মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যে কয়টি সংগঠন দেশের অভ্যন্তরে থেকে প্রশিক্ষণ, যুদ্ধ পরিচালনা করেছে তার মধ্যে অন্যতম সিরাজগঞ্জের ‘পলাশডাঙ্গা যুব শিবির’। এই ক্যাম্পের অধীনে প্রায় ৬০০ গেরিলা যোদ্ধা ছিলেন, যারা ছোটবড় ৫১টি যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন।
১৯৭১ সালের মার্চে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গণহত্যা শুরু করার পর পরই জেলা শহর থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অজপাড়াগা কামারখন্দ উপজেলার ভদ্রঘাট ইউনিয়নের জাঙ্গালিয়াগাতিতে এই সশস্ত্র ক্যাম্প গড়ে তোলা হয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করার জন্য এই গ্রামের মানুষদের উপর আক্রমণ চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। এতে বেশ কয়েকজন শহীদও হন। মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বপূর্ণ অধ্যায় ধরে রাখতে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে সেখানে নির্মিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ ও স্মৃতি জাদুঘর।
গ্রামবাসী ‘পলাশডাঙ্গা যুব শিবির’ নিয়ে গর্ববোধ করলেও স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর এসেও গ্রামটি এখনও উন্নয়নের ছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে।
আরম্ভের কথা
মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৭১ সালের এপ্রিলের শুরুতে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য সিরাজগঞ্জের বেশ কিছু যুবক ও ছাত্রনেতা ভারতে রওনা হন। সবাই যেতে পারলেও পাঁচ ছাত্রনেতা- সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজের ভিপি সোহরাব আলী সরকার, প্রো-ভিপি লুৎফর রহমান মাখন, আব্দুল আজিজ সরকার, শফিকুল ইসলাম শফি ও মনিরুল কবির পাবনার ঈশ্বরদীর মুলাডুলি স্টেশনের কাছে বাধার মুখে পড়েন।
সেখান থেকে ফিরে তারা নির্জন ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন জাঙ্গালিয়াগাতি গ্রামের ওছিম উদ্দিনের বাড়িতে আশ্রয় নেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করতে কাজ শুরু করেন। শুরুতে স্থানীয় জহির উদ্দিনের নেতৃত্বে ১০-১২ জন এবং সদর উপজেলার কান্দাপাড়া থেকে ১৫ যুবকের দুইটি দল জাঙ্গালিয়াগাতি আসেন।
ওছিম উদ্দিনের বাড়িতে সবার জায়গা না হওয়ায় পাশের বসাকপাড়ার হরেন্দ্রনাথ বসাক ওরফে হারান মাস্টারের বাড়িতে আশ্রয় নেন অনেকে। এ বাড়ির দুটি টিনের ঘরে তারা থাকতেন এবং একটিকে অস্ত্রাগার হিসেবে ব্যবহার করতেন। এই বাড়িটি ঘিরে তৈরি করা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প। গ্রামের লোকজন ক্যাম্পটিতে খাদ্য সরবারহ করতেন। ওছিম, হারান মাস্টার ছাড়াও গ্রামের আরও কিছু বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা।
কিছুদিন পর বাঙালি সেনাসদস্য লুৎফর রহমান অরুণ চাকরি ছেড়ে পালিয়ে আসেন এই ক্যাম্পে। শুরু করেন যুবকদের প্রশিক্ষণ পর্ব। ধীরে ধীরে শত শত মুক্তিকামী ছাত্র-জনতা, কৃষক, শ্রমিক ও সরকারি বিভিন্ন বাহিনীর সদস্য এ ক্যাম্পে যোগ দেন।
অপরদিকে ভারতে প্রশিক্ষণ শেষে ফিরে এসে এই বাহিনীতে যুক্ত হন সাবেক ছাত্রনেতা আব্দুল লতিফ মির্জা, বিমল কুমার দাস, শহীদুল ইসলাম, আমিনুল ইসলাম হীরু, খোরশেদ আলমসহ অন্তত ২০ থেকে ২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা। দাঁড়িয়ে যায় একটি বেসামরিক বাহিনী।
