখে বাঁধা কাপড়টি খুলে গিয়েছিল। আমি সেই করুণ দৃশ্য দেখেছি।”

নিজে কীভাবে বেঁচে ফিরলেন জানতে চাইলে আশরাফ আলী বলেন, “পাকিস্তানি সেনারা অনেককেই ধরে নিয়ে এসেছিল, যাদের মধ্যে শিশু-কিশোর আর বৃদ্ধও ছিল। যুবকদের এক সারিতে দাঁড় করায় আর শিশু-বৃদ্ধদের আরেক পাশে।

“আমার যেহেতু বয়স কম ছিল সে কারণে আমাকে বৃদ্ধদের সঙ্গে রাখে। কিন্তু আমাদেরও চোখ বাঁধা ছিল। ১৪ জনকে ব্রাশফায়ার করার পর আমাদেরকে ছেড়ে দেয়। আমরা তখন বাড়ি ফিরে আসি। ভাইকে তো গুলি করে মেরেই ফেলছে।

আশরাফ আলী বলেন, শহীদ পরিবারের আমরা মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রীর কাছেও গিয়েছি, কিন্তু এখনও কোনো ফল হয়নি। ওই ১৪ শহীদদের মধ্যে শুধু শহীদ সাইফুল ইসলামকে গেজেটভুক্ত করা হয়েছে। আর কাউকেই গেজেটভুক্ত, স্বীকৃতি প্রদান এবং ভাতাও দেওয়া হয়নি।”

২৬ মার্চ এবং ১৬ ডিসেম্বর এলে শহীদ পরিবারের লোকদের নিয়ে কম্বল কিংবা কাপড় দেওয়া হয়। দেশের জন্য জীবন দিল তারা। কিন্তু তাদের আজও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকার দেওয়া হলো না বলে জানান তিনি।

বাবুর পুকুরের শহীদ ওয়াজেদুর রহমান টুকুর ৭৫ বছর বয়সি স্ত্রী লাইলী বেওয়া বলেন, “লেখ্যা কি হবি। কতদিন হয়া গেল। একসঙ্গে সাইফুল ভায়েকসহ ১৪ জনেক গুলি কইরা মারল। সাইফুল ভায়ের পরিবার ভাতা পায়, স্বীকৃতি পায়। আর আমরা পাই না। এখন মরাই যামু, শেখ হাসিনা যদি নিজে দ্যাখে তাই হবি। মন্ত্রী-এমপিরা খালি আশ্বাস দেয়।”

৮০ বছর বয়সি রাজেকা বেওয়া শহীদ ফজলুর রহমানের স্ত্রী। তিনি বলেন, “শেখ মুজিবুর রহমান চিঠি দিয়া টাকা পাঠাল একবার। ধইরা নিছিলাম ওডাই স্বীকৃতি। দেখলাম তারপর কতজন ক্ষমতা আইলো, গেল, আছে কিছুই হলো না। মধ্যে মধ্যে বাবুর পুকুর নিয়া যায় প্রশাসন। কম্বল, কাপড় দিয়া ভালো ভালো কথা কয়। তারপর আর কিছুই হয় না। শ্যাষ বয়সে ভাক্কা করার জন্যে আর বাবুর পুকুরে যেতে চাই না।”

১৫ বছর আগে বধ্যভূমির পাশে বাড়ি করেন ছামছুল হক। তিনি বলেন, বধ্যভূমির দেখাশোনার জন্য মাসে তিন হাজার টাকা দিত। এখন সেটি বন্ধ করে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে একজন গ্রাম পুলিশকে। আগে প্রতিদিন বধ্যভূমি পরিষ্কার করতাম। দেখভাল করতাম। এখন দায়িত্ব না থাকায় আর করি না। এখন গ্রাম পুলিশ অনুষ্ঠানের আগে এসে পরিষ্কার করে।

সেখানকার আরেকজন বাসিন্দা হাসনা বানু জানান, যেদিন তাদের হত্যা করা হয়েছে, সেদিন তাদের আত্মীয়-স্বজনরা এসে কবর জিয়ারত করেন। সরকার থেকে একবার কিংবা দুবার অনুষ্ঠান করলেও এরপর কাউকে দেখা যায় না। গ্রাম পুলিশকে দায়িত্ব দেওয়া হলেও তাকে দেখা যায় না। শুধু অনুষ্ঠানের আগে পরিষ্কার করে চলে যায়।

বগুড়া জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান সৈয়দ সার্জিল টিপু বলেন, জেলা পরিষদ থেকে বধ্যভূমির স্মৃতিস্তম্ভ করা হলেও এখন দেখভাল করে করে শাহজাহানপুর উপজেলার খরনা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। তবে স্মৃতিস্তম্ভের যতটুকু নষ্ট হয়েছে তা সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নেওয়া হবে দ্রুত।

খরনা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাজেদুর রহমান শাহীন বলেন, সরকারি পর্যায়ে দেখভাল করার কোনো লোক নিয়োগ নেই। পরিষদ থেকে নিজে টাকা দিয়ে দেখাশুনা করি। মাঝে মাঝে চৌকিদার দিয়েও খোঁজ নেয়।

বগুড়া জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক সভাপতি রুহুল আমিন বাবলু বলেন, “কতজন কতভাবে স্বীকৃতি নিল। কিন্তু বাবুর পুকুরের ঘটনা আলোচিত। সরকারিভাবে সৌধ নির্মাণ হয়েছে। অনুষ্ঠান হয় সেখানে। অথচ তারা কেন স্বীকৃতি পেল না এটা আমারও প্রশ্ন।”