সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদকেও ‘সংসদ সদস্যদের গলায় বড়শি’ বলে অনেকে চিহ্নিত করেন। এই অনুচ্ছেদে বলা আছে, কোনো সংসদ সদস্য তার দল থেকে পদত্যাগ করলে অথবা সংসদে দলের বিপক্ষে ভোট দিলে তার সদস্য পদ বাতিল হবে। দলের বিপক্ষে ভোট দেয়া আর জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ভিন্নমত উপস্থাপনও কি দলের বিপক্ষে ভোট বলে বিবেচিত হবে?
Published : 09 May 2024, 06:02 PM
এই সময়ের বাংলাদেশে প্রবীণ রাজনীতিবিদ বললে যাদের নাম সামনে আসবে, টাঙ্গাইলের আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী তাদের অন্যতম। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয়ী গণপরিষদ সদস্য হিসেবে তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেও রাজনীতি করেছেন। আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম প্রেসিডিয়ামের সদস্য ছিলেন। তবে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় তিনি মন্ত্রিত্ব এমনকি দলীয় পদও হারান। সংসদ থেকেও পদত্যাগ করেন। সবশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
সম্প্রতি জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছেন, “যাদের গলায় ‘বড়শি’ লাগানো আছে তারা কথা বলবে না। আমিও ৬০ বছর বলিনি। আজকে আমার গলার থেকে আপনারাই বড়শিটা খুলে নিয়েছেন। তাই আমি যতক্ষণ আছি— আপনি (স্পিকার) যতই বাধা দেন— আমি কথা বলতে চেষ্টা করব।” (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ০৫ মে ২০২৪)।
প্রশ্ন হলো—
১. গলায় বড়শি বলতে লতিফ সিদ্দিকী কী বুঝিয়েছেন?
২. তার বড়শি কে খুলে নিল?
৩. যেহেতু গলায় বড়শি নেই, তাই তিনি এখন কথা বলেই যাবেন মানে কী, তিনি কী বলবেন?
৪. গলায় বড়শি মানে হয় হয় দলীয় পদ, তার মানে কি এই যে, দলীয় পদ থাকলে সংসদে কথা বলা যায় না?
৫. যদি তাই হয় তাহলে তিনি প্রায় ছয় দশক কেন এই বড়শি নিজের গলায় ঝুলিয়ে রাখলেন? অর্থাৎ তিনি কেন বড়শি খুললেন না?
৬. দলীয় পদ নেই বলে তথা দলীয় এমপি নন বলে এখন তিনি কথা বলবেন, তার মানে এতদিন তিনি কথা বলেননি বা যা বলতে চেয়েছিলেন তা বলতে পারেননি?
৭. জনাব সিদ্দিকীর এই ‘বড়শিতত্ত্ব’ বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতি তথা দলের ভেতরে গণতন্ত্র চর্চার যে হাল, সেটিই কি উন্মোচিত করলো?
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদকেও ‘সংসদ সদস্যদের গলায় বড়শি’ বলে অনেকে চিহ্নিত করেন। কেননা এই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে কোন কোন পরিস্থিতিতে সংসদ সদস্যদের পদ বাতিল হবে। এই অনুচ্ছেদের দোহাই দিয়ে এমপিদের কণ্ঠরোধ করা হয় বলে অনেকে মনে করেন। এমনকি সংসদ সদস্যরাও এই অনুচ্ছেদের কারণে সংসদে খোলামেলা কথা বলতে গিয়ে, বিশেষ করে দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণে নিরুৎসাহিত হন। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায়ে আপিল বিভাগও ৭০ অনুচ্ছেদের প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, ‘এই অনুচ্ছেদ সংসদ সদস্যদের বেদনাহত এবং অসংগতভাবে তাঁদের অধিকারকে শৃঙ্খলিত করেছে।’
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বলা আছে, কোনো সংসদ সদস্য তার দল থেকে পদত্যাগ করলে অথবা সংসদে দলের বিপক্ষে ভোট দিলে তার সদস্য পদ বাতিল হবে। এখানে স্পষ্ট বলা হচ্ছে যে, কেউ দলের বিপক্ষে ভোট দিলেই তার সদস্যপদ বাতিল হবে। প্রশ্ন হলো, দলের বিপক্ষে ভোট দেয়া আর জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় এমনকি কোনো আইনের বিষয়ে ভিন্নমত উপস্থাপনও কি দলের বিপক্ষে ভোট বলে বিবেচিত হবে?
বিলের বিপক্ষে অবস্থান মানেই সেটি দলের বিরুদ্ধে অবস্থান বলে বিবেচিত হওয়ার উচিত নয়। দলের বিরুদ্ধে বা বিপক্ষে ভোট দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে কেবল যখন ওই দলের, আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে যদি ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে আনীত অনাস্থা প্রস্তাবের ওপরে ভোটের প্রশ্ন ওঠে। অর্থাৎ সরকারের বাঁচামরার প্রশ্নেই কেবল বিপক্ষে ভোটের প্রসঙ্গ আসার কথা। কেননা, অনাস্থা প্রস্তাবে হেরে গেলে সরকারের পতন হয়। যাতে করে বারবার সরকার বদল না হয় এবং সংসদে অস্থিরতার সৃষ্টি না হয় সে কারণে এই বিধানটি রাখা অন্যায্য নয়। কিন্তু কোনো বিলের বিরুদ্ধে, এমনকি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোনো সরকারদলীয় সদস্য যদি সরকারের কোনো আইন বা নীতির সমালোচনা করেন, তাতে তার সদস্য পদ বাতিল হওয়ার কী কারণ থাকতে পারে?
একাডেমিক্যালি এইসব পরিস্থিতিতে তার সংসদ সদস্য পদ বাতিল হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তারপরও এমপিরা সব সময়ই এই অনুচ্ছেদ নিয়ে একধরনের জুজুর ভয়ে থাকেন। ফলে তারা আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় হ্যাঁ না-এর বাইরে কিছু বলতে চান না। এমনকি জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে দলের বা দলীয় প্রধানের যে অবস্থান, তার বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের কোনো মতামত প্রকাশের সাহস করেন না।
২০১৬ সালের ২৬ এপ্রিল সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকও সাংবাদিকের বলেছিলেন, অসদাচরণের জন্য উচ্চ আদালতের কোনো বিচারককে অপসারণের ক্ষেত্রে সংসদে দলীয় মতের বিপক্ষে ভোট দিতে ৭০ অনুচ্ছেদ কোনো বাধা নয়। বরং ৭০ অনুচ্ছেদের বিধান প্রযোজ্য হবে কেবল সংসদে ওই দলের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবের ক্ষেত্রে। কিন্তু সমস্যা হলো, বছরের পর বছর ধরে আমাদের এটিই গেলানো হচ্ছে যে, ৭০ অনুচ্ছেদ মানে সংসদে দলের সব সিদ্ধান্তের পক্ষে ‘হ্যাঁ’ বলতে হবে। আমি মনে করি, এটি ৭০ অনুচ্ছেদের একধরনের অপব্যাখ্যা।
এবার আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের বাইরে সংসদ সদস্যদের জন্য আরেকটি বড়শির কথা বললেন। যে বড়শিটি মূলত দলীয় পদ। দলীয় কোনো পদে থাকলে বা কোনো দলের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হলে তিনি কথা বলতে পারবেন না—এটি কতটা গণতান্ত্রিক? যদি দলীয় পদ এবং দলীয় এমপিত্বের কারণে একজন সংসদ সদস্য প্রাণ খুলে এবং রাষ্ট্রের যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে নিজের অবস্থান পরিস্কার করতে না পারেন বা ভিন্নমত পোষণেরই সুযোগ না পান—তাহলে সেই সংসদে কী করে গণতন্ত্রের চর্চা হবে আর দলের ভেতরেই বা কী গণতন্ত্র থাকবে?
লতিফ সিদ্দিকী এখন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য বলে খোলামেলা কথা বলবেন। তার মানে এতদিন তিনি নিজের কথাগুলো সংসদে বলতে পারেননি? দলীয় পদ ও দলীয় এমপিত্ব কি তাহলে সংসদ সদস্যদের গলায় বড়শি পরিয়ে রাখে? তার গলা থেকে বড়শিটা কে খুলে নিল?
স্মরণ করা যেতে পারে, লতিফ সিদ্দিকী ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে পান ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। পরে যুক্তরাষ্ট্রে সফরে গিয়ে ঘরোয়া এক আলোচনায় হজ নিয়ে মন্তব্যের জেরে তিনি মন্ত্রিসভা ও দল থেকে বহিষ্কৃত হন। পরে সংসদ থেকে পদত্যাগ করে রাজনীতি থেকেও নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে টাঙ্গাইল-৪ আসনে নির্বাচন করলেও হেরে যান। তবে এবার জিতেছেন।
এখানে বিষয়টা খুব স্পষ্ট যে, লতিফ সিদ্দিকী যে দলীয় পদকে গলার বড়শি বলছেন, সেটি খুলে নিয়েছে তার দলই। খুলে নিয়েছে বলে তিনি এখন নিজেকে নির্ভার মনে করছেন। যদি তাই হয়, তাহলে তার মতো একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ—যিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাজনীতি করেছেন; গণপরিষদ সদস্য ছিলেন, তিনি এই বড়শির বিরুদ্ধে গত ছয় দশকে কোনো কথা বলেছেন?
দলীয় পদ যদি সংসদ সদস্যদের গলায় বড়শি হয়ে থাকে এবং এই বড়শি যদি সত্যিই একজন এমপিকে প্রাণ খুলে কথা বলার ক্ষেত্রে অন্তরায় তৈরি করে, তাহলে একজন সিনিয়র পলিটিশিয়ান হিসেবে তার কী দায়িত্ব ছিল? তিনি কেন ২০১৪ সালের ওই ঘটনার আগে পদত্যাগ করলেন না বা সংসদে এবং দলের ভেতরে গণতন্ত্র চর্চার ক্ষেত্রে অন্তরায়সমূহ দূর করতে স্বপ্রণোদিত হয়ে উদ্যোগ নিলেন না?
তিনি দেশের সবচেয়ে বড় ও প্রাচীন রাজনৈতিক দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামে ছিলেন। অতএব সেই ক্ষমতা ও এখতিয়ার কাজে লাগিয়ে তিনি দেশের রাজনীতি ও সংসদে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বিকাশে কোনো ভূমিকা রেখেছিলেন কি না— সেই প্রশ্নটিও তাকে করা যেতে পারে? তার চেয়ে বড় কথা, তিনি যদি দলীয় পদ হারিয়ে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত না হতেন তাহলে কি ২০২৪ সালে এসেও এই বড়শির কথা স্বীকার করতেন? এটি তার আত্মোপলব্ধি নাকি ক্ষোভ?
তার ভাষায়, “গণতন্ত্রের কথা বলতে গেলে এই সংসদের সময়ের অভাব হয়। কিন্তু হাজার কোটি টাকা ঋণ খেলাপিতে অর্থের অপচয় হয় না। কিন্তু কোনো সদস্য একটু সময় বেশি চাইলেই অভাব হয়।”
একজন সিনিয়র রাজনীতিবিদ যখন এই কথা বলেন, তখন সেটি আমলে নেয়ার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। এই কথার মধ্য দিয়ে দেশের সংসদীয় রীতি ও সংসদীয় রাজনীতির একটি দুর্বল দিক উন্মোচিত হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় জাতীয় সংসদ প্রয়াত জাতীয় নেতা, দলীয় প্রধান এবং সরকারের স্তুতি করার প্লাটফর্মে পরিণত হয়েছে বলে যে অভিযোগ শোনা যায় এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) পার্লামেন্ট ওয়াচেও বরাবর যেসব অভিযোগ উত্থাপিত হয়, লতিফ সিদ্দিকীর বক্তব্যে তারই প্রতিধ্বনি। তার মানে এই উপলব্ধি হতে তাকে দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়া এবং স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো?