২০২০: মহামারীকালের খেরোখাতা

ইতিহাসের পাতায় ২০২০ সাল চিহ্নিত হয়ে থাকবে মহামারীর বছর হিসেবে, যে বছর মৃত্যুভয়কে করে তুলেছে মানুষের জীবনসঙ্গী, বাধ্য করেছে জীবনধারা পাল্টে নিতে।

মঈনুল হক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 Dec 2020, 02:40 PM
Updated : 23 Feb 2021, 05:30 PM

বিদায়ী বছরে করোনাভাইরাসের প্রভাব ছিল সর্বব্যাপী, বাংলাদেশও এর বাইরে নয়।

এর মধ্যেও শামীমা নূর পাপিয়া, মোহাম্মদ সাহেদ আর জেকেজি হেলথকেয়ারের অনিয়ম-দুর্নীতি, প্রতারণা-জালিয়াতির ঘটনা আলোচনার জন্ম দিয়েছে; অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ড ফেলেছে সুদুরপ্রসারী প্রভাব।

দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের ইউএনওর বাসায় ঢুকে হামলা যেমন সবাইকে অবাক করেছে, দেশবাসীকে স্তম্ভিত করেছে মাইন্ড এইড হাসপাতালে সিনিয়র এএসপি আনিসুল করিম শিপনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা।

মহামারীর ছায়ায় আরেক মহামারী হয়ে ওঠা ধর্ষণ-যৌন নিপীড়ন থামাতে সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ডের আইন করতে হয়েছে সরকারকে। দফায় দফায় বন্যা বাড়িয়ে দিয়েছে অর্থনীতির ক্ষত। 

নারায়ণগঞ্জের মসজিদে বিস্ফোরণ আর বুড়িগঙ্গায় লঞ্চডুবিতে নিহতদের পরিবারের কাছে ২০২০ সাল হয়ে থাকবে অন্য এক শোকের বছর।

গতানুগতিক নানা ঘটনার মধ্যেও রাজধানী থেকে বেওয়ারিশ কুকুর অপসারণের বিরোধিতায় প্রাণী অধিকার কর্মীদের আন্দোলন নগরবাসীকে নতুন করে ভাবার তাগিদ দিয়েছে এ বছর।

মহামারীতে প্রথাগত রাজনীতি যখন ঘরবন্দি, তখন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরোধিতায় উগ্রপন্থিদের হুঙ্কার জাগিয়েছে নতুন শঙ্কা।  

বিশ্বের সব দেশের মত বাংলাদেশেও খেলাধুলা আর সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে মহামারীর কারণে কঠিন সময় পার করতে হয়েছে। আর অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছে, তা সামলে উঠতে লেগে যাবে বহু দিন। 

তবে বছরের শেষে এসে পদ্মাসেতুর পূর্ণ অবয়বপ্রাপ্তি স্বপ্ন পূরণের বার্তা দিয়েছে; আর ভাইরাসকে সঙ্গী করে ২০২১ সালে প্রবেশের সাহস যোগাচ্ছে টিকা আসার খবর।

করোনাভাইরাস মহামারীতে মারা গেছেন যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা মহিউদ্দিন। ঢাকার রায়েরবাজার কবরস্থানে তার কবর ছুঁয়ে কাঁদছেন ছেলে রাব্বানী। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

ভাইরাসের
ত্রাস

চীনে নতুন ধরনের এক ভাইরাসের প্রদুর্ভাবের খবর নিয়ে ২০২০ সাল শুরু করেছিল বিশ্ব; সেই ভাইরাস তিন মাসের মাথায় বাংলাদেশেও পৌঁছে যায়। তার পরের মাসগুলোতে বিশ্বের অন্য সব দেশের মত বাংলাদেশের মানুষের জীবনও পাল্টে গেছে।    

৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ার পর গত প্রায় দশ মাসে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে ৫ লাখ। নতুন এ করোনাভাইরাস কেড়ে নিয়েছে সাড়ে ৭ হাজার মানুষের প্রাণ।

বাংলাদেশে ভাইরাসের প্রকোপ শুরুর পর স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে ২৫ মার্চ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহামারীর মধ্যে আতঙ্কিত না হয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার কথা বলেছিলেন। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুসরণ করে সুরক্ষিত থাকতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।

পুরো বিশ্বে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চলাচল ততদিনে প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে, শুরু হয়েছে লকডাউনের বিধিনিষেধ। ফলে বিশ্বের বেশিরভাগ অঞ্চলে জনজীবন কার্যত অচল।

দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ১৭ মার্চ থেকেই। ২৬ মার্চ থেকে সব অফিস আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে সারা দেশে সব ধরনের যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। সরকারিভাবে একে বলা হয় ‘সাধারণ ছুটি’, তবে তা ‘লকডাউন’ হিসেবেই সাধারণের মধ্যে পরিচিতি পায়।  

এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের পর থেকে রোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। ৩০ জুন এক দিনেই ৬৪ জনের মৃত্যুর খবর জানানো হয় সরকারের তরফ থেকে, যা করোনাভাইরাসে বাংলাদেশে এক দিনের সর্বোচ্চ মৃত্যু। আর ২ জুলাই ৪ হাজার ১৯ জন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়, যা এক দিনের সর্বোচ্চ শনাক্ত।

লকডাউনের মধ্যে কষ্টে পড়ে খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষ। ব্যবসা-বাণিজ্যও স্থবির হয়ে পড়ে। সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতার উদ্যোগ নেওয়া হলেও কল কারখানা বন্ধ থাকায় এবং অনেকে কর্মহীন হয়ে পড়ায় বড় ধরনের অর্থনৈতিক জটিলতার দিকে যেতে থাকে পরিস্থিতি।

জীবন ও জীবিকার এই অসম সমীকরণ মেলাতে গিয়ে অন্য অনেক দেশের মত বাংলাদেশেও মে মাসের শেষ দিকে বিধিনিষেধ শিথিল করা শুরু হয়। টানা ৬৬ দিনের লকডাউন ওঠার পর ৩১ মে থেকে অফিস খোলার পাশাপাশি গণপরিবহন চলাচালের অনুমতি দেয় সরকার। ধীরে ধীরে শুরু হয় ফ্লাইট চলাচল। অগাস্টে বিনোদন কেন্দ্রও খুলে দেওয়া শুরু হয়।

মহামারীর কারণে এ বছর বিধিনিষেধের মধ্যে কেটেছে বাঙালির বর্ষবরণের উৎসব, দুই ঈদ, দুর্গা পূজাসহ সকল ধর্মীয় আয়োজন। রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতাগুলোও সীমিত করে আনতে হয়েছে। স্থগিত রাখতে হয়েছে মুবিববর্ষের বিপুল আয়োজন। 

বছরের শেষ দিকে এসে মোটামুটি সব খুলে দেওয়া হলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখনও বন্ধ। উচ্চ মাধ্যমিকের পাশাপাশি পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষাও এবার নেওয়া যায়নি।

করোনাভাইরাসকে সঙ্গী করেই নতুন বছরে প্রবেশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ। তবে টিকা তৈরির সুখবর মানুষের মনে সাহস যোগাচ্ছে। সরকার আশা করছে, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির মধ্যেই টিকার প্রথম চালান হাতে পাওয়া যাবে।

ধাপে ধাপে সবাইকে টিকার আওয়তায় আনার কথা সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলেও সঙ্গত কারণেই সেজন্য লম্বা সময় প্রয়োজন। ফলে মাস্ক পরা, হাত ধোয়া, দূরত্ব রক্ষার নিয়মে কোনো পরিবর্তন আনতে পারছে না ২০২১।

ত্রিমূর্তি

প্রতি বছরের মত এবারও নানা অপরাধে গ্রেপ্তার হয়েছে অনেকে, বেরিয়ে এসেছে অনিয়ম-দুর্নীতি, প্রতারণা-জালিয়াতির নানা তথ্য। তবে অন্য সব আলোচনাকে ছাপিয়ে গেছে তিনটি ঘটনার কয়েকটি চরিত্র। 

শামীমা নূর পাপিয়া

নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক শামীমা নূর পাপিয়া এবং তার স্বামী মফিজুর রহমানকে ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। কিন্তু তারপর যেসব তথ্য বেরিয়ে আসতে থাকে, তাতে সাড়া পড়ে যায়। বছরের শুরুর দিকের এ ঘটনা রাজনীতিতেও ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।

র‌্যাবের পক্ষ থেকে সে সময় বলা হয়, পাপিয়া গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেল ভাড়া নিয়ে কয়েকজন তরুণীকে দিয়ে ‘যৌন ব্যবসা’ চালিয়ে যে আয় করতেন, তা দিয়ে হোটেলে বিল দিতেন কোটির টাকার উপরে।

তদন্তকারীরা জানান, ঢাকার ইন্দিরা রোডে ওই দম্পতির দুটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, নরসিংদী শহরের দুটি ফ্ল্যাট, গাড়ি, নরসিংদীর বাগদী এলাকায় কোটি টাকা মূল্যের দুটি প্লট রয়েছে। এছাড়া তেজগাঁও এফডিসি গেইট সংলগ্ন এলাকায় 'কার এক্সচেঞ্জ' নামে একটি গাড়ির দোকানে প্রায় এক কোটি টাকা এবং ‘কেএমসি কার ওয়াশ অ্যান্ড অটো সলিউশনস' নামের একটি প্রতিষ্ঠানে ৪০ লাখ টাকা বিনিয়োগ আছে তাদের।

র‌্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়, পাপিয়া ও তার স্বামী সুমন চৌধুরী নরসিংদী এলাকায় ‘অস্ত্র ও মাদকের কারবার, চাঁদাবাজি, চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণাসহ বিভিন্নভাবে মানুষের অর্থ আত্মসাত করে’ ওই সম্পদ গড়েছেন। 

কাদের পৃষ্ঠপোষকতায় পাপিয়া এ পর্যায়ে উঠে আসতে পেরেছেন, কারা ওয়েস্টিন হোটেলে পাপিয়ার সেবা নিতে যেতেন, কাদের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে ছবি তুলে তিনি ফেইসবুকে দিয়েছেন, সেই সব নাম গণমাধ্যমে আসতে থাকলে রীতিমত শোরগোল পড়ে যায়। অবৈধ কারবারে জড়িত থাকায় যুব মহিলা লীগের জেলা কমিটির পদ হারাতে হয় পাপিয়াকে।

অবৈধ অস্ত্র রাখার দায়ে পাপিয়া ও তার স্বামী সুমনকে ইতোমধ্যে ২০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। মাদক, বিশেষ ক্ষমতা আইন এবং মুদ্রা পাচার প্রতিরোধ আইনে আলাদা মামলা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। দুদকও পাপিয়ার অবৈধ সম্পদের বিষয়ে অনুসন্ধান করছে।

