বন্যার ধরন কী বদলে যাচ্ছে?

উজানের ঢলে এক মাস সময়ের মধ্যে তিন দফা বন্যার কবলে পড়েছে দেশের বিস্তীর্ণএলাকা, ব্যপ্তির বিচারে আগের অনেক বন্যার চেয়ে কম ভয়ঙ্কর হলেও এবারের বন্যার গতি-প্রকৃতি ‘কিছুটা ব্যতিক্রম’ বলে মনে করছেন একজন বিশেষজ্ঞ।

মঈনুল হক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 July 2020, 02:42 PM
Updated : 26 July 2020, 05:46 PM

বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলছেন, প্রচুর রাস্তাঘাট আর অবকাঠামোগত উন্নয়ন হওয়ায় নদীর মুখ অনেক জায়গা ভরাট হয়ে গেছে। তাতে বন্যা আর আগের মত বেশি এলাকায় না ছড়িয়ে অববাহিকায় আটকে থাকছে, তাতে বন্যার স্থায়িত্ব বাড়ছে।   

“এবারের বন্যায় বেশ কিছু নতুন চিত্র আমরা দেখতে পাচ্ছি। আগে বন্যা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ত। এখন বন্যার গতিপথও আগের চেয়ে কিছুটা বদলে গেছে বলে মনে হচ্ছে।”

বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, উজানের দেশ নেপাল, ভারত ও ভুটান থেকে বাংলাদেশের তিনটি প্রধান নদী গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা হয়ে মে থেকে অক্টোবরের মধ্যে ৮ লাখ ৪৪ হাজার কোটি কিউবিক মিটার পানি প্রবাহিত হয়, যা বার্ষিক মোট প্রবাহের এটি ৯৫ শতাংশ।

উজানে বৃষ্টিপাত বেশি হলে সেই পানি সাগরে যাওয়ার পথে নদীর তীর ছাপিয়ে প্লাবিত করে বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চল।

ফলে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা এবং মেঘনা অববাহিকার মোটামুটি ২৬ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা প্রতিবছরই বর্ষা মৌসুমে প্লাবিত হয়, যা দেশের মোট ভূখণ্ডের ১৮ শতাংশের মত।

তিন বছর আগেও বন্যায় দেশের ৪২ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। আর এবারের বন্যা মৌসুমে এখন পর্যন্ত দেশের অন্তত ৩১ শতাংশ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে বলে জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সাইফুল ইসলাম বলেন, “সে হিসেবে এবারের বন্যার ব্যাপ্তি ততটা মারাত্মক হয়নি। কিন্তু স্থায়িত্ব বেড়ে যাওয়ায় মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। দীর্ঘ সময় বন্যা থাকলে বাঁধ টেকে না, মাটিও নরম হয়ে যায়। পানি যখন নামে, তখন পাড় ভাঙে বেশি। ফলে এবার ভাঙন মারাত্মক আকার নিতে পারে।”

চলতি মৌসুমে বন্যা শুরু হয়েছিল গত ২৬ জুন। প্রথম ধাপে অন্তত ১০টি জেলায়, দ্বিতীয় ধাপে আরও আটটি জেলায় বিস্তার ঘটে বন্যার। ২৬ জুলাই পর্যন্ত সব মিলিয়ে দেশের ৩১ জেলার নিম্নাঞ্চল তিন ধাপে প্লাবিত হয়েছে বলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।

অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, ১৯৮৮, ১৯৯৮ ও ২০০৭ সালে দেশে বড় বন্যা হয়েছে। সেগুলোর তুলনায় এবারের বন্যার ধরনে ভিন্নতা রয়েছে বেশ কিছু দিক দিয়ে।

আবার সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে ২০১৬, ২০১৭ ও ২০১৯ সালের বন্যার সঙ্গে অনেক দিক দিয়ে মিল রয়েছে। সে কারণেই তার মনে হচ্ছে, দেশে বন্যার চরিত্র হয়ত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা পাল্টে যেতে শুরু করেছে।

 

বন্যার সময়, ব্যাপ্তি

গেল বছর ১২ জুলাই বন্যা শুরু হয়েছিল। এবার শুরু হয় ২৬ জুনের দিকে। গতবার দুই-তিন দফা বন্যা হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এমনিতে প্রতিবার বন্যা ১০ থেকে ১৪ দিনের মত স্থায়ী হয়, পরে পানি নেমে যায়। কিন্তু এবার দুই ঢলের মাঝে সময়ের ব্যবধান কম হওয়ায় ইতোমধ্যে টানা বন্যার তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে।

বাংলাদেশের ইতিহাসের বড় বন্যাগুলোর মধ্যে ১৯৮৮ সালের বন্যা হয়েছিল অগাস্ট সেপ্টেম্বর সময়ে। বছরের একই সময়ে হয়েছিল ১৯৯৮ সালের বন্যাও। আর সাম্প্রতিক সময়ে ২০১৭ সালের বন্যা শুরু হয়েছিল জুলাই মাসে।

অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, “এবারের বন্যার গতি-প্রকৃতি দেখে মনে হচ্ছে একটু আগেই শুরু হয়েছে। বন্যার সিজনটা এগিয়ে এলো কিনা- বুঝতে পারছি না। দেশের উজানেও বন্যা তুলনামুলক আগে শুরু হল।”

১৯৮৮ সালের বন্যায় দেশের ৬১ শতাংশ এলাকা দুই মাস ধরে, ১৯৯৮ সালের বন্যায় ৬৮ শতাংশ এলাকা এক মাস ধরে প্লাবিত ছিল।

এবারের বন্যায় ইতোমধ্যে এক মাস পেরিয়ে গেছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, চলমান বন্যা পরিস্থিতি জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। অগাস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে ক্রমান্বয়ে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।

দেশের নদ-নদীগুলোতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১০১টি পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে ৪৪টি পয়েন্ট রোববারও পানি বাড়ছে; কমছে ৫৪টি পয়েন্টে। ১৮টি নদীর ২৮টি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার উপরে বয়ে যাচ্ছে।

অধ্যাপক সাইফুল বলেন, “১৯৯৮ সালে দুই মাসের বন্যা দেখেছি। তারপরে এবার এত লম্বা সময়ের বন্যা...। ব্যাপ্তিটা অত বড় না, কিন্তু ডিউরেশনের দিক থেকে এটাও বড় বন্যা।”

বড় অববাহিকায় আটকে বন্যা

বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের এই শিক্ষক বলেন, এবারের বন্যা চলছে মূলত কিছু জেলার নিম্নাঞ্চলে; ১৯৯৮ সালের মত অনেক জেলায় ছড়াচ্ছে না।

যমুনা ও পদ্মার দুই তীর এবং তিস্তা, ধরলা, দুধকুমারের ধারে যেসব জেলায় এবার বন্যা হচ্ছে, সেসব এলাকায় ২০১৬, ২০১৭ ও ২০১৯ সালেও হয়েছে।

“কিন্তু অন্য জায়গায় ছড়াতে পারছে না, কারণ প্রচুর রাস্তাঘাট হয়েছে। নদীর শাখা উপ শাখার মুখগুলো ভরে গেছে। বন্যা বড় নদীর অববাহিকায় রয়ে গেছে। সারা দেশে ছড়াচ্ছে না। যেখানে হচ্ছে, বন্যা দীর্ঘায়িত হচ্ছে।”

বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম

আর দীর্ঘায়িত বন্যার প্রভাবে এবার নদী ভাঙন বেশি হবে বলে মনে করছেন অধ্যাপক সাইফুল।

তিনি বলছেন, এবার পানি নেমে গেলেই যে আর বন্যা হবে না, তেমন ধরে নেওয়ারও কোনো কারণ নেই। 

“ঐতিহাসিকভাবে অগাস্ট-সেপ্টেম্বর সময়ে আমাদের দেশে বড় বন্যা হয়। এখনকার বন্যা আর কত দিন চলবে আমরা কিন্তু বলতে পারছি না। গঙ্গাতেও বন্যা আসার আশঙ্কা রয়েছে, তবে সেটা অগাস্টে বোঝা যাবে।”

তিনি জানান, বিহারের বিস্তীর্ণ এলাকায় এবার বন্যা হয়েছে। ভারি বর্ষণ হচ্ছে উজানের বিভিন্ন এলাকায়। সেই পানি এখন গঙ্গায় আসছে। ফারাক্কা পয়েন্টে পানি বাড়ছে। সেখানে ইতোমধ্যে বিপৎসীমা ছাড়িয়েছে। ভাটিতে পদ্মার পানি বাড়ছে একটু ধীরে। রাজশাহী পয়েন্টে এখনও বিপৎসীমার দেড় মিটার নিচে রয়েছে।

“দক্ষিণ এশিয়ায় পূর্বাভাস হচ্ছে- বন্যা, বৃষ্টি এবার বাড়বে। সেটা এখনই শুরু হয়েছে কিনা তা ভাবা দরকার। গত কয়েক বছর ধরে দুর্যোগের সংখ্যা ও মাত্রা আমরা বাড়তে দেখেছি। এটা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কিনা সেটা আরও সমীক্ষার বিষয়।”

ঢাকার আশপাশে পানি আবার

অধ্যাপক একেএম সাইফুল ইসলাম জানান, ২০০৭ সালের পরে ঢাকার দিকে বন্যা তেমন আসেনি; আশপাশের নদ-নদীর পানিও বিপৎসীমা ছাড়ায়নি।

“এবার ডেঞ্জার লেভেল ক্রস করছে, কারণ উত্তরে বন্যা দীর্ঘায়িত হওয়ায় ধীরে ধীরে ঢাকার আশপাশেও এর প্রভাব পড়ছে। আমার ধারণা, প্রচুর রাস্তাঘাট আর অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে; নদীর মুখ, যেখান থেকে পুরাতন বহ্মপুত্রের পানি আসত, সেখানে অনেক জায়গা ভরাট হয়ে গেছে। তাতে পানি এদিকে কম ঢুকছে, ফ্লাড ওয়াটার আসলে মুভ করতে পারেনি।”

তিনি জানান, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে সাম্প্রতিক সময়ের বড় বন্যা হলেও পানি বহ্মপুত্র-যমুনা এবং পদ্মা থেকে নেমে বঙ্গোপসাগরে চলে গেছে। ফলে ঢাকার দিকে প্রভাব পড়েনি।

“ল্যান্ড ইউজ ইন্টারভেনশনের জন্য নদীতে চর পড়ে মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিনটা বন্যায় আমরা দেখেছি পুরাতন বহ্মপুত্র থেকে আশপাশের নদীগুলোতে (তুরাগ, টঙ্গীখাল, বালু, বুড়িগঙ্গা) পানি অতটা আসেনি। কিন্তু এবার উজানে দীর্ঘদিন পানি থাকায় গ্র্যাজুয়েলি চলে আসছে।”

সাইফুল ইসলাম বলেন, ঢাকার পূর্ব দিকটা এক কথায় অরক্ষিত। সেখানে বাঁধ নির্মাণ করা দরকার। কিন্তু সেটা করলে আবার পয়ঃনিষ্কাশনে সমস্যা হবে।

“শুধু ঢাকা নয়, বড় শহরগুলোর অবস্থা একই। পানি নেমে যাওয়ার স্কোপ নেই। নদীর তলদেশ ভরে যাচ্ছে। সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্টর দিকে জোর দিতে হবে। যেখানে সেখানে আমরা ময়লা ফেলছি। নির্মাণ সামগী রাস্তার উপরে...।

“ঢাকার পশ্চিমের খালগুলো খেয়ে ফেলেছে। খালগুলো স্বাভাবিকতা রেখে, জলাধার রেখে কাজ করতে হবে। না হয় জলবদ্ধতা সমস্যা বাড়বে।”

দেশে বন্যা ব্যবস্থাপনায় অনেক বিষয়ে ‘ঘাটতি’ দেখতে পাচ্ছেন অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম।

তিনি বলেন, এবার দেখা যাচ্ছে, অনেক জায়গায় যদি বাঁধ না ভাঙত, সেসব জায়গায় পানি ঢুকত না। খুব কম জায়গা রয়েছে বাঁধ উপচে পানি ঢুকেছে।

“অনেক জায়গায় ভালো, কিছু জায়গায় নড়বড়ে অবস্থা। অনেক জায়গায় বাঁধ করা হয়েছে নদীর খুব কাছাকাছি। বাঁধের বিষয়ে সরকারের চিন্তাভাবনা করতে হবে।”