খবর হলো, ডিসি ও ইউএনওদের জন্য ২৬১টি দামি জিপ কেনা হবে। প্রথম কথা, ব্যয়টা অপরিহার্য কিনা। দ্বিতীয়ত, শক্তপোক্ত জিপ হলেই তো হয়। ‘এসইউভি’ টাইপ জিপই কেন কিনতে হবে? আর ১১৭ টাকা দামের ডলার দিয়েই কিন্তু এগুলো সংগ্রহ করতে হবে।
Published : 26 May 2024, 04:11 PM
৬ জুন নতুন অর্থবছরের বাজেট পেশ করা হবে। এর রূপরেখা সম্পর্কেও মিলেছে ধারণা। বাজেট প্রত্যাশামতো অনেক কম হারে বাড়ছে এবার। তবে রাজস্ব ব্যয় কম বাড়ছে না। উন্নয়ন ব্যয় (এডিপি) বাড়ছে খুবই কম। ‘সতর্কতার সঙ্গে’ প্রকল্প গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। এতে স্বীকৃতি রয়েছে– কাজটা এতদিন যথেষ্ট সতর্কভাবে করা হয়নি। ছোট বাজেটই যেহেতু নেওয়া হচ্ছে, তাই উচিত নয় কি রাজস্ব ব্যয়টাও, বিশেষত পরিচালন ব্যয় বেশি বাড়তে না দেওয়া? তবে খাদ্য নিরাপত্তা জোরদারের পদক্ষেপ থাকছে। এ খাতে ব্যয় বাড়বে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতিতে সেটাই স্বাভাবিক।
চলতি বাজেটে মূল্যস্ফীতির যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল, পরিস্থিতি তার ধারেকাছেও নেই। বিশেষত উন্নয়ন সহযোগীরা যা বলছে, তাতে ধরে নেওয়া যায়– এটা আরও বাড়তে পারে। মূল্যস্ফীতি অবশ্য কমে আসবে একটা সময়ে। তবে সহসা কমার কারণ নেই। সাম্প্রতিককালে সুদ ও মুদ্রার বিনিময় হার বিষয়ে যে পদক্ষেপ নেওয়া হলো, তাতেও মনে করা হচ্ছে– মূল্যস্ফীতি কমবে না। এ অবস্থায় বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে ছয় শতাংশ করা হবে বলে জানা গেল। সেটা অনার্জিত হলে পরে সংশোধন করা হবে; যেমনটা করতে হয়েছে এবারও। চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধিও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী হবে না। সরকারও এটা স্বীকার করছে।
বেসরকারি বিনিয়োগ একটা জায়গায় আটকে ছিল। এক্ষেত্রে দেখা দিচ্ছে কমার প্রবণতাও। শুধু সরকারি বিনিয়োগের ওপর তো প্রবৃদ্ধি বাড়ানো যায় না। সরকারি বিনিয়োগের মান নিয়ে সমালোচনাও কমছে না। এতে মানসম্মত আর টেকসই কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয় না। নির্মাণসামগ্রীর ব্যবসা অবশ্য বাড়ে। ওইসব খাত চাঙ্গা হয়। তা সত্ত্বেও কর্মসংস্থান পরিস্থিতি যে খারাপ, সেটা অনস্বীকার্য। বিশ্বব্যাংক বলছে– এটা বেশ খারাপ। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান পরিস্থিতি খারাপ এবং তার মধ্যে মূল্যস্ফীতি, বিশেষত খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের বেশি থাকলে তা উদ্বেগজনক বৈকি। এমন একটা অবস্থায় যে বাজেট পেশ হতে যাচ্ছে, তাতে স্বভাবতই মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার প্রত্যয় ঘোষিত হবে। বলা হবে– সরকার এমন কিছু করবে, যাতে মূল্যস্ফীতি কমে আসে এবং কাজের সুযোগ বাড়ে।
অনেকদিন ধরেই মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার কম। মূল্যস্ফীতির চেয়ে বেশি হারে আয় বাড়াতে সক্ষম মানুষ তো বেশি নেই দেশে। তারাই কেবল বলবে– পরিস্থিতি খারাপ নয়! তবে এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে যারা উদ্যোক্তা, তারা কিন্তু টের পাচ্ছেন, পরিস্থিতি আসলে কেমন। দীর্ঘদিন ঋণের সুদের হার কম তথা নির্দিষ্ট সীমায় থাকায় তারা অবশ্য সুবিধা পেয়েছেন। তখন বিদেশ থেকেও ঋণ নিতে পেরেছেন কম সুদে। দেশে ডলারের দামটাও আটকে রাখা হয়েছিল। পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতেও সরকার এসব নীতি নিয়েই চলতে চেয়েছে। তাতে অর্থনীতিতে সংকট ঘনীভূত হয়ে উঠলেও সুবিধা পেয়েছে একটি ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। তবে সে পরিস্থিতি এখন আর নেই।
সুদের হারকে করা হয়েছে কমবেশি বাজারভিত্তিক। ডলারের আনুষ্ঠানিক দামও এখন বাজার দরের কাছাকাছি। সুদের হার সেভাবে আর না বাড়লেও ডলারের দাম আরও বাড়বে বলেই মনে হচ্ছে। এ অবস্থায় ব্যবসা পরিচালন ব্যয় বাড়বে। চলমান মূল্যস্ফীতিতে তাদের ওপর মজুরি বৃদ্ধির চাপও বাড়ার কথা। আন্দোলনের মুখে চা বাগানে মজুরি কিছুটা বাড়ানোর পর গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরিও বাড়াতে হয়েছে। অন্যান্য আনুষ্ঠানিক খাতেও মজুরি বাড়ানোর দাবি সম্ভবত জোরদার হবে। সরকারকেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হবে এ প্রশ্নে।
এরই মধ্যে নগরীতে অটোরিকশা চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়ে সেটা আবার প্রত্যাহার করতে হয়েছে সরকারকে। এসব সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া ‘যুক্তিসঙ্গত’ হলেও তার বাস্তবতা এখন নেই। সরকার মেয়াদের শুরুতেই সাধারণত অপ্রিয় সংস্কার সেরে ফেলতে চায়। এ ফর্মুলাও এখন প্রয়োগ করা যাচ্ছে না। কারণ কোভিড উত্তরণের পর থেকেই মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। আর মাসের পর মাস এটা থাকছে ১০ শতাংশের কাছাকাছি। এমন মূল্যস্ফীতি সামলাতে না পারার দায় স্বভাবতই বর্তাচ্ছে ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা সরকারের ওপর। আসছে বাজেটে যেমন; নতুন মেয়াদ শুরুর সময়েও সরকারকে তাই বলতে হয়েছে, মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনাটাই প্রধান লক্ষ্য।
অর্থনীতি ব্যাপকভাবে আমদানিনির্ভর হওয়ায় এবং আন্তর্জাতিক পণ্যবাজার দীর্ঘদিন বিরূপ থাকায় মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা যায়নি। এ কথায় সাধারণভাবে যুক্তি আছে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যসামগ্রীর দাম কমে এলেও কেন দেশে পরিস্থিতির উন্নতি হলো না, তার সদুত্তর নেই। সময়ে সময়ে কর-শুল্ক ছাড় দিয়ে দাম সহনীয় করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও সেটাও প্রত্যাশিত সুফল দেয়নি। সরকারের পক্ষে দায়িত্বপ্রাপ্তরা এটা স্বীকার করে তখন দায় চাপিয়েছেন ‘সিন্ডিকেটের’ ওপর। এতে আবার প্রশ্ন উঠেছে, বাজারে সিন্ডিকেট থাকলেও সেটা কি সরকারের চেয়ে শক্তিশালী? এ অবস্থায় আমরা দেখতে চাইব, পণ্যবাজার শান্ত করে আনতে কর-শুল্ক ‘যৌক্তিকীকরণ’সহ নতুন কী পদক্ষেপ নেয় সরকার।
বাজারভিত্তিক পদ্ধতিতে যাওয়ার সময়টায় ডলারের দাম ঊর্ধ্বমুখি বলেও আমদানিতে খরচ কমানোর দাবি এখন জোরদার। ডলারের দাম বেড়ে আমদানি আরও ব্যয়বহুল হওয়ায় নির্ধারিত শুল্ক হারেও আগের চেয়ে বেশি রাজস্ব অবশ্য পাবে সরকার। এ প্রশ্নও অনেকদিন ধরে আছে যে, সরকার রাজস্ব আহরণে আর কতদিন আমদানি খাতের ওপর নির্ভরশীল থাকবে? তাকে কি প্রত্যক্ষ কর (আয়কর) বাড়ানোর দিকে যেতে হবে না? মফস্বলেও আয়কর দিতে সক্ষম একটা জনগোষ্ঠী রয়ে গেছে করজালের বাইরে। অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ৮০ শতাংশ বিত্তবান কর ফাঁকি দিচ্ছে। বলা বাহুল্য, তাদের ছাই দিয়ে ধরা হচ্ছে না।
সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে ভাতার পরিমাণ ও গ্রহীতা বাড়াতে হবে। অন্যদিকে আবার বাড়াতে হবে আয়করদাতা। এটা বাড়তে থাকা আয় বৈষম্য কমিয়ে আনারও কার্যকর হাতিয়ার হতে পারে। এমনটা করা গেলে ভ্যাটের ওপর নির্ভরতাও কমিয়ে আনা যাবে। ভ্যাট সর্বসাধারণের ওপর একইভাবে প্রয়োগ হয় বলে এটা বিশেষত মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতিতে গরিবের জন্য হয়ে ওঠে পীড়াদায়ক। উদাহরণস্বরূপ, প্যাথলজিক্যাল টেস্টেও আরোপিত আছে ভ্যাট। এদিকে আমদানিনির্ভর সব খাদ্যপণ্যে আছে উচ্চ কর-শুল্ক, যা সবার ওপর সমভাবে প্রযোজ্য। এক কোটি ফ্যামিলি কার্ডধারীকে অবশ্য ভর্তুকি দামে এর কিছু জোগানো হচ্ছে। কিন্তু সেটা পর্যাপ্ত নয়। তাদের যেতেই হচ্ছে তপ্ত হয়ে থাকা পণ্যবাজারে।
বাজেটে অবশ্য এ খাতে আরও জোর দেওয়া হবে বলে জানা যাচ্ছে। খাদ্যশস্য আমদানির জন্য বাড়ানো হচ্ছে বরাদ্দ। তাপপ্রবাহসহ প্রতিকূল আবহাওয়ায় বোরো মার খেতে পারে বলেও এমন সতর্কতা। যেসব তথ্য-উপাত্তের ওপর বাজেট প্রণয়নসহ সরকার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, সেগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতাও এখন আরও প্রশ্নবিদ্ধ। সরকারের ভেতরেই এ নিয়ে সময়ে সময়ে উঠছে প্রশ্ন। তাতে সময়োচিত সিদ্ধান্ত নিয়ে (যেমন আমদানি) পরিস্থিতি সামলানোর সুযোগ যাচ্ছে কমে। বলতে যতই ভালো লাগুক– আমরা খাদ্যে মোটেও স্বয়ংসম্পূর্ণ নই। জরুরি সব খাদ্যপণ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়াটাও অসম্ভব। যেমন, গমে আমদানিনির্ভরতা আরও বেড়েছে। চিনি উৎপাদন আরও কমেছে দেশে। এর প্রধান কারণ, কম বয়ে উৎপাদন করতে আমরা পারছি না।
উৎপাদন ব্যয় বাড়ার যুক্তিতে ওষুধের দামও দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে। এসব খাতে পরিবহন ব্যয়ও বেশি; কেননা ডিজেলের দাম অনেক বেড়েছে। এটা আবার এখন বাজারভিত্তিক। সরকার গ্যাস-বিদ্যুৎ খাত থেকেও ভর্তুকি প্রত্যাহার করছে ক্রমে। তাতে এগুলোর দাম বাড়ার কারণেও পণ্য উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। সুদের হার বাড়িয়ে বাজারে অর্থ সরবরাহ কমিয়ে এ ধারার মূল্যস্ফীতি কমানো যাবে কীভাবে? পর্যাপ্ত গ্যাস না থাকায় সরকার সিংহভাগ সার কারখানাও চালু রাখতে পারছে না। এর প্রভাব কি থাকবে না সংকটকালেও ভালো পারফর্ম করা কৃষিতে? অন্তত থাকবে অনিশ্চয়তা! অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তার চাপ বড় ঘটনা বৈকি। এজন্য বেসরকারি বিনিয়োগও প্রভাবিত হচ্ছে নেতিবাচকভাবে। এফডিআই আসছে না বললেই চলে।
এদিকে দেশে ব্যবসারত বিদেশি কোম্পানিগুলো ডলারে মুনাফা নিয়ে যেতে পারছে না। এক ডলার সংকটেই আমরা এত কাবু হয়ে গেলাম যে, সেটা আর ভাষায় বর্ণনা করা যাচ্ছে না। অর্থপাচার এজন্য কতখানি দায়ী আর কতখানি দায়ী নীতিগত ব্যর্থতা, সে আলোচনাও হচ্ছে এখন। ক্ষয় হতে হতে নিট রিজার্ভ এ মুহূর্তে যতটুকু, তাতে স্বস্তি বোধ করা যাচ্ছে না। রিজার্ভ বাড়ানোর চেষ্টা অবশ্য রয়েছে। ব্যাংকে ডলার প্রবাহ বাড়ানোর চেষ্টাও। রিজার্ভ স্বস্তিপূর্ণ রাখা দরকার শুধু আমদানি বিল নয়; বিদেশি ঋণ আর দায়দেনা পরিশোধের জন্যও। বেসরকারি খাতও বিদেশ থেকে নেওয়া ঋণ দ্রুত মিটিয়ে দিতে ডলার চাইছে। সুদের হার বেশি বলে তারা আর এসব ঋণ নিতে চাইছে না এখন। তবে অর্থসংকটে থাকা সরকার ঋণ চাইছে। এমনকি চীন থেকে তার স্থানীয় মুদ্রায় ঋণ নেওয়ার আলাপ আছে বাজারে। স্থানীয় উৎস থেকেও সরকার বন্ড ছেড়ে ঋণ করছে উচ্চসুদে।
সুদ বাবদ ব্যয়ের বড় একটা খাত থাকে বাজেটে। এবারও সেটা থাকছে। জিডিপির অনুপাতে ঋণ এখনও বেশি নয়; তবে সরকারের রাজস্ব আহরণ তো কম। এটা বাড়াতে গিয়ে আবার এমন আচরণ করা যাবে না, যাতে স্বল্পআয়ের মানুষের ওপর চাপ আরও বাড়ে। এনবিআর বহির্ভূত রাজস্ব আহরণেও সতর্ক থাকতে হবে, যাতে মূল্যস্ফীতিতে জেরবার মানুষের ওপর গিয়ে না পড়ে চাপটা। যেমন, সরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের ফি যেন না বাড়ে। সবচেয়ে ভালো হয় সরকার প্রশাসন পরিচালন ব্যয়, বিশেষত এর অপচয় কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে।
এতটা আশা করা অবশ্য কঠিন। এ নিবন্ধ তৈরির সময় পর্যন্ত খবর হলো, ডিসি ও ইউএনওদের জন্য ২৬১টি দামি জিপ কেনা হবে। প্রথম কথা, ব্যয়টা অপরিহার্য কিনা। দ্বিতীয়ত, শক্তপোক্ত জিপ হলেই তো হয়। ‘এসইউভি’ টাইপ জিপই কেন কিনতে হবে? আর ১১৭ টাকা দামের ডলার দিয়েই কিন্তু এগুলো সংগ্রহ করতে হবে। আমরা এখন বরং দেখতে চাইব, দেশে ‘ডলার ইনফ্লো’ বাড়িয়ে এটাকে সহজলভ্য করে টাকার অধিকতর অবমূল্যায়ন রোধে সরকার কী করছে। বাজেটে এর দিকনির্দেশনাও দেখতে চাইব।