মা দিবসের নিবন্ধ
এ উপন্যাসগুলোতে বাকি সব প্রকরণ ছাপিয়ে কেবল মা ও মাতৃত্ব প্রধান চরিত্র হিসেবে ধরা দিয়েছে।
Published : 11 May 2024, 01:14 AM
উপমহাদেশে জননীরূপে মায়ের আসন সর্বকালেই শ্রদ্ধার ও সম্মানের। এখানে সনাতন ধর্মসাধনার কেন্দ্রভূমিতে রয়েছে মাতৃমহিমা। পরিবারের কেন্দ্রে থেকে মায়ের স্নেহ-প্রেম-মমতা এখানে অগ্রগণ্য। মায়ের গর্ভ থেকে যে মাটিতে আমরা ভূমিষ্ঠ হই, তাকেই বলি মাতৃভূমি।
বাংলাসহ পৃথিবীর নানা ভাষার সাহিত্যে মায়ের কথা এসেছে নানাভাবে। এখানে ১০টি উপন্যাসের কথা বলা হয়েছে, যেখানে বাকি সব প্রকরণ ছাপিয়ে কেবল মা ও মাতৃত্ব প্রধান চরিত্র হিসেবে ধরা দিয়েছে।
মা, মাক্সিম গোর্কি
রুশ কথাসাহিত্যিক মাক্সিম গোর্কির (১৮৬৮-১৯৩৬) উপন্যাস ‘মা’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯০৬ সালে। পৃথিবীর বহু ভাষায় এটি অনূদিত হয়েছে। মস্কোর রাদুগা প্রকাশন ও প্রগতি প্রকাশন থেকে প্রকাশিত এ বইটির বাংলা অনুবাদ করেছেন পুষ্পময়ী বসু। অক্টোবর বিপ্লবের আগের রাশিয়া এর পটভূমি। এ উপন্যাসে মা পেলেগেয়া নিলোভনা মাতাল স্বামীর অত্যাচারের মধ্যে ছেলে পাভেলকে নিয়ে অনাহারে-অনাদরে জীবনযাপন করতে থাকেন। বাবা মারা যাওয়ার পর পাভেল বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন, তার বাড়িতে বই ও আদর্শিক বন্ধুরা আসতে শুরু করে। পাভেল জেলে যাওয়ার পর মা নিজেই ইশতেহার বিলি শুরু করেন, হয়ে ওঠেন সব বিপ্লবীদের মা।
মা, অনুরূপা দেবী
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সময়ে অন্যতম জনপ্রিয় বাঙালি কবি ও ঔপন্যাসিক অনুরূপা দেবীর (১৮৮২-১৯৫৮) উপন্যাস ‘মা’, এটি প্রকাশিত হয় ১৯২০ সালে। এ উপন্যাসে বেশ কয়েকজন মায়ের দেখা পাওয়া যায়। সেকালের সমাজের প্রতিনিধি স্থানীয় বহু মা চরিত্র অঙ্কন করেছেন অনুরূপা দেবী। উপন্যাসে অরবিন্দের দুই স্ত্রী, মনোরমা ও ব্রজরাণী। মনোরমা তৎকালীন সমাজ-কাঙ্খিত আদর্শ স্ত্রী ও আদর্শ মা। স্বামীর পিতৃসত্য রক্ষা ও স্ত্রীকে পরিত্যাগ করলেও মনোরমা স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেনি। শেষ দৃশ্যে মা ব্রজরাণী সাত বছর পর অধীর হয়ে মনোরমার ছেলে অজিতের ‘মা’ ডাক শোনেন। নাট্যকার অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এ উপন্যাসটিকে নাট্যরূপ দেন। মঞ্চে নাটক হিসেবেও এটি দর্শকপ্রিয়তা পায়। ‘মা’ শিরোনামে অনুরূপা দেবীর একটি ছোটগল্পও রয়েছে।
মা, গ্রাৎসিয়া দেলেদ্দা
ইতালিয়ান ঔপন্যাসিক গ্রাৎসিয়া দেলেদ্দার (১৮৭২-১৯৩৬) ‘লা-মাদ্রে’ (মা) উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২০ সালে। ১৯২৬ সালে মূলত এ উপন্যাসের উৎকর্ষের বিচারে তিনি নোবেল পুরস্কার পান। ১৯৪৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের ‘বেঙ্গল পাবলিশার্স’ এটি বাংলায় প্রকাশ করে, অনুবাদক ঋষি দাস। তারপর ১৯৮৬ সালে আবদুল হাফিজের অনুবাদে বইটি বাংলাদেশে প্রকাশ করে ‘ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড’ (ইউপিএল)।
এ উপন্যাসের কাহিনি গড়ে উঠেছে এক যাজক ও তার মাকে নিয়ে। অপরিসীম কষ্ট স্বীকার করে মা তার ছেলে পলকে বড় করেছেন। বড় হয়ে পল যাজকত্ব গ্রহণ করেন। এ অতি কঠিন দায়িত্ব। মায়ের মনে সদাই ভয়, পল তার কর্তব্যের সীমা পেরিয়ে পাপের পথে যেন পা না বাড়ায়। কিন্তু সুন্দরী এজনিসের সঙ্গে দেখা হয় পলের। একদিকে কর্তব্য ও অন্যদিকে প্রেমের আকুতির মধ্য দিয়ে কাহিনি বেড়ে ওঠে। এবং শেষ হয় একটি করুণ মৃত্যুতে। সে মৃত্যু পলের মায়ের।
গ্রেৎসিয়া দেলেদ্দা মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে অসাধারণ। গোটা কাহিনির কেন্দ্রে রয়েছেন মা। অন্যান্য চরিত্রগুলোকে সমান সহানুভূতির সঙ্গে ঔপন্যাসিক নির্মাণ করেছেন। জীবনের দ্বিধা-সংশয় ও আকাঙ্ক্ষাগুলোকে চমৎকারভাবে ধরতে পেরেছেন বলেই এ বই এতখানি সমাদৃত।
মা, পার্ল এস বাক
নোবেল পুরস্কার জয়ী আমেরিকান ঔপন্যাসিক পার্ল এস বাক-এর (১৮৯২-১৯৭৩) ‘দ্য মাদার’ উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৩৪ সালে নিউ ইয়র্ক থেকে। ১৯৫৪ সালে আবদুল হাফিজের অনুবাদে বইটি বাংলায় প্রকাশ করে ‘মুক্তধারা’, প্রচ্ছদশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। এর মূল চরিত্র একজন চীনা মা। ‘মা’ নামেই তার পরিচয়। সমগ্র উপন্যাসে একবার মাত্র ‘অমুকের স্ত্রী’ বলে তার উল্লেখ রয়েছে। কোথাও তার নামের উল্লেখ নেই।
উপন্যাসটি ১৯১১ সালের চীন বিপ্লবের আগে দেশটির গ্রামীণ এক কৃষক নারীর জীবনের পটভূমিতে লেখা। তিনি তার সন্তানদের লালনপালন করতে এবং দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ ও সামাজিক নিপীড়নের বিপরীতে সংগ্রাম করেছিলেন। উপন্যাসটিতে পরিবর্তিত সমাজে মাতৃত্ব, লৈঙ্গিক অসমতা, পরিবার ও স্থানীয় ঐতিহ্য উঠে এসেছে।
জননী, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
ঔপন্যাসিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৯০৮-১৯৫৬) বই আকারে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস ‘জননী’। মনস্তাত্ত্বিক এ উপন্যাসের মূল চরিত্র ‘শ্যামা’। ১৫ বছর বয়সী শ্যামার বিয়ে হয় বিপত্নীক নিঃসন্তান শীতলের সঙ্গে। কিশোরীবধূ শ্যামা মুখোমুখি হন সাংসারিক দ্বন্দ্ব, সামাজিক টানাপড়েন ও নানা সম্পর্কের রহস্যের। ‘বন্ধ্যা’ অপবাদ পাওয়া শ্যামার প্রথম সন্তানটি মারা যায়। ছাপাখানায় চাকরি পাওয়া শীতল চুরির দায়ে ফেরার হন। সন্তানকে নিয়ে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যান শ্যামা।
জননী, শওকত ওসমান
কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমানের (১৯১৭-১৯৯৮) ‘জননী’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৮ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে দেশভাগ এ উপন্যাসের কালপর্ব। এ উপন্যাসে মায়ের নাম দরিয়াবিবি। স্বামীর মৃত্যুর পর সন্তানদের নিয়ে অর্থকষ্টে পড়েন তিনি, আর এসময় সাহায্য করার ছলে তাকে ভোগ করার সুযোগ নেয় ইয়াকুব। দরিয়া ইয়াকুবকে প্রতিরোধ করতে পারে না। অভিমানে মাকে ফেলে চলে যায় ছেলে মোনাদির। বিধবা মা দরিয়াবিবি জন্ম দেন সমাজ ও ধর্মের চোখে ‘অবৈধ’ এক সন্তান, তারপর আত্মহত্যা করেন।
হাজার চুরাশির মা, মহাশ্বেতা দেবী
কথাসাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবীর (১৯২৬-২০১৬) উপন্যাস ‘হাজার চুরাশির মা’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭৪ সালে। সত্তরে পশ্চিমবঙ্গের নকশাল আন্দোলনকে কেন্দ্র করে লেখা এ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র একজন মা, যার নাম সুজাতা। স্বামী ও শ্বাশুড়ির অত্যাচারের মধ্যে চার সন্তান নিয়ে সুজাতার সংসার। মাতাল স্বামী দিব্যনাথ তাকে সন্তান জন্মদানের যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই ভাবেননি, প্রসবকালেও সুজাতা পাশে পায় না কাউকে। শেষে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে সে। তার বিপ্লবী ছেলে ব্রতী রাষ্ট্রীয় হত্যার শিকার হন, তার লাশের নাম্বার হয় ১০৮৪। সুজাতার পরিচয় দাঁড়ায় ‘১০৮৪-এর মা’ বলে। উপন্যাসটি নিয়ে চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে, যাতে সুজাতার চরিত্রে অভিনয় করেছেন জয়া বচ্চন।
লেটার টু অ্যা চাইল্ড নেভার বর্ন, ওরিয়ানা ফাল্লাচি
উপন্যাস শুরু হয় জরায়ুতে বেড়ে উঠা ভ্রূণের সঙ্গে তার অবিবাহিত মায়ের কথোপকথনের মাধ্যমে। মা, তার সন্তানের আগমন নিয়ে দ্বিধায় ভোগেন। এমন অন্যায্য ও অপরাধসংকুল পৃথিবীতে নতুন একটি মানুষকে নিয়ে আসা কি উচিত? তার আগে কি শিশুটির অনুমতি নেওয়া হয়েছে, সে আসলেই পৃথিবীতে আসতে চায় কিনা? ‘লেটার টু অ্যা চাইল্ড নেভার বর্ন’ শিরোনামে ইতালিয়ান সাংবাদিক ও লেখক ওরিয়ানা ফাল্লাচির (১৯২৯-২০০৬) এ উপন্যাস প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালে। ‘হাত বাড়িয়ে দাও’ শিরোনামে বইটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ।
মা, আনিসুল হক
একাত্তরের ঢাকায় গেরিলা গ্রুপ ‘অপারেশন ক্র্যাক প্লাটুন’ এর অন্যতম সদস্য ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা মাগফার আহমেদ চৌধুরী (আজাদ)। তাকে নিয়ে মা সাফিয়া বেগম থাকতেন পুরান ঢাকার একটি বাড়িতে। সেই বাড়ি থেকে আজাদকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানিরা। কিন্তু নির্যাতনের মুখেও আজাদ কখনও তাদের তথ্য দেননি।
কারাগারে মা দেখা করতে এলে আজাদ নির্যাতনের কথা জানায়। এটিই ছিল তাদের মা-ছেলের শেষ সাক্ষাৎ। স্বাধীন দেশে ১৪ বছর মা সাফিয়া বেগম ভাত না খেয়ে, খাটে না শুয়ে মাটিতে মাদুর বিছিয়ে শুতেন। কারণ তার ছেলেকে জেলখানায় মাদুরে শুতে হতো। মুক্তিযুদ্ধের এ সত্য ঘটনা নিয়ে কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের উপন্যাস ‘মা’, প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে সময় প্রকাশন থেকে। গত প্রায় ২০ বছরে এটি ১০০তম মুদ্রণ পেরিয়েছে।
অ্যা ওম্যান’স স্টোরি, অ্যানি আরনো
২০২২ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ফরাসি লেখক অ্যানি আরনো। তার মা নরম্যান্ডি শহরের উপকণ্ঠে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং আলঝেইমার্স রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন প্যারিসের শহরতলির একটি হাসপাতালের জেরিয়াট্রিক ওয়ার্ডে। নিজের মাকে নিয়ে লেখা আরনো তার উপন্যাসের নাম দিয়েছেন “অ্যা ওম্যান’স স্টোরি”, কারণ নিজের মায়ের চেয়ে তাকে তিনি একজন সাধারণ নারী হিসেবে পরিচিত করতে চান। এতে তার মায়ের শৈশব থেকে পুরো জীবন ও মা-মেয়ের সম্পর্ক চিত্রিত হয়েছে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের বিচারে এটি একটি ‘উল্লেখযোগ্য বই’।
এছাড়া আরও যেসব উপন্যাসে মা চরিত্রটি প্রবলভাবে খুঁজে পাওয়া যায়- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বিন্দুর ছেলে’, ‘রামের সুমতি’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গোরা’, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’, হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি’, হুমায়ূন আহমেদের ‘জ্যোৎস্না ও জননীর গল্প’, জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ এবং সেলিনা হোসেনের ‘লারা’ ইত্যাদি।