অবৈধ অস্ত্র রাখার দায়ে ইতোমধ্যে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে সাহেদের

ক্ষমতাসীন দলের নেতা পরিচয় দিয়ে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে নানা কাজ হাসিল করা মোহাম্মদ সাহেদ ছিল বছরের অন্যতম আলোচিত চরিত্র।

মোহাম্মদ সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান। করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে চিকিৎসার নামে প্রতারণা এবং পরীক্ষার নামে জালিয়াতির মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় তার হাসপাতাল।

গত ৬ ও ৭ জুলাই অভিযান চালিয়ে উত্তরা ও মিরপুরে রিজেন্টের দুটি হাসপাতাল বন্ধ করে দেয় র‌্যাব। এরপর রিজেন্ট আর সাহেদের নানা দুর্নীতির তথ্য বেরিয়ে আসতে থাকে। জানা যায়, ওই হাসপাতালের লাইসেন্সের মেয়াদ পার হয়ে গেছে বহু আগে।

বিভিন্ন টেলিভিশনের আলোচনা অনুষ্ঠানে নিয়মিত মুখ দেখাতেন সাহেদ। নিজেকে তিনি পরিচয় দিতেন আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক উপকমিটির সহসম্পাদক হিসেবে। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলে সেসব তিনি ফেইসবুকে সাজিয়ে রাখতেন নিজের ‘ক্ষমতা’ বোঝানোর জন্য।

হাসপাতালে অভিযানের পর সাহেদ লাপাত্ত হয়ে গিয়েছিলেন। পরে ১৫ জুলাই ভোরে সাতক্ষীরার দেবহাটা সীমান্তবর্তী কোমরপুর গ্রামের লবঙ্গবতী নদীর তীর থেকে তাকে ধরে আনে র‌্যাব। প্রতারণা ছাড়াও অস্ত্র ও মাদক আইনে মামলা হয় তার বিরুদ্ধে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে সাহেদের প্রতারণা-জালিয়াতিতে ভুক্তিভোগিরাও এরপর মামলা করতে শুরু করেন।

অবৈধ অস্ত্র রাখার দায়ে গত ২৮ সেপ্টেম্বর এক মামলায় সাহেদকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় আদালত। সেই রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, এ রায় তার মত ‘ধুরন্ধর’ ব্যক্তিদের জন্য একটি বার্তা।

জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটের চিকিৎসক ডা. সাবরিনা শারমিন হুসাইন পরিচিত ছিলেন সাবরিনা আরিফ নামে

দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আবেদন করে পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহের দায়িত্ব নিয়েছিল ওভাল গ্রুপের প্রতিষ্ঠান জোবেদা খাতুন হেলথ কেয়ার, সংক্ষেপে জেকেজি হেলথকেয়ার।

কিন্তু জুনের শেষ দিকে অভিযোগ আসে, সরকারের কাছ থেকে বিনামূল্যে নমুনা সংগ্রহের অনুমতি নিয়ে বুকিং বিডি ও হেলথকেয়ার নামে দুটি সাইটের মাধ্যমে টাকা নিচ্ছিল জেকেজি। নমুনা পরীক্ষা না করে রোগীদের ভুয়া সনদও তারা দিচ্ছিল।

অভিযোগের সত্যতা পেয়ে ২২ জুন জেকেজির সাবেক গ্রাফিক ডিজাইনার হুমায়ুন কবীর হিরুকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরদিন তেজগাঁও থানায় একটি মামলা করা হয়।

হুমায়ুনের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরে তেজগাঁও থানা পুলিশ জেকেজির সিইও আরিফুল চৌধুরীসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করে। পরে ১২ জুলাই গ্রেপ্তার করা হয় জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটের চিকিৎসক ডা. সাবরিনা শারমিন হুসাইন ওরফে সাবরিনা চৌধুরীকে।

২০১৫ সাল থেকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন করে আসা ডা. সাবরিনা জেকেজির প্রধান নির্বাহী আরিফুলের স্ত্রী এবং ওই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হিসেবেই তিনি পরিচিত। 

সরকারি চাকরিতে থাকা অবস্থায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জেকেজির সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় সাবরিনাকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। জেকেজি হেলথ কেয়ারের নমুনা সংগ্রহের যে অনুমোদন ছিল, তাও বাতিল করা হয়।

সাবরিনা গ্রেপ্তার হওয়ার পর জেকেজির দুর্নীতিতে তার সংশ্লিষ্টতা খুঁজে দেখতে তদন্তে নেমে দুদক তার দুটি জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য পায়। জানা যায়, তার মোবাইল সিমটিও নিবন্ধন করা হয়েছে তারই এক রোগীর নামে।

করোনাভাইরাস পরীক্ষা নিয়ে জালিয়াতির মামলায় ইতোমধ্যে আরিফুল, সাবরিনাসহ আট আসামির বিচার শুরু করেছে আদালত।

কক্সবাজারে তল্লাশি চৌকিতে পুলিশের গুলিতে নিহত অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানের উত্তরার বাসায় খোলা হয় শোক বই।

একজন
ওসি
এবং
একটি
পরিকল্পিত
হত্যাকাণ্ড

বিদায়ী বছরের যে ঘটনাগুলো সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে, তার একটি হল অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ড।

৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। ভ্রমণ বিষয়ক তথ্যচিত্র নির্মাণের জন্য তিনি কক্সবাজারে গিয়েছিলেন দুই সঙ্গীকে নিয়ে।

কক্সবাজারের পুলিশ সে সময় বলেছিল, সিনহা তার পরিচয় দিয়ে ‘তল্লাশিতে বাধা দেন’। পরে ‘পিস্তল বের করলে’ চেক পোস্টে দায়িত্বরত পুলিশ তাকে গুলি করে।

কিন্তু পুলিশের দেওয়া ঘটনার বিবরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত ২ অগাস্ট উচ্চ পর্যায়ের এই তদন্ত কমিটি গঠন করে। পুলিশের বিরুদ্ধে ‘বিচার বহির্ভূত হত্যার’ অভিযোগগুলোও নতুন করে আলোচনায় আসতে শুরু থাকে।

সিনহার বোন আদালতে হত্যা মামলা দায়ের করলে বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলি এবং টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাসসহ সাত পুলিশ সদস্য আদালতে অত্মসমর্পণ করেন। তাদের চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্তও করা হয়।

সিনহা হত্যা মামলার আসামি টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ দাশকে ২১ অগাস্ট হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থলে নেওয়া হয় তদন্তের জন্য

১৩ ডিসেম্বর লিয়াকত ও প্রদীপসহ ১৫ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। র‌্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়, ওসি প্রদীপ কুমার দাশের ‘ইয়াবা কারবারের খবর জেনে যাওয়ায়’ সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয় বলে উঠে এসেছে তাদের তদন্তে।

ডকুমেন্টারি তৈরির কাজে সিনহার সঙ্গে থাকা স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাহেদুল ইসলাম সিফাত ও শিপ্রা দেবনাথের বিরুদ্ধে মাদক আইনে মামলা দিয়েছিল পুলিশ। ওই দুই মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে র‌্যাব বলেছে, তাদের তদন্তে অভিযোগের ‘সত্যতা পাওয়া যায়নি’।

সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর কক্সবাজারের পুলিশকে নতুন করে সাজানো হয়। এসপি থেকে কনস্টেবল- প্রায় সব পুলিশ সদস্যকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। পুলিশের ভূমিকা নিয়ে আলোচনার মধ্যে কথিত বন্দুকযুদ্ধে হতাহতের ঘটনাও প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসে।

সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে ‘পুলিশি নির্যাতনে’ রায়হান আহমদের মৃত্যুর ঘটনাও এ বছর আলোচনার জন্ম দেয়।

১১ অক্টোবর ভোরে রায়হানের মৃত্যুর পর পুলিশের পক্ষ থেকে প্রথমে প্রচার করা হয়, ছিনতাইয়ের দায়ে নগরের কাষ্টঘর এলাকায় গণপিটুনিতে নিহত হন রায়হান। তবে পরিবার দাবি করে, সিলেট মহানগর পুলিশের বন্দর বাজার ফাঁড়িতে পুলিশের নির্যাতনে রায়হানের মৃত্যু হয়েছে। এ বিষয়ে নিহতের স্ত্রী একটি মামলাও দায়ের করেন।

পুলিশ হেফাজতে রায়হানের মৃত্যু এবং নির্যাতনের প্রাথমিক সত্যতা মেলার পর ১৩ অক্টোবর পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে মামলাটির তদন্তভার পায় পিবিআই। মামলার প্রধান আসামি এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াকে কানাইঘাট সীমান্ত থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

বুয়েট ক্যাম্পাসে রাস্তার ধারে দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতি পৌঁছে দিচ্ছে প্রতিবাদের বাণী।

ধর্ষণ
থামাতে
বাড়ল
সাজা

চলতি বছরের শুরুতে রাজধানীর কুর্মিটোলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের ঘটনা পুরো দেশকে নাড়িয়ে দেয়। এরপর সেপ্টেম্বরে সিলেটের এমসি কলেজে স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া এক গৃহবধূকে ছাত্রাবাসে নিয়ে দলবেঁধে ধর্ষণ এবং অক্টোবরে নেয়াখালীতে এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।

এই প্রেক্ষাপটে ধর্ষণের শাস্তি বাড়ানোর দাবি নতুন করে আলোচনায় আসে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে টানা বিক্ষোভের মধ্যে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে অধ্যাদেশ জারি করে সরকার। পরে তা সংসদেও আইন হিসেবে পাস হয়।

ঢাকা বিশ্বাবদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনার বিচার শেষে গত ১৯ নভেম্বর একমাত্র আসামি মজনুকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।

আর সিলেটের এমসি কলেজের ঘটনায় ছাত্রলীগের আটজনকে আসামি করে ইতোমধ্যে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ।

নোয়াখলীতে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনা ঘটে গত ২ সেপ্টেম্বর। এক মাস পর গত ৪ অক্টোবর ওই নির্যাতনের ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হলে দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। এরপর ওই নারীকে উদ্ধার করে নিজেদের হেফাজতে নেয় স্থানীয় পুলিশ। গ্রেপ্তার করা হয় আসামিদের।

ওই নির্যাতনকারীরা স্থানীয় ‘দেলোয়ার বাহিনীর লোক’ বলে তখনই জানিয়েছিল র‌্যাব। এই দেলোয়ার ক্ষমতাসীন দলের পরিচয়ে এলাকায় দাপট নিয়ে চলতেন।

