পাটকল: পিপিপি পরিকল্পনায় উদ্যোক্তাদের সংশয়

আপাতত বন্ধ রেখে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় আধুনিকায়ন করে ছয় মাসের মধ্যে উৎপাদনমুখী করার যে পরিকল্পনার কথা সরকার বলছে, তার বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন এ খাতের ব্যবসায়ী ও রপ্তানিকারকরা।

জয়ন্ত সাহা নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 July 2020, 06:10 AM
Updated : 5 July 2020, 06:10 AM

সেকেলে যন্ত্রপাতি আর ‘দুর্নীতি-অপচয়ের’ দায়ে ডুবে যাওয়া সরকারি পাটকলগুলো পিপিপির ভিত্তিতে চালু করতে বেসরকারি খাত সহসা এগিয়ে আসবে না বলে মনে করছেন তাদের কেউ কেউ।

আবার কেউ বলেছেন, পিপিপি যদি সফলও হয়, সেজন্য দীর্ঘ সময় লেগে যাবে, তাতে বাজার চলে যাবে বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলোর হাতে। এর বদলে মিল বন্ধ না রেখেও আধুনিকায়নের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব ছিল।

বাংলাদেশ জুট গুডস এক্সপোর্টাস অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান লুৎফুর রহমান বলেন, “এখন হয়ত সরকার এটা টেকনিক্যালি বলছে যে ছয় মাসের মধ্যে তারা এটা চালু করবে। ছয় মাসের মধ্যে এটা কে নেবে? যে ভাঙাচোরা মিল, মিলের যে অবস্থা... ৫০-৬০ বছর আগের মেশিনারিজ, প্রাইভেট সেক্টরের কেউ এই মুহূর্তে এগিয়ে আসবে না।

“আসতে হলেও তাদের প্রচুর সময় দিয়ে, প্রচুর ইনভেস্টমেন্ট করে... সরকারের ইনভেস্টমেন্ট, ব্যাংকের ইনভেস্টমেন্ট, ব্যাংকের কী দায়দেনা, লোন কী পর্যায়ে আছে...এগুলো করতেই ৬ মাস-এক বছর চলে যাবে। তারপর সরকার টেন্ডার দেবে, তারপর হয়ত করতে পারবে।”

ধারাবাহিকভাবে লোকসানে থাকা দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ২৬টি পাটকলের উৎপাদন ইতোমধ্যে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বিজিএমসির অধীন এসব পাটকলের মধ্যে একটি বাদে সবগুলোই সচল ছিল।

পাটখাতের রপ্তানি আয় যখন বাড়ছিল, তখন সরকারের এই সিদ্ধান্ত অবাক করেছে এ খাতের অনেককে। করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে এসব পাটকলের ২৪ হাজার ৮৮৬ জন স্থায়ী কর্মচারীকে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে অবসরে পাঠানো নিয়েও সমালোচনা হচ্ছে।

এই সিদ্ধান্তের পেছনে সরকারের যুক্তি, ‘বিজেএমসির ব্যর্থতায়’ পাটকলগুলোর পুঞ্জিভূত লোকসানের পরিমাণ দাাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা। সেজন্য শ্রমিকদের ভুগতে হচ্ছে, সরকারকেও প্রতি বছর বিপুল অংকের টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে।

আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজনের মাধ্যমে পিপিপির আওতায় ‘দ্রুত’ এ পাটকলগুলো সচল করার পরিকল্পনার কথা বলেছেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী।

অবশ্য বেসরকারি খাতে পাটকল ছেড়ে দেওয়ার অভিজ্ঞতাও খুব সুখকর নয়। বেশ কয়েকটি পাটকল লোকসানের দায়ে বন্ধ হয়ে গেছে। হস্তান্তর চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করায় বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া চারটি পাটকল সরকার ফিরিয়ে নেয় গত ২০১৭ সালে।

পাট পণ্য রপ্তানিকারক লুৎফুর রহমান বলেন, সরকারি ও বেসরকারি খাতের ‘মানসিকতার কম্বিনেশন’ কতটুকু হবে- সেটা ভাবার বিষয় আছে এখানে। আর যন্ত্রপাতির আধুনিকায়ন করে মিলগুলো পুনরায় চালু করতে দুই বছরের বেশি সময় লাগতে পারে বলে তার ধারণা।

“যদি এমন শাটডাউন চলতেই থাকে, আমাদের শুধু কাঁচাপাট রপ্তানি করেই টিকে থাকতে হবে। পাটপণ্যের বাজার চলে যাবে প্রতিযোগী দেশগুলোর হাতে।”

রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর পুরনো যন্ত্রপাতিতে যে সর্বোচ্চ উৎপাদন পাওয়া যাচ্ছে না, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী এবং শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ানের কথায় তা এসেছে।

কিন্তু বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএমএ) মহাসচিব আব্দুল বারিক খান মনে করেন, পিপিপির রাস্তায় না গিয়ে এসব পাটকল চালু রেখেই আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন করা ভালো হত।

“মিলগুলো তো চালু আছে। হয়ত মেশিনারিজ চেইঞ্জ করতে হবে। এখন যেভাবে রয়েছে সেভাবেই চালু করেন। আধুনিকায়ন করতে হয়ত ৬ মাস লাগবে।”

পাটকল বন্ধ রাখার অন্য বিপদের কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন বেসরকারি পাটকল মালিকদের সংগঠনের এই নেতা। 

“পাটকলগুলো চালু থাকলে তারা তো কিছু পাট কিনত। আমাদের এখন পাটের মৌসুম। এ মৌসুমে মিল বন্ধ থাকলে পাটও কেনা হবে না। পরে দেখা যাবে যে পাট আমরা ১৫০০ টাকা মণ দরে কিনছি, মৌসুম শেষে সে পাটের দাম হয়েছে ২৫০০ টাকা। কিনতে পারলে পাটও পচবে। তাই মিলগুলো চালু রেখেই পিপিই, বিএমআরই (সমন্বয়, আধুনিকায়ন, পুনর্বাসন ও সম্প্রসারণ) করার কথা চিন্তা করা যেত।”

সরকারের আহ্বানে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা পিপিপির মাধ্যমে এসব জুট মিল পরিচালনায় শরিক হলেও পুরনো দায় নিতে রাজি হবে না বলেই বারিক খানের ধারণা।

তিনি বলেন, “সরকার দাম ধরুক... সরকার ৪৯ পারসেন্ট, বেসরকারি ৫১ পারসেন্ট...। সেটা আমাদের লায়াবিলিটি ফ্রি করে দিতে হবে। পুরনো ক্ষয়ক্ষতির দায়, ব্যাংকের দেনা, শ্রমিকদের বকেয়া বেতন, সাপ্লায়ারদের দেনা, মেশিন যারা দেয়, তাদের টাকা- সেসব দায় সরকারকে নিতে হবে।

“সরকার কোনো মিলের দাম হয়ত ধরল ৫০০ কোটি টাকা, না হয় বলল ডাউন পেমেন্ট দাও..., কিন্তু পুরনো দায় আমরা নেব না। মিলগুলো যখন বন্ধ হয়ে যায় তখন তা হয়ে যায় খাদে পড়ে যাওয়া হাতির মত।”

বারিক খান বলেন, “ভারত সরকার বেসরকারি খাতকে ২০ পারসেন্ট অনুদান দিয়ে বলছে, তোমরা পুরনো মেশিন বিক্রি করে দাও, নতুন মেশিন নিয়ে আস। কিন্তু আমাদের দেশে বেসরকারি খাতে তো সরকারি বিনিয়োগ নাই। আমরা পুরনো দায় নেব কেন? “

কোন মিলের দায়ের পরিমাণ কত, আধুনিকায়নে কত খরচ পড়বে, পিপিপিতে গেলে তার রূপরেখা কী হবে- সেসব বিষয়ে বিশদ পরিকল্পনা সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়নি। 

তবে বন্ধ হয়ে যাওয়া পাটকলে ‘খুব দ্রুত’ উৎপাদন শুরুর তাগিদ রয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী গত শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “সবাই চিন্তা করতেছে, ওয়ার্ল্ড মার্কেট ধরতে। ওয়ার্ল্ড মার্কেট ধরলে পরে সেখানে আমাদের কম্পিটিশন। যার কারণে ওয়ার্ল্ড মার্কেটে এখন পর্যন্ত আমরা এগিয়ে আছি। যার কারণে আমরা টোয়েন্টি সিক্স পারসেন্ট গ্রোথ করতে পেরেছি।”

তবে বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএসএ) মহাসচিব শহীদুল করিম বলছেন একেবারে অন্য কথা। তার দাবি, পাটপণ্যের বাজার চাহিদা দ্রুত কমে আসায় পাটকলের জায়গায় বরং নতুন শিল্প স্থাপন করা যেতে পারে।

“আমাদের আগে ভাবতে হবে যে, পাট পণ্যের চাহিদা কি আছে? আগে পাটকলগুলো যখন বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হত, তখন শর্ত থাকত, সেখানে আমরা শুধুমাত্র পাটই উৎপাদন করতে পারব। কিন্তু চাহিদাই যখন কমে আসছে, তখন পাটপণ্য বানিয়ে আমরা কোথায় বিক্রি করব?”

এ প্রসঙ্গে বন্ধ হয়ে যাওয়া আদমজী পাটকলের কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “কত কান্নাকাটি হল, কিন্তু সেখানে এখন পাটকলের জায়গায় ইপিজেড করা হয়েছে। সেখানে কত শ্রমিকের কর্মসংস্থান হল, তারা আমাদের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে।

“আগে তো চাহিদার কথা ভাবতে হবে, বাজারের কথা ভাবতে হবে। তারপর না হয় পিপিপির কথা ভাবা যাবে। এখন সরকার যে পিপিপির কথা ভাবছে, আমার মনে হয় না, তা সাকসেসফুল হবে।”

বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতির মহাসচিব অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান মনে করেন, লোকসানের ভার বইতে না পেরেই সরকারকে পিপিপির কথা ভাবতে হয়েছে, আর মুক্ত বাজার অর্থনীতির বাস্তবতায় তা ‘যথাযথ’।

“আন্তর্জাতিক বাজার অনুযায়ী কিন্তু আমরা সরবরাহ দিতে পারছিলাম না। উৎপাদন খরচের সঙ্গে সমন্বয় করে মুনাফার বিষয়টিও আসে। সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে সরকারের পক্ষে যে দীর্ঘ ক্ষতি, তা আর বহন করা সম্ভব না আসলে।”

আখতারুজ্জামানের মতে, পাট খাতকে বাঁচাতে বেসরকারি খাতকেই এখন এগিয়ে আসতে হবে। তবে পিপিপিতে গেলেও দুই থেকে তিন বছর সময় লেগে যাবে। এই সময়ে পাট পণ্যের বাজার কীভাবে চাঙ্গা রাখা যাবে, সে পরিকল্পনাও সরকারকে নিতে হবে।