৬ জুন সবার সম্মতি নিয়ে আব্দুল আজিজ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এই সংগঠনের নাম রাখেন ‘পলাশডাঙ্গা যুব শিবির’।
আব্দুল লতিফ মির্জাকে (পরবর্তীতে সংসদ সদস্য, বর্তমানে প্রয়াত) পরিচালক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-রাকসুর সাবেক জিএস আব্দুস সামাদ ও মনিরুল কবিরকে সহকারী পরিচালক ও সিরাজগঞ্জ কলেজের ভিপি সোহরাব আলীকে সর্বাধিনায়ক (কমান্ডার ইনচার্জ) নিযুক্ত করা হয়।
এ ছাড়া সহকারী অধিনায়ক নিযুক্ত হন বিমল কুমার দাস ও আমজাদ হোসেন মিলন (প্রয়াত সাবেক সংসদ সদস্য)। আর ব্যাটালিয়ন কমান্ডার লুৎফর রহমান অরুণের অধীনে থাকে কয়েকটি কোম্পানি।
সম্পূর্ণ সামরিক কায়দা-কানুনে পরিচালিত এ শিবিরের একটি ব্যাটালিয়ন, ছয়টি কোম্পানি, ১৮টি প্লাটুন ও ৫০টি সেকশন ছিল। সংগঠনটিতে ধীরে ধীরে যোদ্ধার সংখ্যা বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে ছয় শতাধিক যোদ্ধার বিশাল এক বাহিনীতে রূপ নেয়।
নামকরণের গল্প
সংগঠনের নামকরণের পেছনের গল্প জানালেন সহকারী পরিচালক বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আজিজ সরকার।
তিনি বলেন, নবাব সিরাজদ্দৌলার পলাশীর প্রান্তরের নামানুসারে ‘পলাশ’ এবং একটি খালের ওপরে অবস্থিত বাড়িতে প্রথম আশ্রয় নেওয়ায় সূত্রে ‘ডাঙ্গা’, সবাই ছিলাম যুবক সেই কারণে ‘যুব’ আর সংগঠন মানে ‘শিবির’। এই চার শব্দের মিলে নাম হয়েছিল- ‘পলাশডাঙ্গা যুব শিবির’।
গ্রামবাসীকে হত্যা
পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের সর্বাধিনায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা সোহরাব আলী সরকার বলেন, তৎকালীন সিরাজগঞ্জ মহকুমা প্রশাসক এ কে শামসুদ্দিন (পরবর্তীতে ঢাকায় শহীদ) প্রথম এ সংগঠনে ১৩টি অস্ত্রের (রাইফেল) যোগান দিয়েছিলেন। খুবই গোপনে অজপাড়া গাঁয়ে এ সংগঠনের কার্যক্রম চলছিল। কিন্তু এক সময়ে পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের অস্তিত্ব টের পেয়ে যায় পাকিস্তানি ও তাদের দোসররা। এ অবস্থায় ১৯৭১ সালের ১৭ জুন ভোরে হঠাৎ ক্যাম্পটিতে আক্রমণ করে পাকিস্তানিরা। তাৎক্ষণিক প্রতিরোধ গড়ে তোলেন ক্যাম্পে থাকা শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা। প্রচণ্ড যুদ্ধে মৃত্যু হয় এক পাকিস্তানি সেনার।
পরে পাকিস্তানিদের আরও একটি ব্যাটালিয়ন এসে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ করলে বাধ্য হয়ে পিছু হটেন তারা। এরপর পাকিস্তানিরা এই গ্রামে আক্রমণ করে নাম জানা ১৬ জনসহ অজ্ঞাত পরিচয় ৮ থেকে ১০ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে এবং বেশকিছু ঘরবাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেয়।
এ মুক্তিযোদ্ধা বলেন, “এই ক্যাম্পটি ছাড়ার পর আমরা নির্দিষ্ট কোনো স্থানে বেশিদিন অবস্থান করিনি। পরিকল্পনা অনুযায়ী রেকি করে এক একটি এলাকায় অবস্থান ও পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ করেছি। নদীপথেও ছিল আমাদের বিচরণ। বর্ষার সময় ৫৪টি নৌকায় আমরা বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরেছি এবং যুদ্ধ করেছি।
“এই সংগঠনের নেতৃত্বে ছোট-বড় মোট ৫১টি যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে। এর মধ্যে বৃহৎ আকারের ছিল ১৮টি।”