ওই ঘটনায় ১৫ ডিসেম্বর ১৪ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

আসামি গ্রেপ্তার না হওয়ায় অনশনে বসেছিলেন নূরদের বিরুদ্ধে মামলার বাদী

এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজের স্নাতকোত্তর শ্রেণির এক ছাত্রী ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে লালবাগ থানায় ডাকসুর সাবেক ভিপি নূরুল হক নূরসহ ছাত্র অধিকার পরিষদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও তাতে সহযোগিতার অভিযোগ এনে তিনটি মামলা করেন।

পরে ফেইসবুক লাইভে এসে ধর্ষণ মামলার বাদীকে ‘দুশ্চরিত্রা’ আখ্যায়িত করায় নূরের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আরেকটি মামলা করা হয়।

ওই ছাত্রীর দায়ের করা ধর্ষণের মামলায় ১১ অক্টোবর ছাত্র অধিকার পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. সাইফুল ইসলাম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সহ-সভাপতি নাজমুল হুদাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তবে নূরকে প্রকাশ্যেই ধর্ষণবিরোধী বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিতে দেখা যায়।

হামলায় আহত ওয়াহিদা খানমকে জাতীয় নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয় প্রায় এক মাস

অদ্ভুত
এক
হামলা

গত সেপ্টেম্বরে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াহিদা খানমের বাসায় ঢুকে হামলার ঘটনা ছিল বছরের অন্যতম আলোচিত বিষয়।

ঘোড়াঘাট উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে ইউএনওর বাসভবনের ভেন্টিলেটর দিয়ে ঢুকে ২ সেপ্টেম্বর রাতে ওয়াহিদা ও তার বাবা ওমর আলীর ওপর হাতুড়ি দিয়ে হামলা চালানো হয়।

ওই ঘটনায় ইউএনওর ভাই শেখ ফরিদ অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ এনে একটি মামলা করেন। দুদিন পর স্থানীয় যুবলীগ কর্মী আসাদুল হক, রং মিস্ত্রি নবীরুল ইসলাম ও সান্টু কুমার দাসকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। দাবি করা হয়, আসাদুল চুরি করতে গিয়ে ইউএনওর উপর হামলা করেন, সে কথা তিনি জিজ্ঞাসাবাদে ‘স্বীকারও’ করেছেন।

তবে ওই ঘটনাকে নিছক চুরি হিসেবে মানতে আপত্তি জানায় সরকারি প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন। সমিতির নেতারা দাবি করেন, ওয়াহিদার উপর হামলা ‘পরিকল্পিত’।

এরপর গত ১২ সেপ্টেম্বর রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য দিনাজপুরে সংবাদ সম্মেলন করে উপজেলা পরিষদের চাকরিচ্যুত মালি রবিউল ইসলামকে গ্রেপ্তারের খবর জানান। তিনি বলেন, রবিউল হামলায় জড়িত থাকার কথা ‘স্বীকার করেছেন’। আর হামলায় ব্যবহৃত হাতুড়িটি উদ্ধার করা হয়েছে উপজেলা পরিষদের পুকুর থেকে।

তদন্ত শেষে গত ২১ নভেম্বর রবিউলকে একমাত্র আসামি করেই অভিযোগপত্র দেয় গোয়েন্দা পুলিশ। তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, গত জানুয়ারিতে ইউএনও ওয়াহিদা খানমের ব্যাগ থেকে টাকা চুরির অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত হন রবিউল। সে কারণে তিনি ক্ষুব্ধ ছিলেন। গত ১ সেপ্টেম্বর তাকে চাকরিচ্যুত করা হলে তিনি ‘হত্যার উদ্দেশ্য নিয়ে’ ইউএনওর বাসায় ঢুকে হামলা করেন।

ঘোড়াঘাটের ঘটনার পর দেশের সব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) নিরাপত্তায় তাদের সরকারি বাসভবনে আনসার দেওয়া হয়।

এদিকে হামলায় আহত ওয়াহিদা ও তার বাবাকে প্রথমে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, পরে সেখান থেকে ঢাকায় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অস্ত্রোপচারের পর প্রায় এক মাসের চিকিৎসায় অনেকটা সুস্থ হয়ে ওঠেন ওইউএনও ওয়াহিদা। তখন নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল থেকে ছুটি দিয়ে তাকে পাঠানো হয় মিরপুর সিআরপিতে।

চিকিৎসার সুবিধার জন্য ১৯ সেপ্টেম্বর ওয়াহিদাকে বদলি করে নতুন কোনো দায়িত্ব না দিয়ে জনপ্রশসন মন্ত্রণালয়ে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে রাখা হয়। আর ওয়াহিদার স্বামী রংপুরের পীরগঞ্জের ইউএনও মো. মেজবাউল হোসেনকে বদলি করে ঢাকায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগে নিয়ে আসা হয়।

বন্যায় ডুবেছে ঘর; খুলে রাখা হয়েছে ঘরের বেড়া। জুলাই মাসের বন্যায় লৌহজং উপজেলার বেজগাঁও ইউনিয়নের ছবি।

মহামারীর
মধ্যে
বন্যার
ঘা

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে এ বছর দেশের দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে লাখো মানুষকে দীর্ঘমেয়াদী বন্যার দুর্ভোগে পড়তে হয়। চার দফার বন্যায় সারা দেশে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৬০০০ কোটি টাকা।

