শূন্যরেখা ঘেঁষা নাকুগাঁও বধ্যভূমি, বিলীনের পথে গণহত্যার স্মৃতি

এক বীর মুক্তিযোদ্ধা জানান, শহীদদের স্মরণে বধ্যভূমিতে একাধিকবার স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পদক্ষেপ নেওয়া হলেও বিএসএফের বাধার মুখে তা করা যায়নি।

মো. আব্দুর রহিম বাদলশেরপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 March 2024, 04:46 AM
Updated : 14 March 2024, 04:46 AM

স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরিয়ে গেলেও অযত্ন, অবহেলা আর নদী ভাঙনের মুখে বিলীন হতে চলেছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত শেরপুরের নাকুগাঁও বধ্যভূমি।

দীর্ঘদিন ধরে বধ্যভূমিটি সংরক্ষণের জন্য সরকারি উদ্যোগে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জোর দাবি স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও এলাকাবাসীর।

যদিও স্থানীয় এক বীর মুক্তিযোদ্ধা জানান, শহীদদের স্মরণে বধ্যভূমিতে একাধিকবার স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পদক্ষেপ নেওয়া হলেও ভারতের কিল্লাপাড়া বিএসএফ ক্যাম্পের বাধার মুখে তা করা সম্ভব হয়নি।

স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন বলছে, স্থান জটিলতার বিষয়ে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য এরই মধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বিকল্প একটি জায়গা দেখেও রাখা হয়েছে।

পাহাড়ি ভোগাই নদীর তীরে নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী নয়াবিল ইউনিয়নের নাকুগাঁওয়ে বধ্যভূমিটির অবস্থান।

১৯৭১ সালের ২৫ মে উপজেলার বর্তমানে নাকুগাঁও বিজিবির তল্লাশি চৌকি ও স্থলবন্দর এলাকা দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে যাওয়ার সময় শরণার্থীদের ওপর পাকিস্তানি বাহিনী বর্বরোচিত হামলা চালায়।

অতর্কিত হামলা চালিয়ে ঘণ্টা খানিকের মধ্যে হত্যা করা হয় অসংখ্য হিন্দু-মুসলিম নিরীহ মানুষকে। পরে নাকুগাঁওয়ে ভোগাই নদীর তীরে তাদের গণকবর দেওয়া হয়।

কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পরও এখানে গড়ে উঠেনি কোনো স্মৃতির মিনার। ফলে পাশ দিয়ে বয়ে চলা পাহাড়ি ভোগাই নদীর গর্ভে বিলীন হতে চলেছে বধ্যভূমিটি।

বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ শেরপুর জেলা ইউনিট কমান্ডের কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আ স ম নুরুল ইসলাম হিরো জানান, নালিতাবাড়ী উপজেলার নাকুগাঁও স্থলবন্দর সংলগ্ন ভারতের কিল্লাপাড়া বিএসএফ ক্যাম্পের সীমানা ঘেঁষে থাকা এই বধ্যভূমির বেশিরভাগ জায়গার পাশ দিয়ে বয়ে চলা পাহাড়ি খরস্রোতা ভোগাই নদী গর্ভে বিলীন হতে চলেছে। যে অংশটুকু অবশিষ্ট রয়েছে তাতেও খড়ের গাদা, জাংলা, ঝোপঝাঁড়, বাঁশঝাড়, স্থানীয়দের শৌচাগার রয়েছে। কিছু অংশ পরিণত হয়েছে গোচারণ ভূমিতে।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও এলাকাবাসী জানান, এখানে ১৯৭১ সালের ২৫ মে কত মানুষ গণহত্যা শিকার হয়েছে সেই পরিসংখ্যান আজো জানা যায়নি।

তবে, এদিন হানাদার বাহিনীর হামলায় বিএসএফের নয় সদস্য নিহত হওয়ার বিষয়টি জানা গেছে। ভারতীয় অংশে কিল্লাপাড়া বিএসএফ ক্যাম্প ও নিহত বিএসএফ সদস্যদের স্মরণে নদীর ভাঙন থেকে রক্ষা করতে কংক্রিটের পাইলিং করে তীর রক্ষা বাঁধ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেছে ভারতীয়রা।

শুধু অবহেলায় পড়ে আছে স্বাধীন বাংলাদেশের গৌরবের স্মৃতি।

ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে নাকুগাঁও বধ্যভূমিতে অনতিবিলম্বে স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপনের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় বাসিন্দারা।

শহীদ প্রজন্ম ’৭১ এর শেরপুর জেলা শাখার আহ্বায়ক গোলাম মোস্তফা জানান, ১৯৭১ সালে ২৫ মে হানাদার বাহিনী ‘স্থানীয় দালালদের’ মাধ্যমে খবর পেয়ে নাকুগাঁও সীমান্তে ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ অতিক্রম করে শরণার্থীদের ওপর অতর্কিতে নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে বিপুলসংখ্যক হিন্দু ও মুসলিম নিরীহ মানুষ নিহত হন।

গোলাম মোস্তফা বলেন, “নিহত বাঙালিদের মধ্যে আমার চাচা আবদুল মোতালেব ও আশফাকুর রহমান নামে একজনের লাশ ভারতের বিএসএফ বাহিনী নিয়ে যাওয়ার পর নাকুগাঁও সীমান্তের ভারত অংশের মসজিদ সংলগ্ন এক কবরস্থানে দাফন করা হয়।” 

অন্যদের লাশ নাকুগাঁওয়ে গর্ত খুঁড়ে এক একটি গর্তে ৫০-৬০টি করে লাশ মাটিচাপা দেওয়া হয়। 

তিনি বলেন, “বধ্যভূমিতে আজও কোনো স্মৃতিচিহ্ন না থাকাটা খুবই দুঃখজনক ঘটনা। মহান মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য অনতিবিলম্বে নাকুগাঁও বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা আবশ্যক।”

নালিতাবাড়ীর বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহমান বলেন, “১৯৭১ সালের ২৫ মে ভোরে যখন ত্রিশাল, ফুলবাড়িয়ার ময়মনসিংহ ও শেরপুরসহ বিভিন্ন স্থানের মানুষ ভারতে যেতে থাকেন। সেই সময়ে প্রথম নালিতাবাড়ীর রামচন্দ্রকুড়া ইপিআর ক্যাম্পে হানাদার বাহিনী প্রবেশ করে। পাকিস্তানি বাহিনী স্থানীয় দালালের মাধ্যমে সংবাদ পেয়ে সেখানে ওত পেতে থাকে।

“যখন ভোর হয়, মানুষ সব ভোগাই নদীতে নেমে পার হয়ে যেতে থাকে ভারতের দিকে। ঠিক সেই সময় পেছন থেকে ব্রাশফায়ার, রাইফেলের গুলি, স্টেনগানের গুলি করে বিপুলসংখ্যক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। কত সংখ্যক মানুষ মারা গেছে আজ পর্যন্ত নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। সেদিন ভোগাই নদীতে হালকা পানি ছিল উজানের ঢলে।

“নদীতে অনেক মানুষের লাশ ভেসে যায়। একটা মানুষও জীবিত ছিল না। এত বড় হত্যাকাণ্ড এখানে ঘটেছে আজ পর্যন্ত কোনো স্মৃতিস্তম্ভ করা হয়নি।

“এখন নতুন প্রজন্মের স্থানীয় লোকজনও জানেন না, এখানে এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে। আমরা চাই, মাননীয় সরকার… অর্থাৎ শেখ হাসিনা সরকারের প্রশাসন… এবং সরকারের প্রতিনিধিদেরসহ সবার কাছে বিনীত অনুরোধ, অনতিবিলম্বে এখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ করা হোক।”

নাকুগাঁও গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আমির ফকির বলেন, “১৯৭১ সালের ২৫ মে হঠাৎ নাকুগাঁও গ্রামে বেশ কয়েকজন বিএসএফ সদস্য ও বাংলাদেশের অসংখ্য নিরীহ মানুষকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যার পর গণকবর দেওয়া হয়েছিল।”  

বধ্যভূমির আশপাশে বাংলাদেশ অংশে অনেক বাড়ি-ঘর রয়েছে।

একটি বাড়ির রাজকুমার গোয়ালা নামে এক বাসিন্দা বলেন, “আমি দেখেছি, হানাদার বাহিনী অনেক মানুষ হত্যা করার পর এখানে তাদের গণকবর দেওয়া হয়েছে। এই জায়গাটি একদম ভারত সীমানাঘেঁষা তথা নো ম্যান্স ল্যান্ড হলেও ভারত তাদের অংশে স্মৃতিফলক নির্মাণ করেছে অনেক আগেই। ওই সময়ে বাংলাদেশের অংশে স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হলে কোনো সমস্যা হত না।”

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে এই বধ্যভূমিতে স্মৃতিফলক নির্মাণের জন্য জরুরি উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।

নাকুগাঁও স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফিজুর রহমান মুকুল বলেন, “নাকুগাঁও বধ্যভূমিতে মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে একাধিকবার স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হলেও কিল্লাপাড়া বিএসএফ ক্যাম্পের বাধার কারণে তা করা সম্ভব হয়নি।  

“যেখানে বিপুলসংখ্যক নিরীহ মানুষ মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ হয়েছেন সেখানে স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও কোনো স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করতে না পারা সত্যি দুঃখজনক! 

“মহান মুক্তিযুদ্ধে বিএসএফের নয়জন সদস্যের স্মৃতি মিনার করা হয়েছে ভারতীয় অংশে। অথচ আজও আমরা শহীদদের স্মরণে কিছুই করতে পারি নাই।”

বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত নাকুগাঁও বধ্যভূমি সংরক্ষণে সরকারের উদ্যোগ চান এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।

এ ব্যাপারে নালিতাবাড়ীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইলিশায় রিছিল বলেন, “মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত ওই নাকুগাঁও বধ্যভূমির জায়গাটি পরিদর্শন করেছি। আন্তর্জাতিক আইনে নো ম্যান্স ল্যান্ড এলাকায় কোনো স্থাপনা নির্মাণ করার অনুমতি নেই।”

তিনি বলেন, “তারপরও জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষায় ওই স্থানের পাশেই স্মৃতিফলক নির্মাণের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে। এরই মধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বিকল্প একটি জায়গা দেখে রাখা হয়েছে।”

আরও পড়ুন

বিলোনিয়া যুদ্ধ: ইতিহাস ‘জানে না’ শিক্ষার্থীরা, নেই উদ্যোগও

১৯৭১: বহলায় একসঙ্গে ৪২ জনকে হত্যা করে হানাদাররা

১৯৭১: কাইয়ার গুদামে হত্যার পর লাশ ফেলা হত কুশিয়ারায়

বাবুর পুকুর গণহত্যা: মেলেনি স্বীকৃতি-ভাতা, ভেঙে পড়ছে স্মৃতিস্তম্ভ

‘সদ্য বাবা হলে যে আনন্দ, বিজয়ের খবর ছিল তার চেয়েও আনন্দের’

রাজাকারে ধরে নেয় দুই ভাইকে, তাড়নায় যুদ্ধে যান ১৩ বছরের স্বপন

১৯৭১: তীর-ধুনক নিয়েই রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও

১৯৭১: পানপট্টির সম্মুখ যুদ্ধে মুক্ত হয়েছিল পটুয়াখালী

জরাজীর্ণ গ্রন্থাগার-জাদুঘর, বীরশ্রেষ্ঠকে ‘স্মরণ’ কেবল মৃত্যুদিনে

একাত্তরে বরগুনা কারাগার হয়ে ওঠে গণহত্যা কেন্দ্র

কুমার নদে গাড়াগঞ্জ যুদ্ধ: ফাঁদে ফেলে হত্যা করা হয় ৮০ হানাদারকে

৬৩ জনের গণকবর লুপ্ত, স্মৃতি বলতে ‘মানকচু’

মুক্তিযুদ্ধে ডাকরায় ছয় শতাধিক হিন্দুকে হত্যার স্মৃতি তাড়া করে আজও