বন্যা দীর্ঘায়িত হচ্ছে কেন?

দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তিন দফা বন্যায় কোথাও কোথাও মানুষের পানিবন্দি দশা চলছে টানা ৪০ দিন; তারপরেও এখনই এই দুর্যোগ কাটছে না বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

মঈনুল হক চৌধুরী জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 August 2020, 03:54 PM
Updated : 9 August 2020, 06:00 PM

দীর্ঘমেয়াদি বন্যার জন্য মানবসৃষ্ট কারণকেও দুষছেন তারা। সেই সঙ্গে আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্যা মোকাবেলার প্রস্ততি নেওয়ার পরামর্শ এসেছে তাদের দিক থেকে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, দেশের ৮টি নদীর ১১টি পয়েন্টে এখনও পানি বয়ে যাচ্ছে বিপৎসীমার উপর দিয়ে।

ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা ও মেঘনা অববাহিকায় নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। রাজধানী ঢাকার আশপাশের নদীর পানিও নামছে।

তবে তাতে খুব আশাবাদী হতে পারছেন না বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বন্যার পানি যেটা স্বাভাবিকভাবে চলে যেত সে অবস্থাটা আমরা রাখিনি। পানি এখন কমছে। কিন্তু আরও এক দফা ভারি বৃষ্টি হতে পারে। ১৩ অগাস্টের পরে আরেকবার ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। ফলে পানি এখনই পুরোপুরি নামবে না। আরও কিছু দিন বন্যার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।”

অগাস্ট-সেপ্টেম্বরের অবস্থা এখনই বলা না গেলেও আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলছে, বৃষ্টি সামনে বাড়তে পারে।

অধ্যাপক সাইফুল বলেন, এ মৌসুমে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রস্তুত থাকতে হবে। যশোর, কুষ্টিয়া, রাজশাহীর মত যেসব জায়গায় এবার বন্যা হয়নি, সেসব এলাকাতেও সামনে শঙ্কা থাকছে, কারণ গত বছর গঙ্গায় বন্যা এসেছিল অক্টোবরের দিকে। 

মৌসুমি বায়ু বেশি সক্রিয় থাকায় এবার বর্ষায় ভারি বর্ষণ হয়েছে। তাছাড়া মানুষ নদীর গতিপ্রকৃতি বদলে দেওয়ায় আটকে থাকা পানি নামতে দেরি হচ্ছে। আর সে কারণেই মানুষকে দেড় মাস ধরে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বলে বুয়েটের এ অধ্যাপকের ধারণা।

বন্যায় ডুবে গেছে ঘর; খুলে রাখা হয়েছে ঘরের বেড়া। সহায় সম্বল নিয়ে দুশ্চিন্তায় লৌহজং উপজেলার বেজগাঁও ইউনিয়নের বাসিন্দা ওজিফা আর মনি । ছবি: মাহমুদ জামান অভি

ভূগোল ও পরিবেশের শিক্ষক নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এবারের মৌসুমে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি, হয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে। আর সাম্প্রতিককালে নদীগুলোতে তলানি জমছে বেশি। নদীর প্রবাহ ক্ষমতা কমে গেছে। তাই বৃষ্টি বেশি হলেই প্লাবন হচ্ছে, সময়মত পানিটা নেমে যেতে পারছে না।”

এ ভূগোলবিদ বলেন, বন্যার চেয়ে বেশি ক্ষতি করছে নদী ভাঙন; দীর্ঘ সময় ধরে বন্যার কারণে ভাঙনও বাড়ছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এরইমধ্যে ঢাকা, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, মুন্সীগঞ্জ, রাজবাড়ী, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, জামালপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, পাবনা, রংপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলার নিম্নাঞ্চল বন্যায় প্লাবিত হয়েছে।

এসব জেলার ১৬৩টি উপজেলার এক হাজার ৭৩টি ইউনিয়নের ১০ লাখ ১৭ হাজার ৯১৪টি গ্রাম বন্যায় দুর্গত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৫৪ লাখ ৬০ হাজার ২৯১ জন।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (প্ল্যানিং) সাইফুল হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ বছর বন্যার চরিত্রটা ভিন্ন রকম। ভাঙনটা বেশি হচ্ছে। আগে চাঁদপুর এলাকায় ভাঙন বেশি হত, এখন তা শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুরসহ অনেক জায়গায় বেড়েছে।”

