হাজং কিশোর ধীরেন্দ্র মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণে যান পরিবারকে না জানিয়ে  

ধীরেন্দ্র বলেন, “বাঙালি-আদিবাসী তখন সবাই এক হয়ে গিয়েছিলেন। এই চেতনাই আমাকে মহান মুক্তিযুদ্ধে নিয়ে গিয়েছিল।”

শামস শামীমসুনামগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 March 2024, 05:39 AM
Updated : 24 March 2024, 05:39 AM

একাত্তরে পরিবারের সঙ্গে ভারতের শরণার্থী শিবিরে চলে গিয়েছিলেন হাজং সম্প্রদায়ের ধীরেন্দ্র সরকার। কিন্তু সেখানে বাঙালিদের দুর্দশা দেখে পরিবারকে না জানিয়েই তিনি চলে গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণে।  

অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে প্রথমে বুক কেঁপে গিয়েছিল নবম শ্রেণির ছাত্র ধীরেন্দ্রের। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে রণাঙ্গণে সৌম্যকান্তি সহজ-সরল এই কিশোরই হয়ে উঠেছিলেন ভয়ংকর।

সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার কাশিপুর সীমান্ত গ্রামের এই বাসিন্দার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো নিয়ে কথা হয়। ৭০ বছর বয়সেও রণাঙ্গনের নানা স্মৃতি তার মানসপটে জ্বাজল্যমান। 

তিনি বলেন, ৭১ সালে তিনি ছিলেন সুনামগঞ্জ শহরের বুলচান্দ উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র। যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে বাড়িতে চলে আসেন।

দলে দলে মানুষ তখন সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ছুটছে ভারতের দিকে। দেশ-গ্রাম-পরিবার ছেড়ে মানুষের এই অনিশ্চিত যাত্রা এবং হানাদার সেনা-রাজাকারদের আগুনে দূরের গ্রাম পুড়তে দেখে ধীরেন্দ্রের মনে ধাক্কা লাগে।

কিন্তু সেই আগুন যখন পাশের গ্রামেও পৌঁছে যায় তখন জীবন বাঁচাতে সপরিবারে আশ্রয় নেন ভারতের বালাটের মৈলাম শরণার্থী শিবিরে। সেখানে গিয়ে বাঙালিদের দুর্দশা দেখে তিনি আরও ব্যথিত হন।

ধীরেন্দ্র জানান, চার ভাই-পাঁচ বোনের মধ্যে সবার বড় হওয়ায় পরিবারের সবাই তাকে বেশি আদর করতো। তাই তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন তা চাননি বাবা রসিক লাল সরকার।

তবে এ সময় চাচাতো ভাই কামদা সরকার তাকে যুদ্ধে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করেন। ফলে পরিবারকে না জানিয়েই চুপিসারে অগাস্ট মাসে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে চলে যান মেঘালয়ের ইকোওয়ান-১ এ।

সেখানে বুলচান্দ হাইস্কুলের সিনিয়র ছাত্র ননী ভূষণ দাস প্রশিক্ষণার্থীর তালিকায় তার নাম তুলে দেন। কিন্তু প্রশিক্ষণে অস্ত্র হাতে নিয়েই তার বুক কেঁপে উঠেছিল।

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এই সহজ সরল তরুণ কখনো কল্পনা করেননি মানুষের দিকে অস্ত্র তাক করবেন। কিন্তু দেশের প্রয়োজনে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিতেই হচ্ছে তাকে। প্রায় এক মাসের প্রশিক্ষণ শেষে ফের তিনি সদলবলে বালাটে ট্রানজিট ক্যাম্পে আসেন।

এদিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে ছেলে লুকিয়ে প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে ফিরে আসার খবর পেয়ে ছুটে আসেন তার বাবা। কিন্তু এবার আর তিনি বাধা দেননি। দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করে চোখের জলে ছেলেকে পাঠান রণাঙ্গনে। সঙ্গে দেন একটি উলের চাদর ও কিছু ফল।

ট্রানজিট ক্যাম্পে কয়েকদিন থাকার পর সুনামগঞ্জের সীমান্ত এলাকা বনগাঁও জলিল-ভূইয়ার ডি কোম্পানিতে পাঠানো হয় ধীরেন্দ্রকে।

ওই কোম্পানির টুআইসি ছিলেন সুনামগঞ্জ মহকুমা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তালেব আহমদ। তিনি ধীরেন্দ্রকে সম্মুখযুদ্ধের জন্য হাতে কলমে অস্ত্র চালানো শিখান।

ছাত্রনেতা তালেব সম্পর্কে ধীরেন্দ্র বলেন, “অসম্ভব সাহসী ছিলেন তালেব ভাই। অস্ত্রের পাশাপাশি একটি ধারালো চাকুও সঙ্গে রাখতেন তিনি। তার সাহস ও মনোবল দেখে আমরাও মনে সাহস পেয়েছিলাম। তিনি বলতেন- ধীরেন্দ্র যুদ্ধক্ষেত্রে ঘাবড়াতে নেই, সাহস আর শক্তিই বড় সম্বল।”

ধীরেন্দ্র বলেন, “তালেব ভাইয়ের কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান আমাদেরকে উজ্জীবিত করত। এ কারণে আমরা তাকে ‘জয় বাংলা তালেব’ ভাই ডাকতাম।”

রণাঙ্গনের প্রথমদিকে ইসলামপুর এলাকায় ছোট একটি সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন তালেব-ধীরেন্দ্ররা। পরে নভেম্বরের ২৭ তারিখ মঙ্গলকাটা-ইসলামপুর এলাকায় আরেকটি সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন তারা।

কিন্তু অসম ওই যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর আক্রমণে তালেব আহমদের দলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছিল। ধীরেন্দ্রসহ অন্যরা দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। এক পর্যায়ে তালেব আহমদকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি হায়েনারা। সঙ্গে নিয়ে যায় ধীরেন্দ্র সরকারের বন্ধু আলাউদ্দিনকেও। যাদের চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলেন তিনি।

ধীরেন্দ্র জানান, ছত্রভঙ্গ যোদ্ধারা পরে এলাকায় ফিরে সহযোদ্ধা কয়েকজনের লাশ কাঠালবাড়ি এলাকায় জড়ো করে রাখেন। ওই সময়ই খবর পান ধরে নিয়ে যাওয়া তালেব আহমদকে সুনামগঞ্জ শহরে প্রকাশ্যে ভয়ংকর নির্যাতন করছে হানাদাররা।

কিন্তু তাদের কিছু্ই করার ছিল না। পরে আসানমারা সেতুর পাশে নিয়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয় তালেবকে।  

সিনিয়র সহযোদ্ধা তালেবকে হারানোর এ স্মৃতি এখনো তাড়িয়ে বেড়ায়; তার নিষ্পাপ ও সাহসী মুখখানা মনে পড়ে ধীরেন্দ্র সরকারের।

দিন কয়েক পরেই তারা খবর পান দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অদম্য মুক্তিসেনাদের আক্রমণের মুখে পালাতে শুরু করছে পাকিস্তানি সেনারা।

এরই ধারাবাহিকতায় ৬ ডিসেম্বর মুক্ত হয় সুনামগঞ্জ। পরে অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগিরগাও ক্যাম্পে এসে অস্ত্র সমর্পণ করেন ধীরেন্দ্র।

তিনি জানান, বিজয় দিবসের ১০-১২ দিন পর বালাটের মৈলাম শরণার্থী শিবির থেকে পরিবার নিয়ে বাড়ি ফিরে দেখেন বিভিন্ন স্থান থেকে আসা বাঙালিরা তাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। তখন আশ্রিত সেসব মানুষকে সেবা-শুশ্রূষায় লেগে পড়েন তিনি ও তার পরিবার।

ধীরেন্দ্র বলেন, “বাঙালি-আদিবাসী তখন সবাই এক হয়ে গিয়েছিলেন। এই চেতনাই আমাকে মহান মুক্তিযুদ্ধে নিয়ে গিয়েছিল।”

স্বাধীন দেশে বুলচান্দ স্কুল থেকেই এসএসসি পাশ করেন তিনি। কিন্তু আর্থিক দুরবস্থা ও বড় পরিবারের ভরণ পোষণের জন্য বাবার সঙ্গে কৃষিকাজে মনোযোগী হতে হয় তাকে।

পরে ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ সীমান্ত রক্ষী বাহিনীতে যোগ দিয়ে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে অবসরে যান। এখন বাড়িতেই কৃষি কাজ করে দিন কাটে তার।  