সোহরাব আলী বলেন, উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে বড় গেরিলা যুদ্ধ সংগঠিত হয় সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার নওগাঁ শাহ শরীফ জিন্দানীর (রহ.) মাজার এলাকায়। ১১ নভেম্বর সংগঠিত এ যুদ্ধে ১৩০ জন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার নিহত হন। যুদ্ধ শেষে ক্যাপ্টেন সেলিমসহ নয় পাকিস্তানি সেনা প্রচুর অস্ত্র ও যুদ্ধসরঞ্জামসহ আত্মসমর্পণ করেন।
তবে এ যুদ্ধে কোনো মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হননি। এই যুদ্ধের স্মৃতি রক্ষায় ২০১৫ সালের ৭ অগাস্ট এখানে উদ্বোধন করা হয় ‘রণাঙ্গনে পলাশডাঙ্গা মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ এবং স্মৃতি জাদুঘর’।
সিরাজগঞ্জের দক্ষিণাঞ্চল ছাড়াও পাবনার ফরিদপুর, সাঁথিয়া, চাটমোহর, নাটোরের গুরুদাসপুর ও বগুড়ার শেরপুরসহ চলনবিলের সীমান্তবর্তী এলাকায় এই সংগঠনের বিচরণ ও সদস্য ছিল বলে সর্বাধিনায়ক সোহরাব আলী জানান।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজ মাঠে জাতীয় নেতা ও উপ-প্রধানমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর হাতে এ সংগঠনের সদস্যরা অস্ত্র জমা দেন। তবে এ সংগঠনের নেতৃত্বে এতোগুলো যুদ্ধ সংগঠিত হলেও সংগঠনটির কোনো রাষ্টীয় স্বীকৃতি ছিল না এবং কোনো মুক্তিযোদ্ধাই সরকারি খেতাব পাননি। পরবর্তীতে কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সার্বিক প্রচেষ্টায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় হতে সরকারি স্বীকৃতি লাভ করে ‘পলাশডাঙ্গা যুব শিবির’।
দৃষ্টিনন্দন স্মৃতিসৌধ
এ সংগঠনের সহকারী কমান্ডার এবং স্মৃতিসৌধ ও স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণের উদ্যোক্তা বীর মুক্তিযোদ্ধা বিমল কুমার দাস বলেন, পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরকে আগামী প্রজম্মের কাছে পরিচয় করিয়ে দিতে এবং সংগঠনের জন্মস্থান জাঙ্গালিয়াগাতি গ্রামটির স্মৃতি রক্ষায় মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থানসমূহ সংরক্ষণ ও মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় পলাশডাঙ্গা যুব শিবির মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ ও স্মৃতি জাদুঘর নির্মিত হয়েছে।
দৃষ্টিনন্দন সৌধটির উচ্চতা ৭১ ফুট। জাদুঘরে রয়েছে আধুনিক পাঠাগার, সন্মেলন কক্ষ, পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জামাদিসহ ছবি এবং মুক্তিযুদ্ধ সর্ম্পকিত আকর্ষণীয় জিনিসপত্র।
বিমল বলছেন, “স্মৃতিসৌধের পাশেই নির্মিত হবে দৃষ্টিনন্দন একটি লেক এবং লেকের ওপর নির্মিত হবে একটি সেতু। আমরা বিশ্বাস করি, আগামী প্রজন্ম এখান থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও পলাশডাঙ্গা যুব শিবির সর্ম্পকে অনেক ইতিহাস জানতে পারবে।”
তবে এই স্থাপনা দুইটিতে সরকারিভাবে এখনও লোকবল নিয়োগ হয়নি জানিয়ে বিমল বলেন, “ভবনের নিরাপত্তায় সীমানা প্রাচীর নির্মাণ ও আগত দর্শনার্থীদের সুবিধার জন্য অভ্যন্তরীণ ক্যান্টিন স্থাপন করা প্রয়োজন। আশপাশের পুকুরগুলোর ধারে শোভাবর্ধনসহ আরও বেশ কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় উল্লেখিত কাজে আমাদের সহায়তা করবে।”
সিরাজগঞ্জ স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর-এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সফিকুল ইসলাম বলছেন, “এলজিইডি ‘পলাশডাঙ্গা যুব শিবির প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করছে। ২০২১ সালের ২৮ মার্চ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন সিরাজগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য হাবিবে মিল্লাত মুন্না। এখানে এলজিইডির তত্ত্বাবধানে নির্মিত দেশের সবচেয়ে উঁচু ৭১ ফুট স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে ১ কোটি ৫২ লাখ টাকা।
“স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। তৈরি করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা সম্বলিত নামফলক। ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে সংযোগ সড়ক।”
২০২৩ সালের ১ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রকল্পের উদ্বোধন করেন।
সফিকুল বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের চাহিদামাফিক এ প্রকল্পের সুরক্ষা ও শোভাবর্ধনের জন্য আরও কিছু কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় ভবিষ্যতে আরও অর্থ বরাদ্দ করলে এলজিইডি তা বাস্তবায়নে সহায়তা করবে।
স্মৃতি বিজড়িত কূপ
হরেন্দ্রনাথ বসাক ওরফে হারান মাস্টারের বাড়িতে ক্যাম্প করার পর ওই বাড়ির পাকা কূপের পানি পানসহ নানা কাজে ব্যবহার করতেন মুক্তিযোদ্ধারা। সেই কূপটি এখনও সংরক্ষণ করে রেখেছেন পরিবারটি। সম্প্রতি সেখানে গেলে স্মৃতি হাতড়ে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের নানা গল্প শোনান হারান মাস্টারের বিধবা স্ত্রী ৮৫ বছর বয়সী গীতা রানী বসাক।
গীতা বলেন, “মুক্তিযোদ্ধারা দুইটি ঘরে থাকতেন, একটিতে অস্ত্র রাখতেন। বাড়ির চারিদিকে ব্যাংকার তৈরি করে ক্যাম্প পাহারা দিতেন। ক্যাম্পের পশ্চিম ভিটায় ট্রেনিং হত। কালিবাড়ি স্কুলসহ আশপাশের বাড়িগুলোতেও কিছু মুক্তিযোদ্ধা থাকতেন।
“মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য দুই বেলা খাবার রান্না করেছি। গ্রামের লোকজনও খাবার দিতেন। কখনও বেশি লোক সমাগম হলে মুক্তিযোদ্ধারা নিজেরাও রান্না করে খেতেন। সবাই বাড়ির পাকা কূপের পানি খেতাম।”
সত্যি হয় চাপা আতঙ্ক
যুদ্ধ দিনের গল্প বলতে গিয়ে ঠোঁট কাঁপে গীতা রানীর, একটু থেমে বলেন, “আমাদের মাঝে একটা আতঙ্ক সবসময়ই থাকত। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়ায়, পাকিস্তানি কখন না জানি বাড়িতে হামলা করে। এক শনিবার সেই আতঙ্ক সত্য হয়। ভোরবেলায় পাড়ার পশ্চিম দিকে থেকে পাকিস্তানিরা এসে ক্যাম্প লক্ষ্য করে গুলি শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের সবাইকে বাড়ি ছেড়ে নিরাপদে সরে যেতে বলেন। আমি দুই-আড়াই বছরের শিশু সন্তান তপনকে নিয়ে আমডাঙ্গা গ্রামের স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নেই।
“আমার স্বামী ৪-৫ বছর বয়সী বড় ছেলে তপনকে নিয়ে নান্দিনার দিকে আশ্রয় নেন। দুইদিন পর বাড়িতে ফিরে দেখি ঘরবাড়ি পুড়ে ধ্বংস্তূপে পরিণত হয়েছে। গ্রামের বেশ কিছু নিরীহ মানুষকেও মেরে ফেলেছিল তারা। আশপাশের কয়েকটি গ্রামের বেশকিছু বাড়িঘরও পুড়িয়ে দিয়েছিল। আবার হামলার আশঙ্কায় স্বামী ও শ্বাশুড়িকে বাড়িতে রেখে গ্রামের অন্য মানুষদের সঙ্গে সবাই ভারতের মাইনকার চরে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিলাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমাদের গ্রামে ফিরিয়ে আনা হয়।”
হারান মাস্টারের ছোট ছেলে স্বাগতম কুমার বসাক বলেন, “শুনেছি মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের বাড়িতে ক্যাম্প করে থাকত, বাড়ির পাকা কূপের পানি খেত। সেই কূপটি এখনও আছে, তবে এখন আর কেউ পানি খায় না। কূপের মুখে রডের খাঁচা লাগিয়ে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। কূপ দেখতে অনেকেই এখনও আমাদের বাড়িতে আসেন।”
স্মৃতিতে পলাশডাঙ্গা যুব শিবির
হারান মাস্টারের ছেলে ৪০ বছর বয়সী সাগর চন্দ্র বসাক নিজেদের বাড়িতে স্থাপিত ক্যাম্প, গ্রামের যুদ্ধ, পাকিস্তানি সেনাদের জ্বালাও-পোড়াও ও নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে ‘জনসাধারণের স্মৃতিতে পলাশডাঙ্গা যুব শিবির’ নামে একটি বই প্রকাশ করেছেন। গবেষণা ও সম্পাদনা তিনি নিজেই করেছেন।
বইটিতে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ভদ্রঘাট গ্রামের প্রত্যক্ষদর্শী ৩৮ জন নারী-পুরুষের সাক্ষাৎকার, পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের শীর্ষ পর্যায়ের ছয়জনের সংক্ষিপ্ত জীবনী, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়দাতা হারান মাস্টারের সংক্ষিপ্ত জীবনী, যুদ্ধকালীন পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের হাই কমান্ডের তালিকা, ক্যাম্পে পাকসেনাদের হামলা ও যুদ্ধ এবং যুদ্ধের দিন গণহত্যায় নিহতদের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে।
এ ছাড়া বইটিতে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্লভ কিছু ছবি এবং পলাশডাঙ্গা যুব শিবির মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ ও স্মৃতি জাদুঘর নিয়ে সংক্ষিপ্ত একটি লেখা স্থান পেয়েছে।
এখনও খাল পার হতে হয়
মুক্তিযুদ্ধের ৫২ বছর পর অনেক কিছুর পরিবর্তন হলেও প্রায় ১৫০ পরিবারের বসতির জাঙ্গালিয়াগাতি গ্রামটির ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। শুকনো মৌসুমে গ্রামবাসীকে ক্ষেতের আইল দিয়ে যাতায়াত করতে হয়। আর বর্ষায় গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা সরু খাল পাড়ি দিতে হয় নৌকায়।
মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়দাতা ওছিম উদ্দিনের নাতি মোতালেব হোসেন দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, “এই অজপাড়া গাঁয়ের আমাদের বাড়িতেই প্রথম মুক্তিযোদ্ধারা আশ্রয় নিয়েছিল। অথচ স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও এই গ্রামটি সেই আগের মতই আছে। কেউ তো আমাদের খোঁজ নেয় না। যাতায়াতের জন্য একটি রাস্তা ও খালের ওপর একটি সেতু হলে গ্রামের মানুষের দীর্ঘদিনের দুর্ভোগ লাঘব হত।”
পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের সর্বাধিনায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা সোহরাব আলী সরকার বলেন, “ছোট্ট এই গ্রামটি এখনও অবহেলিত। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এই গ্রামটিতে রাস্তা-ঘাট নেই, বর্ষায় নৌকা ছাড়া চলাচল করা যায় না। উপজেলা প্রশাসনকে মৌখিকভাবে বিষয়গুলো বলেছি, কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না।”
তবে পলাশডাঙ্গা যুব শিবির নিয়ে কাজ করছেন বলে জানান কামারখন্দ উপজেলা চেয়ারম্যান শহীদুল্লাহ সবুজ। তিনি বলেন, “আশা করছি, জাঙ্গালিয়াগাতি গ্রামের রাস্তা ও ব্রিজের সমস্যা দ্রুত সমাধান হবে।”
সিরাজগঞ্জ স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সফিকুল ইসলাম বলছেন, গ্রামীণ অবকাঠানো উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় জাঙ্গালিয়াগাতি গ্রামের রাস্তা ও ব্রিজের সমস্যা লাগবে উদ্যোগ নেওয়া হবে।
আরও পড়ুন: