বন্যা: পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত ৪ হাজার

বন্যা উপদ্রুত বিভিন্ন এলাকায় পানি কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে নানা রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে, এই সময়ে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধেও বিশেষ নজর দেওয়ার পরামর্শ এসেছে একজন বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 July 2020, 05:04 AM
Updated : 20 July 2020, 07:09 AM

চলতি মৌসুমে তিন সপ্তাহের মধ্যে দুই দফা বন্যার মুখোমুখি হয়েছে দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্ব ও মধ্যাঞ্চল। ১৮ জেলার নিম্নাঞ্চলে প্রায় ২৬ লাখ মানুষ দুর্গতিতে পড়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ন্যাশনাল হেল্থ ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেন্টারের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সহকারী পরিচালক ডা. আয়শা আক্তার জানান, ৩০ জুন থেকে ১৯ জুলাই পর্যন্ত উপদ্রুত এলাকায় ডায়রিয়া, চর্মরোগ, চোখের প্রদাহ, শ্বাসনালীর প্রদাহসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়েছেন অন্তত ৪ হাজার ২৪ জন।

এই তিন সপ্তাহে পানিতে ডুবে, ডায়রিয়ায়, সাপের কামড়ে ও বজ্রপাতে ৬৭ জনের মৃত্যুর তথ্য নিয়ন্ত্রণ কক্ষে নথিভুক্ত হয়েছে।

নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. নিয়ামুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুর্গত এলাকায় বিভিন্ন রোগে আক্রান্তদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি ডায়রিয়া রোগী। সামনে আরও হয়ত বাড়বে।”

তিনি জানা, দুর্গত এলাকাগুলোতে তাদের মেডিকেল টিম কাজ করছে। বিশুদ্ধ পানি প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও অন্যান্য ওষুধ বিতরণ করা হচ্ছে।

মহামারীকালে এই বন্যায় দুর্গত এলাকার আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে অনেক মানুষকে রাখতে হচ্ছে। আবার ত্রাণ নিতেও মানুষে ভিড় হবে। এর মধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কেউ থাকলে বা অসচেতন হলে সংক্রমণের নতুন ঝুঁকি তৈরি হবে বলে সতর্ক করেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. মুশতাক হোসেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পানিবন্দি মানুষগুলো হয়ত কম বের হচ্ছে। কিন্তু ত্রাণ শিবিরে লোক জড়ো হবে। বাইরে থেকে ত্রাণবিতরণ কর্মীরা যাবে। সীমিত লোক হলেও তাদের মধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কেউ থেকে থাকলে ছড়ানোর আশঙ্কা থাকেই। এটা উভয়পক্ষকে নজরে রাখতে হবে”।

করোনাভাইরাস মহামারী মোকাবেলায় সরকারকে সহায়তা দেওয়া কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির ডিগ্রিধারী এই চিকিৎসক বলেন, মহামারীর ঝুঁকি মোকাবেলায় দুর্গত এলাকায় কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। হট লাইনে বা স্থানীয়ভাবে যোগাযোগের মাধ্যমে পানিবন্দিদের উপসর্গ তদারকির ব্যবস্থা রাখতে হবে। তাতে কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশনের মাধ্যমে সংক্রমণ ঠেকানোর সুযোগ থাকবে।

ড. মুশতাকের পরামর্শ, আশ্রয়কেন্দ্র ও ত্রাণ শিবিরে যারা আসা-যাওয়া করবেন, তাদের যেমন স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে; তেমনি আশ্রিতদের অবস্থানও ঝুঁকিমুক্ত রাখার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। কারও মধ্যে উপসর্গ দেখা গেলে বা সংক্রমণ ধরা পড়লে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা অন্যত্র সরিয়ে নিতে হবে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, মহামারীকালের এ বন্যায় দুর্গত এলাকায় স্বাস্থ্য বিধির সচেতনতায় যাতে ঢিল না পড়ে, সে বিষয়ে তারা সতর্ক।

মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মহসীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সিভিল সার্জন, স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে সব তদারকি হচ্ছে। এ বিষয়টি বন্যার আগে থেকেই অনুসরণ করা হচ্ছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে আশ্রয় কেন্দ্রের সংখ্যা প্রতিটি এলাকায় বাড়ানো হয়েছে, যাতে গাদাগাদি করে থাকতে না হয়। তাছাড়া তৃণমূল পর্যায়ে আমাদের লোকবলও কাজ করছে”।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান ইতোমধ্যে বলেছেন, কোভিড-১৯ মহামারীর মধ্যে আশ্রয়কেন্দ্রে স্বাস্থ্যবিধি এবং সামাজিক দূরত্বের নিয়ম মেনে চলার পাশাপাশি সবাইকে মাস্ক ব্যবহারের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

বন্যা পরিস্থিতি

দেশের নদ-নদীগুলোতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১০১টি পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে সোমবার সকাল ৯টা পর্যন্ত ৩২টি স্টেশনে পানি কমেছে; ৬৬ টি পয়েন্টে বেড়েছে। এর মধ্যে ১৪টি নদীর ২৪টি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার উপরে বয়ে যাচ্ছিল। তিনটি পয়েন্টে পানির উচ্চতা অপরিবর্তিত ছিল।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের ১০ দিনের দীর্ঘমেয়াদী পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর পানির সমতল কিছুটা কমে সোমবার স্থিতিশীল থাকতে পারে।

তাতে কুড়িগ্রাম, বগুড়া, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, টাঙ্গাইল এবং মানিকগঞ্জ জেলার বন্যা পরিস্থিতি আগামী ২৪ ঘণ্টা প্রায় অপরিবর্তিত থাকবে।

তবে মঙ্গলবারের পর থেকে ব্রহ্মপুত্র-যমুনার পানি আবার বাড়তে পারে এবং ২৭ জুলাই নাগাদ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে।

তাতে ওই সাত জেলার বন্যা পরিস্থিতি আবার অবনতির দিকে যেতে পারে। এই বন্যা চলতে পারে জুলাই মাসের শেষ পর্যন্ত।

মানিকগঞ্জের জাগির স্টেশনে ধলেশ্বরী নদীর পানি সমতল আগামী ৫ দিনের মধ্যে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে।

গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকা এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আপার মেঘনা অববাহিকার নদীগুলোর পানি কমার প্রবণতা রোববারও অব্যাহত ছিল।

রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ পয়েন্ট, মুন্সিগঞ্জ জেলার ভাগ্যকূল পয়েন্ট এবং শরীয়তপুর জেলার সুরেশ্বর পয়েন্টে পানির সমতল আগামী ৪৮ ঘণ্টা স্থিতিশীল থাকতে পারে এবং তারপর আবার বাড়তে পারে। তাতে এসব জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি আগামী ১০ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।

ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর পানির সমতলও আগামী কয়েক দিনে বাড়তে পারে। ঢাকার ডেমরা পয়েন্টে বালু নদী, মিরপুর পয়েন্টে তুরাগ নদী এবং রেকাবি বাজার পয়েন্টে ধলেশ্বরী নদী আগামী ৭ দিনের মধ্যে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে।

নারায়ণগঞ্জে লক্ষ্যা নদীর পানির উচ্চতাও আগামী ৫ দিনের মধ্যে বিপৎসীমা পেরিয়ে যেতে পারে বলে জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।

আরও পড়ুন