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ নিয়ে অভিজ্ঞতা তুলে ধরে এ কর্মকর্তা বলেন, দেশের মধ্যাঞ্চল একটা ‘থালার মতো’। বন্যার পানি নেমে যায় সাধারণত এক সপ্তাহের মধ্যে। কিন্তু পশ্চিমা লঘুচাপের প্রভাবে ভারী বর্ষণ, অমাবস্যা-পূর্ণিমার প্রভাব, সাগরে সতর্ক সংকেত থাকলে পানি নামার গতি কম থাকে।

“সেই সঙ্গে নদীর প্রবাহে মানুষের হস্তক্ষেপ কিংবা প্রকৃতিকে স্বাভাবিকভাবে চলায় বাধা এলে তার দুর্ভোগও পোহাতে হয়।”

২৫ জুলাই নাসার স্যাটেলাইট থেকে তোলা এই ছবিতে বাংলাদেশের বন্যার চিত্র

রাজধানীর আশপাশে সমস্যা কোথায়?

বুয়েটের অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, ঢাকা শহরে এক সময় ৫২টি খাল ছিল। সিটি করপোরেশন, ওয়াসা, রাজউক বলছে, এখন ২২-২৩টা রয়েছে। অর্ধ শতাধিক খাল দিয়ে পানি যদি একসঙ্গে নেমে যেত তাহলে জমে থাকত না।

“নদী-নালা ভরে ফেললে বন্যার দুর্ভোগটা বাড়ে। শুধু বৃষ্টির জন্যই বাড়ে তা নয়, পানি বের করে দেওয়ার অবস্থা তৈরি করে দিতে হবে।”

চলমান বন্যার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ঢাকার আশপাশে বন্যার পানি নামতে আরও এক সপ্তাহ লাগবে। সাভার, কেরানীগঞ্জ, দোহার, মানিকগঞ্জে পানি সহজে নামছে না। অন্য জায়গায় দ্রুত পানি নেমে গেলেও ঢাকায় সময় লাগবে বেশি।

“প্রচুর রাস্তাঘাট হয়েছে, পানি বেরিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়নি সেভাবে, ফলে পানি আটকে থাকছে। প্লাবনভূমিতে প্রচুর পানি ঢুকে গেছে, সেখান থেকে পানি সরতে সময় লাগছে। এখন যদি ঘাসের প্লাবনভূমি থাকত, পানি নেমে যেত। কিন্তু তার বদলে বিভিন্ন পকেট তৈরি হয়েছে।”

বন্যা ব্যবস্থাপনায় ‘আমাদের অবস্থা ভালো না’ বলে মত দেন বুয়েটের এই শিক্ষক।

তিনি বলেন, “ঢাকা ও এর আশপাশে যেসব জলাভূমি ছিল সব ভরে ফেলা হয়েছে। যেখানে পানি থাকলে স্বচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করা যেত, এখন সবখানে বাড়ি। সবই আরবান এরিয়া, ফ্যক্টরি- পানি যাবে কোথায়? পানি হয় নদীতে যাবে না হয় আশপাশে জমে থাকবে।… এটাই সমস্যা।”

দীর্ঘায়িত বন্যার পেছনে কী?

আবহমানকাল ধরে বাংলাদেশে বন্যা হচ্ছে। কোন বছর পরিস্থিতি কতটা খারাপ হবে তা দেশের ভেতরকার বর্ষাকালের প্রকৃতি এবং উজানে ভারতের পশ্চিমাংশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণের উপর নির্ভর করে।

সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুলের মতে, বন্যার কারণ আবহাওয়া ও জলবায়ুজনিত। তবে বন্যার স্থায়িত্ব বাড়ার পেছনে বড় কারণ নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি, যেটা মানবসৃষ্ট।

“সবখানেই বাধা পাওয়ার কারণে সাগরে পানি নেমে যাওয়ার গতিটা কমে গেছে। অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে আঞ্চলিকভাবে শহরের ভেতরে এখন বন্যাটা হচ্ছে।”

অধ্যাপক সাইফুলও বলেন, বাংলাদেশে বন্যা হবে, পানি জমবে এটাই স্বাভাবিক। বন্যা অস্বাভাবিক রূপ নেয় তখনই, যখন বৃষ্টি বেশি হয়। আর পানি নামার পথে বাধা পেলে তা বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হয়।

এবার ঘূর্ণিঝড় আম্পানের সময়ের ভারি বৃষ্টিতে অনেক জলাভূমি ভরা ছিল। লঘুচাপও ছিল, যার ফলে মে মাসে বৃষ্টি ছিল বেশি। তাছাড়া মৌসুমি বায়ু এবার সক্রিয় ছিল বেশি। উজানের এলাকা নেপাল, আসাম, মেঘালয়, অরুণাচলে বেশি বৃষ্টি হয়েছে।

