“যাদের গলায় ‘বড়শি’ লাগানো আছে তারা কথা বলবে না। আমিও ৬০ বছর বলিনি।”
Published : 05 May 2024, 10:30 PM
৬০ বছর পর ‘গলার বড়শি খুলে’ গেছে জানিয়ে আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী তার সাবেক দল আওয়ামী লীগকে উদ্দেশ করে বলেছেন, এখন তিনি কথা বলতে চেষ্টা করবেন। বাধা দিয়েও লাভ হবে না।
রোববার জাতীয় সংসদে স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) সংশোধিত বিল-২০২৪ উত্থাপনের বিরোধিতা করে এ কথা বলেন তিনি।
ইউনিয়ন পরিষদে প্রশাসক নিয়োগের বিধান যুক্ত করে সংসদে বিলটি তোলা হয়।
বিলটি উত্থাপনে বিরোধিতা করেন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মুজিবুল হক চুন্নু ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী।
সংসদে এই প্রথম আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে পারছেন দলটির সাবেক নেতা। কারণ, তিনি এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জিতে আইনসভায় এসেছেন।
সরকার ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বলে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেন, “যাদের গলায় ‘বড়শি’ লাগানো আছে তারা কথা বলবে না। আমিও ৬০ বছর বলিনি। আজকে আমার গলার থেকে আপনারাই বড়শিটা খুলে নিয়েছেন। তাই আমি যতক্ষণ আছি- আপনি যতই বাধা দেন- আমি কথা বলতে চেষ্টা করব।”
চলতি সংসদে স্পিকারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে এক আগে ওয়াকআউটও করেছিলেন লতিফ সিদ্দিকী। চলতি সংসদের প্রথম অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনা ধন্যবাদ প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় তাকে ১০ মিনিট সময় দেওয়া হয়েছিল। এ কারণে তিনি ক্ষোভ দেখান সেদিন।
রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে লতিফ সিদ্দিকী ছিলেন ছাত্রলীগের নেতা। আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী পরিষদ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যও হয়েছিলেন। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান আমলে এবং স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩, ১৯৯৬, ২০০৮ ও ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের সমর্থনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীও ছিলেন। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে পান ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দ্বায়িত্ব।
পরে যুক্তরাষ্ট্রে সফরে গিয়ে ঘরোয়া এক আলোচনায় হজ নিয়ে মন্তব্যের জেরে মন্ত্রিসভা ও দল থেকে বহিষ্কার হন। পরে সংসদ থেকে পদত্যাগ করে রাজনীতি থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে টাঙ্গাইল-৪ আসনে হারলেও এবার তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েই নৌকাকে হারিয়ে সংসদ সদস্য হয়েছেন।
‘গণতান্ত্রিক হতে পারিনি’
ইউনিয়ন পরিষদে প্রশাসক নিয়োগের বিধান যুক্ত করে সরকারের তোলা বিলের বিরোধিতা করে লতিফ সিদ্দিকী বলেন, “স্থানীয় সরকার ধারণা নস্যাৎ করাই শুধু নয়, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা কোনো দিন আমরা কার্যকর করিনি, করতে দেইনি।
“আমরা যতই গণতন্ত্রের কথা বলি, চেতনা ও চৈতন্যে জাতিগতভাবে আমরা এখনো আমরা গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন হতে পারিনি। যেখানেই ব্যর্থতা, সেখানেই প্রশাসক নিয়োগের একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। প্রশাসকের বিষয়টি গণতন্ত্রবিরোধী চেতনা।”
বিলটি প্রত্যাহার করে ‘গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা পুনর্ব্যক্ত’ করার আহ্বান জানিয়ে সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, “আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা বঙ্গবন্ধুকে শুধু জিহ্বা থেকে উচ্চারণ করি, অন্তরে অন্য কিছু বিবেচনা করি। “
উপজেলা পরিষদকে ‘আমরা গলা টিপে মেরে ফেলেছি’ মন্তব্য করে দিয়ে আওয়ামী লীগের দুইবারের সাবেক মন্ত্রী বলেন, “ইউনিয়ন পরিষদের নিয়ন্ত্রণকারী শক্তি হল জেলা প্রশাসক। এ ধরনের চিন্তা আমরা কেন করছি? আমরা কি পিছু হাঁটছি?
“আমাদের বোধ হয় ভূতের পা হয়ে গেছে। আমরা কোথায় যাচ্ছি, আমাদের চিন্তা কী, কোথায় যেন আমাদের একটা সমস্যা। সব সময় আমরা ‘পরের হাতে লবণ খাই’।”
এই আইন ‘কোনো সংসদ সদস্যরা রচনা করে না’ মত দিয়ে তিনি বলেন, “আমলাদের মস্তিষ্ক থেকে যে আইন প্রণয়ন হয়, তা কখনও জনস্বার্থে আসতে পারে না।”
‘আমাকে বলতে দিন’
লতিফ সিদ্দিকীর বক্তব্যের এক পর্যায়ে সংসদে সভাপতির দায়িত্বে থাকা ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু তাকে থামিয়ে দিয়ে বিষয়ের ওপর (বিলের) আলোচনা করতে বলেন।
জবাবে লতিফ সিদ্দকী বলেন, “গণতন্ত্রের কথা বলতে গেলে এই সংসদের সময়ের অভাব হয়। কিন্তু হাজার কোটি টাকা ঋণ খেলাপিতে অর্থের অপচয় হয় না। কিন্তু কোনো সদস্য একটু সময় বেশি চাইলেই অভাব হয়।”
স্পিকারকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, “এই সংসদে জাতির চেতনার কথা, জাতির স্বার্থের কথা, জাতির ভবিষ্যতের কথা আলোচনা হবে। সেখানে যে বলতে পারে, তাকে বলতে দিন।”
তাকে আরো সময় দেওয়ার অনুরোধ করে লতিফ সিদ্দিকী বলেন, “আবার আপনার আদেশ, আপনি যখন বন্ধ করে দেবেন, লালবাতি, আমি বসে পড়ব। কিন্তু বিনীতভাবে বলব, আমাকে বলতে দিন। সময় নষ্ট হচ্ছে না। জাতির কত সময় নষ্ট হয়েছে।
“সময়ের কথা বলছেন! আমার জীবনের ১৪ বছর এ জাতির জন্য কারাগারে কেটেছে; আমার জীবন এবং যৌবন। সুন্দরী সহধর্মিণীকে সঙ্গে নিয়ে ৭ বছর প্রবাসে কাটিয়েছি। মাননীয় স্পিকার আপনার আজকে সময়ের সংকট দেখা দিয়েছে। জাতি এখন সংকটে রয়েছে।”
এর আগে গ্রামে বিদ্যুৎ সংকট দেখানে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীকে নিজ নির্বাচনি এলাকায় যাওয়ার আমন্ত্রণ দেন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মুজিবুল হক চুন্নু।
সেই প্রসঙ্গ টেনে লতিফ সিদ্দিকী বলেন, “এখানে বিদ্যুতের কথা বলা হয়েছে। আমি কাউকে বলব না ‘আপনি আমার এলাকায় আসুন।’ মন্ত্রী যেকোনো এলাকায় যাবেন সেখানে বিদ্যুৎ যাবে না এটা ভালো করেই বোঝেন।”
“আমার বক্তৃতায় যদি ফিরে আসতে দেন ,না হলে বসে পড়ি”, ডেপুটি স্পিকারকে উদ্দেশ করে আবার বলেন লতিফ সিদ্দিকী।
ডেপুটি স্পিকার জবাব না দিলে তিনি বলে উঠেন, “আপনি নীরব হয়ে গেলেন আমিও নীরব হয়ে যাই। আমি কিন্তু ওই চেয়ারটিকে (স্পিকার) সম্মান করি।”
এ সময় ডেপুটি স্পিকার বসতে বললে লতিফ সিদ্দিকী 'আলহামদুলিল্লাহ' বলে বসে পড়েন।
আরো পড়ুন
জিতলেন লতিফ সিদ্দিকী, হারলেন কাদের সিদ্দিকী
প্রতিবাদ জানাতে ১০ মিনিটের বিরতি লতিফ সিদ্দিকীর