Published : 04 May 2025, 10:55 AM
রিকশা নিয়ে আলোচনা বহুদিনের। কিন্তু বর্তমানে এই বাহনটির অধিক্য জনরোষের কারণ হচ্ছে বলে বলা হচ্ছে। আমাদের প্রায় সবার ব্যক্তিগত জীবনে রিকশার ওপর নির্ভরশীলতা যেমন রয়েছে, তেমনি এটিকে কেন্দ্র করে রয়েছে নানা বিড়ম্বনাও। বর্তমানে দেশে এমন সড়ক খুব কমই পাওয়া যাবে যেখানে রিকশার দেখা পাওয়া যায় না। সবকিছু ভালোভাবেই চলছিল। কিন্তু রিকশার সংখ্যা অতিরিক্ত হয়ে পড়ায় এটি এখন একটি বড় সমস্যায় পরিণত হয়েছে, যা সবাই সহজেই অনুধাবন করতে পারেন।
এই রিকশা নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি সংবাদে বলা হয়েছে, ঢাকার রিকশা ব্যবস্থাকে আধুনিক ও নিরাপদ করতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) যন্ত্রকৌশল বিভাগের একটি দল ঢাকার রাস্তার জন্য উপযোগী নতুন একটি নকশা প্রস্তাব করেছে। রিকশার এই নতুন নকশা নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তবে প্রশ্ন হলো, এই নকশা কি আদৌ ঢাকার রিকশা সমস্যার সমাধান করতে পারবে?
প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, নতুন নকশায় ১৬টি বৈশিষ্ট্য থাকবে, যার মধ্যে ১২টি নিরাপত্তা-সংক্রান্ত। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু রিকশা নিয়ে যে সমস্যা, তার মধ্যে নিরাপত্তা-সংক্রান্ত বিষয়গুলো কতটা বিবেচিত বা উল্লেখিত হয়েছে, তা একটি বড় প্রশ্ন। নিরাপত্তা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ এবং ফেলে দেবার মতো বিষয় নয়। তবে এটি কি রিকশার সংখ্যাজনিত সমস্যার সমাধান করবে? এই প্রশ্ন উঠছে কারণ, রিকশার সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এরা অলিগলি ছেড়ে রাজপথ, ফ্লাইওভার, এমনকি হাইওয়েতেও চলাচল করছে। এই সমস্যা এতটাই প্রকট যে, রিকশার প্রবেশ ঠেকাতে বিশেষ ধরনের ব্রেকার বা বন্ধনী স্থাপন করা হয়েছে। এই ব্রেকারের ওপর দিয়ে রিকশা চললে চাকা আটকে যায় বা বেঁকে যায়, ফলে রিকশাকে মূল সড়কে প্রবেশ করতে বাধা দেওয়া যায়। এই উদ্যোগের উদ্দেশ্য প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ। কারণ সমস্যার মূল রয়েছে এখানেই।
নিরাপত্তার বিষয়টি এখানে গুরুত্বপূর্ণ, তবে তা মূলত যানবাহনের দুর্ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত। রিকশার মতো কম গতির বাহন যখন দ্রুতগতির সড়কে প্রবেশ করে, তখন এটি সড়কের গতিপ্রবাহে প্রভাব ফেলে বা দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি করে। ফলে রিকশাকেন্দ্রিক দুর্ঘটনার সংবাদ আমরা প্রায়ই পাই।
রিকশা বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থার একটি অপরিহার্য অংশ, বিশেষ করে ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে। এটি সাশ্রয়ী মূল্যে স্বল্প দূরত্বের যাতায়াত এবং লাখো মানুষের জীবিকা নিশ্চিত করে। তবে, রিকশার অতিরিক্ত সংখ্যা, অনিয়ন্ত্রিত চলাচল এবং নিরাপত্তার ঘাটতি এটিকে একটি জটিল শহুরে সমস্যায় রূপান্তরিত করেছে। সম্প্রতি, ঢাকার রিকশা ব্যবস্থাকে নিরাপদ ও আধুনিক করার লক্ষ্যে একটি নতুন ধরনের রিকশার নকশা প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, এই নকশা কি রিকশা-সংক্রান্ত সমস্যার মূল সমাধান?
ঢাকার রিকশা সমস্যার প্রকৃতি
ঢাকায় রিকশার বিপুল সংখ্যা সমস্যার মূল কারণ। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) ২০১৯ সালের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকায় রিকশার সংখ্যা ১১ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। গত কয়েক বছরে নিশ্চয়ই তা আরও বেশ বেড়েছে এবং এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যাটারিচালিত রিকশা (ইজি বাইক)। এই বিশাল সংখ্যা নিম্নলিখিত সমস্যাগুলো সৃষ্টি করছে:
যানজট: রিকশার ধীর গতি এবং মূল সড়কে প্রবেশ ঢাকার যানজটকে আরও তীব্র করেছে। ২০২৩ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, রিকশা ঢাকার যানজটের একটি প্রধান কারণ।
নিরাপত্তা ঝুঁকি: রিকশার কম গতি এবং দ্রুতগতির যানবাহনের সঙ্গে মিশ্রণ দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ায়। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে রিকশা-সংক্রান্ত দুর্ঘটনায় ১০০ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।
অনিয়ন্ত্রিত চলাচল: নির্দিষ্ট লেন বা রুটের অভাবে রিকশা ফ্লাইওভার ও হাইওয়েতে প্রবেশ করে, যা বিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা ঝুঁকি সৃষ্টি করে।
বিদ্যুৎ ঘাটতির চাপ: ব্যাটারিচালিত রিকশার চার্জিং জাতীয় গ্রিডের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে।
এই সমস্যা মোকাবিলায় মূল সড়কে রিকশার প্রবেশ ঠেকাতে বিশেষ ব্রেকার বা বন্ধনী বসানো হয়েছে, যা রিকশার চাকা আটকে দেয়। তবে এটি সমস্যার আংশিক সমাধান মাত্র।
নতুন রিকশার নকশা: মূল বৈশিষ্ট্য
প্রতিবেদন অনুযায়ী, নতুন রিকশার নকশায় ১৬টি বৈশিষ্ট্য যুক্ত করা হয়েছে, যার ১২টি নিরাপত্তা-কেন্দ্রিক। প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:
হাইড্রোলিক ডিস্ক ব্রেক: তিনটি চাকায় হাইড্রোলিক ডিস্ক ব্রেক যুক্ত করা হবে, যা ব্রেকিংয়ের কার্যকারিতা বাড়াবে।
ব্যাটারিচালিত সিস্টেম: রিকশাটি ব্যাটারিচালিত, যা জ্বালানিচালিত যানের তুলনায় পরিবেশবান্ধব।
কাঠামোগত উন্নতি: শক্তিশালী ফ্রেম এবং নতুন হাব সিস্টেম, যা ডিস্ক ব্রেক স্থাপনের জন্য প্রয়োজন।
নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য: সিট বেল্ট, উন্নত আলোক ব্যবস্থা, রিফ্লেক্টর এবং সম্ভাব্য শক্তিশালী ছাউনি।
যাত্রী ও চালকের সুবিধা: আরামদায়ক আসন, উন্নত সাসপেনশন এবং আবহাওয়া-প্রতিরোধী নকশা।
পরীক্ষামূলক প্রয়োগ: প্রাথমিকভাবে ১০০টি রিকশা ঢাকায় চালু করে এর কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হবে।
নতুন নকশা কি সমস্যার সমাধান করবে?
নতুন নকশার বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এটি কিছু ক্ষেত্রে উন্নতি আনতে পারে, তবে মূল সমস্যার সমাধানে এর সীমাবদ্ধতা রয়েছে। নিচে এর সম্ভাব্য প্রভাব ও সীমাবদ্ধতা তুলে ধরা হলো:
নিরাপত্তার উন্নতি: হাইড্রোলিক ডিস্ক ব্রেক, সিট বেল্ট এবং উন্নত আলোক ব্যবস্থা রিকশার দুর্ঘটনার হার কিছুটা কমাতে পারে। তবে, দুর্ঘটনার মূল কারণ— মূল সড়কে রিকশার প্রবেশ এবং দ্রুতগতির যানবাহনের সঙ্গে মিশ্রণ— এই নকশায় সমাধান করা হয়নি।
প্রশ্ন: নকশায় কি কোনো ‘কিল সুইচ’ বা জিপিএসভিত্তিক রুট নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আছে, যা রিকশাকে ফ্লাইওভার বা মূল সড়কে প্রবেশে বাধা দেবে? প্রতিবেদনে এমন কোনো তথ্য নেই।
যানজট: রিকশার সংখ্যা বা তাদের চলাচলের রুট নিয়ন্ত্রণের কোনো পরিকল্পনা নকশায় উল্লেখ নেই। যতক্ষণ রিকশার সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা না হবে এবং নির্দিষ্ট লেন প্রতিষ্ঠা না হবে, ততক্ষণ যানজটের সমাধান সম্ভব নয়।
লেন: ঢাকায় রিকশার জন্য নির্দিষ্ট লেনের অভাব রয়েছে। নতুন নকশায় এ বিষয়ে কোনো প্রস্তাব নেই।
বিদ্যুৎ খরচ: ব্যাটারিচালিত রিকশা জাতীয় গ্রিডে চাপ সৃষ্টি করে। নতুন নকশায় জ্বালানি-সাশ্রয়ী ব্যাটারি, রিমুভেবল ব্যাটারি বা সৌরশক্তি-চালিত ব্যবস্থার কোনো উল্লেখ নেই।
উৎপাদন ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ: বর্তমান রিকশার সুবিধা হলো এর সহজ গঠন এবং কম খরচে মেরামত। স্থানীয় গ্যারেজে সহজে মেরামতযোগ্য এই রিকশাগুলো সাশ্রয়ী। কিন্তু নতুন নকশায় ডিস্ক ব্রেক ও হাইড্রোলিক সিস্টেমের জন্য নতুন হাব ও চাকা প্রয়োজন, যা উৎপাদন ও মেরামত খরচ বাড়াবে।
প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের অভাব: নতুন নকশা মূলত বর্তমান ইজি বাইকের উন্নত সংস্করণ। এতে মৌলিক প্রযুক্তিগত পরিবর্তন নেই। উদাহরণস্বরূপ:
· স্মার্ট সেন্সর: রিকশায় স্মার্ট সেন্সর থাকলে এটি ট্রাফিক ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চলতে পারত।
· পরিবেশবান্ধব উপকরণ: পোস্ট-কনজিউমার ম্যাটেরিয়াল ব্যবহারের কোনো উল্লেখ নেই।
· ডিজিটাল ট্র্যাকিং: রিকশার চলাচল নিয়ন্ত্রণে জিপিএস বা ডিজিটাল ট্র্যাকিং সিস্টেমের প্রস্তাব নেই।
নতুন রিকশার নকশা নিরাপত্তা ও যাত্রী আরামের কিছু দিক উন্নত করতে পারে, তবে এটি ঢাকার রিকশা সমস্যার একমাত্র সমাধান নয়। এটি বর্তমান ইজি বাইকের একটি উন্নত সংস্করণ, যেখানে মৌলিক প্রযুক্তিগত বা নীতিগত পরিবর্তনের অভাব রয়েছে। রিকশা সমস্যার সমাধানে প্রযুক্তিগত উন্নতির পাশাপাশি সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, রুট ব্যবস্থাপনা এবং সঠিক নীতি প্রণয়নের সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন। অন্যথায়, এই নকশা একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ হিসেবে থেকে যাবে, কিন্তু বাস্তব পরিবর্তন আনতে সীমিত ভূমিকা রাখবে।