“উজানে এবার ১০ দিনে ২০০০ মিলিমিটার বৃষ্টিও হয়েছে কোনো স্টেশনে। এ ধরনের তীব্র বৃষ্টি হলে ভাটিতে বন্যা হবেই। জুলাই মাসে বাংলাদেশের পাশাপাশি আসাম, ভুটান, চীনে প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। এ পানি তো বহ্মপুত্র অববাহিকা দিয়েই নামে।”

আর পানি নামার এই পথে গত এক দশকে নগরায়ন বেশি হয়েছে। ফলে পানিটা নদী-নালায় সহজে যাচ্ছে না। আগে চারদিকে ডোবা ছিল, জলাধার ছিল। মাটি অনেক বেশি পানি টেনে নিতে পারত। এখন সেসবও কমে গেছে।

“নদী তীরবর্তী প্লাবনভূমিও কমে গেছে। আগে যেসব জায়গায় পানি এসে জমা হয়ে থাকত। এখান সেখানেও আবাসন হচ্ছে।”

কুড়িপাড়া গ্রামের বেশিরভাগ টিউবওয়েল তলিয়ে গেছে বন্যার পানিতে। ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান

অধ্যাপক সাইফুল বলেন, নদীতে বাঁধ দেওয়া হয়েছে প্রচুর; ব্রিজ, ড্যাম, ব্যারেজ তৈরি করা হয়েছে। তলদেশও অনেক জায়গায় ভরে গেছে। প্রবাহ না থাকায় নদী মরে যাচ্ছে। শীতকালে অনেক নদী পানিশূন্য হয়ে পড়ছে।

“খাল হচ্ছে জলাধার। খালই যদি না থাকে, পানি নামবে কীভাবে? গত ১০-২০ বছরে সবখানে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। নগরায়ণ করতে গিয়ে প্লাবনভূমি দখল হয়েছে, বন উজাড় হচ্ছে যত্রতত্র। তাতে পানি ধরে রাখার পরিবর্তে ক্ষয় বাড়ছে। শিকড়সহ মাটি আলগা হয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো এলাকায় পাথর উত্তোলন বেড়েছে। ক্ষয়টা তরান্বিত হচ্ছে।”

বন্যার ধরন বদলানোর পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনের ভূমিকা কতটুকু?

বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, “জলবায়ু পবির্তনের প্রভাবকে আমরা স্টাডি হিসেবে দেখছি, ফাইনাল করতে পারিনি। বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা বলছে, দক্ষিণ এশিয়ায় এটি অনেক সক্রিয় হবে।”

তিনি বলেন, “বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বন্যা ও বৃষ্টি বেশি হবে। এখন আমরা যেটা দেখছি, সেটা আলামত হিসেবে ভাবা যায়। গত ৫ বছরে চারবার কিছুটা বড় আকারে বন্যা দেখলাম- ২০১৬, ২০১৭, ২০১৯ ও এবার। এর আগে বন্যাগুলো এত ঘন ঘন হয়নি।”

চরবাটিয়া গ্রামের আরেকটি বাড়ির একই দশা। এ বাড়িটিও তলিয়ে যাওয়ায় কয়েকটি পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন নৌকায়। ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান

বাঁচতে হলে বাঁচাতে হবে নদী

নগর গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান ও ইউজিসিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, পঞ্চাশের দশক থেকেই দেশে বন্যা ব্যবস্থাপনায় পরিকল্পনা রয়েছে, আশির দশকেও হয়েছে। এখন সরকার সুপার মেগা প্রজেক্ট ‘বদ্বীপ পরিকল্পনা’ নিয়েছে।

“বন্যা বাস্তব ঘটনা। নদীকে টিকিয়ে রাখা, জলাশয় বাঁচিয়ে রাখা, জলাধার ধরে রাখা- এসব থাকলে প্লাবনটা কম হয়। যেভাবে হোক, নদীর পানি প্রবাহ ঠিক রাখতে হবে।”

সেজন্য ব্যাপক ড্রেজিংয়ের সুপারিশ তুলে ধরে তিনি বলেন, “বড়-মাঝারি-ছোট নদীতে ড্রেজিং করার কথা আছে বদ্বীপ পরিকল্পনায়, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। আরও বেশি গুরুত্ব দিয়ে বাস্তবায়নের দিকে যেতে হবে। বাস্তবায়নটা সঠিকভাবে করতে হবে।”

এ পরিবেশবিদ বলেন, “নদী দখল হওয়া চলবে না। কোনো অবস্থায় ইজারাও দেওয়া যাবে না। দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীল পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে।”