২৬ জুন প্রথম দফায় বন্যা শুরু হয়। ১০ জুলাই দ্বিতীয় দফা, ১৯ জুলাই তৃতীয় দফা এবং ১৮ অগাস্ট উপকূলীয় অঞ্চল প্লাবিত হয়।

১৯৮৮, ১৯৯৮ ও ২০০৭ সালে দেশে বড় বন্যা হয়েছে। সেগুলোর তুলনায় এবারের বন্যার ধরনে ভিন্নতা ছিল বেশ কিছু দিক দিয়ে।

বন্যাকবলিত ৩৩ জেলাসহ মোট ৪০ জেলা এবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৩০ জুন থেকে ২৭ অগাস্ট পর্যন্ত সময়ে বন্যা দুর্গত এলাকায় ২৫১ জনের মৃত্যু হয়েছে, যাদের বেশিরভাগের প্রাণ গেছে পানিতে ডুবে।

এ বছরই ১৯ মে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় আম্পান পশ্চিমবঙ্গ উপকূলে আঘাত হানার পর স্থলভাগে উঠে এসে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে তাণ্ডব চালায়। এ ঝড়ে আট জেলায় অন্তত ১৫ জনের মৃত্যু হয়। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১১০০ কোটি টাকার মত।

প্রাথমিকভাবে এসি বিস্ফোরিত হওয়ার কথা বলা হলেও পরে জানা যায়, গ্যাস জমে ঘটেছে ওই দুর্ঘটনা

ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা এলাকার বায়তুস সালাত জামে মসজিদে আকস্মিক বিস্ফোরণ ছিল এ বছরের একটি হৃদয় বিদারক ঘটনা।

৪ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৮টার দিকে এশার নামাজ চলাকালে মসজিদে বিস্ফোরণে ৩৮ জন দগ্ধ হয়। তাদের মধ্যে ৩৪ জনের মৃত্যু হয়। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতে পেরেছেন কেবল চারজন।

সেই রাতের ঘটনার পর প্রাথমিকভাবে ছয়টি এসি একসঙ্গে বিস্ফোরিত হওয়ার কথা বলা হলেও পরে গ্যাস জমে দুর্ঘটনা ঘটার কথা বলেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা।

পরদিন তিতাস, ডিপিডিসি, মসজিদ কমিটির বিরুদ্ধে ‘অবহেলাজনিত মুত্যু সংঘটনের’ অভিযোগ এনে মামলা করে ফতুল্লা মডেল থানা পুলিশ, যার তদন্ত করছে সিআইডি।

বিস্ফোরণের কারণ খতিয়ে দেখতে পাঁচটি তদন্ত কমিটি গঠন করে ফায়ার সার্ভিস, জেলা প্রশাসন, তিতাস গ্যাস, ডিপিডিসি, সিটি করপোরেশন। সেই তদন্তে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতে থাকে অনিয়ম ও গাফিলতির নানা তথ্য।

তিতাসের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৮৭ সালে স্থাপন করা একটি লাইনের বদলে ১৯৯৮ সালে নতুন লাইনের সংযোগ পান কয়েকজন গ্রাহক। গ্রাহকের বাড়ির সামনে থেকে পুরোনো সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলেও তখন সড়কের মূল লাইন থেকে তা বিচ্ছিন্ন করা হয়নি। পরে পরিত্যক্ত ওই লাইনের ওপর নির্মাণ করা হয় মসজিদ।

মাটির নিচে চাপা দিয়ে রাখা গ্যাস রাইজার এবং মসজিদ নির্মাণের সময় ক্ষতিগ্রস্ত পুরনো বিতরণ লাইন থেকে গ্যাস বের হচ্ছিল। সেই গ্যাস মসজিদের বেইজমেন্ট ভেদ করে ভেতরে গিয়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে জমা হয়।

মসজিদে একাধিক বিদ্যুৎ সংযোগের মধ্যে একটি সংযোগ ছিল অবৈধ। সেই রাতে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর মুয়াজ্জিন যখন এক ফেইজ থেকে আরেক ফেইজে লাইন ‘চেইঞ্জওভার’ করেন, তখন ‘স্পার্ক’ থেকে মসজিদের নিচতলায় জমা গ্যাসে আগুন ধরে যায়।

মসজিদের পাশের সড়কের মাটি খুঁড়ে পরিত্যক্ত পাইপলাইনে ছয়টি ছিদ্র পাওয়ার পর সেগুলো বন্ধ করে তিতাস কর্তৃপক্ষ।

বছরের শেষদিন সিআইডি মসজিদ কমিটির সভাপতি আবদুল গফুর মিয়াসহ ২৯ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়।

এছাড়া তিতাসের আট কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়ার জন্য সরকারের অনুমতি চাওয়ার কথা জানানো হয় সিআইডির পক্ষ থেকে।

বুড়িগঙ্গায় লঞ্চ দুর্ঘটনায় নিহত যমুনা ব্যাংকের ইসলামপুর শাখার কর্মচারী সুমন তালুকদারের ভাই নয়ন তালুকদারকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন এক উদ্ধারকর্মী

ভোরের
পাখির
ট্র্যাজেডি

ঢাকার শ্যামবাজারের কাছে বুড়িগঙ্গা নদীতে ২৯ জুন এক লঞ্চের ধাক্কায় আরেকটি ছোট লঞ্চ ডুবে ৩৪ জনের মৃত্যুর ঘটনা নাড়িয়ে দেয় পুরো দেশকে।

এমএল মর্নিং বার্ড নামের ওই লঞ্চটি মুন্সিগঞ্জের কাঠপট্টি থেকে যাত্রী নিয়ে সদরঘাটের দিকে আসছিল। সকাল সোয়া ৯টার দিকে শ্যামবাজারের কাছে নদীতে ময়ূর-২ লঞ্চের ধাক্কায় সেটি ডুবে যায়।

আকারে বহুগুণ বড় লঞ্চ ‘ময়ূর-২’ এর ধাক্কায় ছোট লঞ্চ ‘এমএল মর্নিং বার্ড’ কেমন করে মুহূর্তের মধ্যে বুড়িগঙ্গায় ডুবে গিয়েছিল, সেই দৃশ্য ধরা পড়ে সদরঘাটের একটি সিসি ক্যামেরার ভিডিওতে।

সেই ভিডিও দেখে নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “যেভাবে ঘটনা ঘটেছে, আমার মনে হয়েছে এটা পরিকল্পিত। এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়, হত্যাকাণ্ড।”

 

অবহেলাজনিত মৃত্যু’ ঘটানোর অভিযোগ এনে ময়ূর-২ লঞ্চের মালিক, মাস্টারসহ সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করে নৌ পুলিশ। সেই মামলার এজাহারভুক্ত পাঁচ আসামিসহ মোট ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে নৌ-পুলিশ ও র‌্যাব।

ওই ঘটনায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি প্রাণহানির পেছনে নয়টি কারণ চিহ্নিত করে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা এড়াতে ২০ দফা সুপারিশ করে।

তদন্ত কমিটি বলেছে,ময়ূর-২ লঞ্চের ধাক্কায় মর্নিং বার্ড ডুবে গেছে এটা ‘নিশ্চিত’। তবে যেহেতু এ ঘটনায় মামলা হয়েছে, তাই দায়ী কে তা তদ্ন্ত করে বের করা হবে।

বছরের শেষে এসে ১৯ ডিসেম্বর জয়পুরহাট সদরের পুরানাপৈল রেল গেইট এলাকায় বাস ও ট্রেনের সংঘর্ষে ১১ জন নিহত হন।

কুকুরের আদলে মুখোশ পরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা স্তম্ভের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশে প্রাণী অধিকার কর্মীরা

সারমেয়
নিয়ে
শোরগোল

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে দীর্ঘ লকডাউনে খাবারের অভাবে এমনিতেই কষ্টে ছিল নগরের পশুপাখিরা। তার মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন রাজধানী থেকে বেওয়ারিশ কুকুর অপসারণের উদ্যেগে নিলে সেপ্টেম্বরে শুরু হয় শোরগোল।

এর বিরোধিতায় সরব হয় বিভিন্ন প্রাণী অধিকার কর্মী ও পশুপ্রেমীরা। কুকুর অপসারণ না করার দাবিতে গ্রাফিতি আঁকা হয়, মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচিও পালিত হয়।

প্রাণী অধিকার কর্মীদের ভাষ্য, স্থানান্তর বা অপসারণ না করে সুষ্ঠু এবং সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কুকুর নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। কয়েকজন নগর পরিকল্পনাবিদও শহর থেকে কুকুর বিতাড়নের বিপক্ষে মত দেন। 

বেওয়ারিশ কুকুর অপসারণে ডিএসসিসি কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে ১৭ সেপ্টেম্বর একটি রিট মামলা হয়। আদালতের হাস্তক্ষেপে বিষয়টি আপাতত স্থগিত হলেও অনিশ্চয়তা থেকেই যায়।

নিজের অবস্থানের ব্যাখ্যায় দক্ষিণের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছেন, কোনো উন্নত দেশের সড়কে বেওয়ারিশ কুকুর থাকে না। তাই বেওয়ারিশ কুকুরের পরিচর্যার দায়িত্ব যদি প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি পুরোপুরিভাবে নেন তাহলে কুকুর অপসারণের প্রয়োজন হবে না।

তবে এ বিষয়ে উত্তর সিটি করপোরেশনের অবস্থান ভিন্ন। বেওয়ারিশ কুকুর অপসারণ না করে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় আনার পক্ষে তারা।

বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশনের অধীনস্থ ২৬টি পাটকলের মধ্যে ঢাকা অঞ্চলের ৭টির একটি এই করিম জুট মিলস। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

 

হঠাৎ বন্ধ রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে শ্রমজীবী মানুষ যখন গভীর অনিশ্চয়তায়, তখনই ‘শতভাগ’ পাওনা বুঝিয়ে দিয়ে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত সব পাটকল বন্ধের ঘোষণা কার্যকর হয় গত ১ জুলাই।

সরকার যেখানে সোনালী আঁশের সুদিন ফেরানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছিল, পাটপণ্য থেকে রপ্তানি যেখানে বাড়ছিল, সেখানে এই উল্টোযাত্রা নানা প্রশ্নেরও জন্ম দেয়।

তবে মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস জানান, প্রধানমন্ত্রী যখন ওই সিদ্ধান্তে চূড়ান্ত সম্মতি দিলেন, তিনি ‘খুব আবেগাপ্লুত’ হয়ে পড়েছিলেন।

সরকারের তরফ থেকে বলা হয়, ধারাবাহিকভাবে লোকসানে থাকা এসব রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের পুঞ্জীভূত দেনা বাড়তে থাকায় বন্ধ করা ছাড়া উপায় ছিল না।

আপাতত বন্ধ রেখে পাটকলগুলো পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় আধুনিকায়ন করে ছয় মাসের মধ্যে নতুন করে চালু করার পরিকল্পনার কথা সে সময় জানানো হয়।   

রাষ্ট্রায়ত্ত ২৬টি পাটকলে ২৪ হাজার ৮৮৬ জন স্থায়ী শ্রমিক ছিলেন, যাদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে অবসরে পাঠানো হয়। শ্রমিকদের শতভাগ পাওনা এককালীন পরিশোধের ব্যবস্থা হয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে।

১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার করিম জুট মিলসের ১ হাজার ৭৫৯ জন শ্রমিকের পাওনা বুঝিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে বন্ধ রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ কার্যক্রম শুরু করে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়।

পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী ওই অনুষ্ঠানে বলেন, “আমরা পিপিপিতে যাব নাকি জিটুজিতে যাব এ নিয়ে অনেকগুলো মিটিং করেছি। বেশিরভাগ আছেন, যারা মিল চালান, তারা লিজ পদ্ধতিতে মিল পরিচালনার পরিকল্পনা করছেন। আমরাও সেভাবে চিন্তাভাবনা করছি।

“এখন আমরা লিজ পদ্ধতিতে যেতে চেষ্টা করছি। কারণ এখন আধুনিক যুগে তৎকালীন ষাট সালের মেশিন দিয়ে চলে না। এখন লাভজনক প্রতিষ্ঠান করতে হলে নতুন মেশিন আনতে হবে। আধুনিকায়ন করতে হবে। কম বিদ্যুতে বেশি প্রোডাকশন করতে হবে। নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে আধুনিকায়ন করে মিলগুলো চালু করব।”

ফ্রান্স দূতাবাস ঘেরাও কর্মসূচির অংশ হিসেবে হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা ২১ অক্টোবর রাস্তায় নামে

রাজনীতি
আইসোলেশনে
’,
রাজপথে
হেফাজত

মার্চে দেশে প্রথমবারের মত করোন্ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ছে, সভা-সমাবেশ জমায়েতে নিষেধাজ্ঞা আসে, এরপর আসে লকডাউনের বিধিনিষেধ। ফলে দেশের মানুষের মত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও চলে যায় ঘরের ভেতর ‘আইসোলেশনে’। 

এর মধ্যেই লকডাউন শুরুর আগে আগে আকস্মিকভাবে সাময়িক মুক্তি মেলে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার, যিনি দুর্নীতি মামলায় ১৭ বছরের সাজা নিয়ে ২৫ মাস ধরে কারাগারে ছিলেন।

পরিবারের আবেদনে সরকার ‘মানবিক বিবেচনায়’ শর্তসাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য সাজা স্থগিত করে ২৫ মার্চ তাকে সাময়িক মুক্তি দেয়। পরে আরও ছয় মাসের জন্য তা বাড়ানো হয়।

তখন থেকে গুলশানে নিজের ভাড়া বাসা ফিরোজায় থেকে ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধায়নে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৭৫ বছর বয়সী খালেদা।

সাময়িক মুক্তির শর্ত অনুযায়ী এই সময়ে তাকে ঢাকায় নিজের বাসায় থেকে চিকিৎসা নিতে হবে এবং তিনি বিদেশে যেতে পারবেন না।

দুর্নীতির দায়ে ২৫ মাস সাজা ভোগের পর গত ২৫ মার্চ সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে সাময়িক মুক্তি পান বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।

মহামারীর নয় মাসে মাঠের রাজনীতি সেভাবে সক্রিয় না থাকলেও দলগুলো ত্রাণ বিতরণের মত কাজে সক্রিয় থাকার চেষ্টা করেছে। অনেক নেতাকর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, কারও কারও মৃত্যুও ঘটেছে। 

তবে বছরের শেষভাগে এসে হেফাজতে ইসলামীর আমির শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর পর নতুন নেতৃত্বের অধীনে রাজপথেও সক্রিয় হয়ে উঠেছে ধর্মভিত্তিক সংগঠনটি।

গত ২ নভেম্বর ফ্রান্স দূতাবাস ঘেরাও কর্মসুচি ঘোষণা করে তারা বায়তুল মোকাররম থেকে মিছিল বের করে। হাজার হাজার কর্মী-সমর্থকের সেই মিছিলে স্বাস্থ্যবিধির বালাই ছিল না।

মুজিববর্ষে ঢাকার ধোলাইড়পাড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হলে তার বিরোধিতা শুরু করেন কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক বিভিন্ন সংগঠনের জোট হেফাজতে ইসলামের নেতারা।

হেফাজতের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মামুনুল হক ভাস্কর্য তৈরি করা হলে তা ‘বুড়িগঙ্গায় ফেলার’ হুমকি দেন। এরপর চট্টগ্রামে এক ধর্মীয় সভায় হেফাজত আমির জুনাইদ বাবুনগরী যে কারও ভাস্কর্য তৈরি করা হলে ‘টেনেহিঁচড়ে’ ভেঙে ফেলার হুমকি দেন।

এ নিয়ে প্রতিবাদের মধ্যেই ৪ ডিসেম্বর রাতে কুষ্টিয়ায় জাতির পিতার একটি নির্মাণাধীন ভাস্কর্যে ভাঙচুর চালানো হয়। ওই ঘটনায় স্থানীয় এক মাদ্রাসার দুই ছাত্র এবং দুই শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যারা ইতোমধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।