স্ত্রী প্রাঞ্জলী দেবী, তিন ছেলে বিস্ময় সরকার, মৃণ্ময় সরকার এবং উদয়ানন্দ সরকারকে নিয়েই সংসার তার। দুই ছেলে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করে এখনো চাকরির চেষ্টা করছে বলে জানান তিনি।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ধীরেন্দ্রের সঙ্গে আলাপচারিতায় তার জীবনের আরেকটি অনন্য গল্পও উঠে আসে।  

বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ৫ নং বালাট সাব সেক্টরের ‘নমিনেল রোল অব এফ-সাব সেক্টর হেড কোয়ার্টার সুনামগঞ্জ’র ১৯ নম্বর পৃষ্ঠার ১০৬৯ ক্রমিক নম্বরে তার নাম উল্লেখ রয়েছে।

কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের স্বীকৃতি হিসেবে যে সার্টিফিকেট তিনি পেয়েছিলেন তা ১৯৭৫ সালের আগে হারিয়ে ফেলেছিলেন।

পরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যার সেই সার্টিফিকেট তোলার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন তিনি।

এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারকে নির্মমভাবে হত্যার পর মন ভেঙে যায়। যার ডাকে, যার নেতৃত্বে দেশ শত্রুমুক্ত করেছিলাম- স্বাধীন দেশে যখন তিনিই বাঁচতে পারলেন না তখন আর মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট দিয়ে আমি কি করব।”

তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর দেশ চলে যায় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির হাতে। ইতিহাস বিকৃতিসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের উপর জুলুম নির্যাতন শুরু হয়। এ কারণেই সার্টিফিকেট সংগ্রহের প্রতি আমার চরম বিতৃষ্ণা জন্মে। সুযোগ থাকার পরও তখন তা সংগ্রহ করিনি।”

তবে বঙ্গবন্ধুর কন্যা ক্ষমতায় আসার পর ও ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরুর পর মনে হয় দেশে এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রকৃত পরিবেশ বিরাজ করছে। তাই সহযোদ্ধাদের অনুরোধ এবং পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মের কথা বিবেচনায় নিয়ে সার্টিফিকেটের জন্য অনলাইনে আবেদন করেন তিনি।

পরে ২০২০ সালে তিনি সার্টিফিকেট ও ভাতা লাভ করেন।

ধীরেন্দ্রর স্ত্রী প্রাঞ্জলি দেবী বলেন, “আমার স্বামী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এটাই আমার সান্ত্বনা-গর্ব। বিয়ের পর তার সংসারে এসে লক্ষ্য করেছি সার্টিফিকেটের প্রতি তার কোনো মোহ ছিল না।

“সার্টিফিকেট প্রদর্শন করে বৈষয়িক সুবিধা নেবেন এই চিন্তা এখনো আমার স্বামী করেন না। কিন্তু আমাদের পশ্চাৎপদ আদিবাসী সম্প্রদায়ের পরবর্তী প্রজন্ম যাতে গর্বের সঙ্গে মাথা উঁচু করে বলতে পারে তাদের পূর্বপুরুষ মুক্তিযোদ্ধা ছিল। যিনি যৌবনে জীবন বাজি রেখে দেশ স্বাধীন করেছিলেন।

সেই প্রজন্মের কথা ভেবেই স্বামীর যুদ্ধের স্বীকৃতির জন্য আবেদন করিয়েছিলাম। এখন তিনি সনদ পেয়েছেন। সরকারি ভাতাও পাচ্ছি আমরা।”

মুক্তিযোদ্ধা ধীরেন্দ্র সরকার সম্পর্কে সহযোদ্ধা, সুনামগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার আবু সুফিয়ান বলেন, “আদিবাসী সম্প্রদায়ের ধীরেন্দ্র সরকারের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ বিষয়ে আমরা সকলেই জানি। রণাঙ্গনে তার সাহসী তৎপরতা দেখেছেন সহযোদ্ধারা।

“অনেক প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযোদ্ধা এখনো গর্বের সঙ্গে তার বীরত্বগাঁথার কথা বলছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি তালিকাভুক্ত হতে পেরেছেন ও সনদ পেয়েছেন এটা তার আমাদের জন্য আনন্দের।”