Published : 01 Jun 2024, 07:03 PM
আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে মো. সিয়াম হোসেন নামক এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে, যাকে নেপালের পুলিশ আটক করেছে বলে শোনা যাচ্ছে। যদি সত্যি সিয়ামকে আটক করা হয়ে থাকে, খবরটি অবশ্যই অতি সন্তোষজনক বলে বিবেচিত হবে। এমপি আনার হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা বলে যাকে চিহ্নিত করা হচ্ছে, সেই আখতারুজ্জামান শাহীনের নিকটতম সহায়ক হিসাবে সিয়াম হত্যা পরিকল্পনায় সিদ্ধান্তকারী ভূমিকায় ছিলেন বলে দাবি করা হচ্ছে।
পূর্বে আনার হত্যায় পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে আনার আইনগত অবস্থা ব্যক্ত এবং ব্যাখ্যা করে আমার বিস্তারিত লেখা অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করায়, আটক হয়ে থাকলে সিয়ামকে নেপাল থেকে কিভাবে ফিরিয়ে আনা যায়, সে ব্যাপারে জানানোর জন্যও আমাকে বহুজন অনুরোধ করেছেন। বহু ব্যক্তিকে মোবাইলের মাধ্যমে বিস্তারিত জানানো কঠিন বলে এই সিদ্ধান্ত নিলাম যে নতুন ঘটনার উপর একটি নিবন্ধ লিখলে সবাই সেটি পড়ে বিস্তারিত জানতে পারবেন।
খবরে আরো প্রকাশ ডিবি প্রধান, হারুন-অর-রশিদ, যার কৌশল এবং দক্ষতা সকলের প্রশংসা কুড়াতে সক্ষম হয়েছে। হারুন কাঠমান্ডু রওয়ানার প্রাক্কালে বলেছেন বাংলাদেশের বহু অপরাধী নেপালকে নিরাপদ আশ্রয়স্থল ভেবে সেখানে আত্মগোপনে রয়েছে । সে অর্থে শুধু সিয়ামের বিষয়ই নয়, পুরো ব্যাপারেই লেখা বাঞ্ছনীয় বলে মনে করছি।
আগেই লিখেছি এবং বলেছি যে ১৯৬টি দেশের পুলিশ বাহিনীর আন্তর্জাতিক সমিতি ইন্টারপোলকে জাতিসংঘ বা অন্য কেউ কোনো ক্ষমতা প্রদান করেনি ভিন্ন দেশে পালিয়ে যাওয়া আসামিদের ফিরিয়ে আনার। এদের ফিরিয়ে আনা দুটো পন্থায় সম্ভব। এর একটি হলো এক্সট্রাডিশন বা আসামি হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় (এটিকে অনেকে ভুল করে বন্দি বিনিময় বলে থাকেন, যা ঠিক নয়, বন্দি বিনিময় একটি ভিন্ন তত্ত্ব) এবং অন্যটি সংশ্লিষ্ট দেশের ইমিগ্রেশন আইন প্রয়োগের মাধ্যমে।
এক্সট্রাডিশন প্রক্রিয়ায় সাধারণত হস্তান্তর চাওয়া দেশ এবং অপরাধী পালিয়ে থাকা দেশের মধ্যে এক্সট্রাডিশন চুক্তির দরকার হয়, যদিও এর কিছু ব্যতিক্রমও আছে। এক্সট্রাডিশন পদ্ধতির মাধ্যমে একটি দেশ, অন্যান্য শর্ত পূরণ সাপেক্ষে, তার নিজ দেশের নাগরিককেও হস্তান্তর দাবি করা দেশের নিকট পাঠাতে পারে।
তবে একটি দেশ সে দেশের ইমিগ্রেশন আইন প্রয়োগ করেও সম্ভাব্য ক্ষেত্রে পালিয়ে যাওয়া ব্যক্তিকে তার নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে পারে। যেখানে এক্সট্রাডিশন চুক্তি বলবৎ নেই অথবা অন্য কোনো কারণে এক্সট্রাডিশন পদ্ধতির মাধ্যমে পলাতককে হস্তান্তর করা সম্ভব নয়, সেই পরিস্থিতিতে ইমিগ্রেশন আইন প্রয়োগ খুবই ফলপ্রসূ। ইমিগ্রেশন আইন প্রয়োগ করেই যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধুর অন্যতম খুনি মেজর মহিউদ্দিনকে এবং থাইল্যান্ড বঙ্গবন্ধুর আর এক খুনি মেজর বজলুল হুদাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়েছিল। কিন্তু কোনো দেশ তার নিজের নাগরিককে ইমিগ্রেশন আইন প্রয়োগ করে বিদেশে হস্তান্তর করতে পারে না বিধায় যুক্তরাষ্ট্র চাইলেও শাহীনকে ইমিগ্রেশন পদ্ধতি প্রয়োগ করে পাঠাতে পারবে না, যার জন্য শুধু এক্সট্রাডিশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই যুক্তরাষ্ট্র শাহীনকে ভারতের কাছেই হস্তান্তর করতে পারে, ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এক্সট্রাডিশন চুক্তি রয়েছে বলে, যে চুক্তি বাংলাদেশের সঙ্গে নেই।
নেপাল সে দেশে পালিয়ে যাওয়া সিয়াম এবং অন্যান্য পালিয়ে যাওয়া বাংলাদেশী নাগরিকদের অতি সহজেই তাদের ইমিগ্রেশন আইন প্রয়োগ করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিতে পারে যেভাবে যুক্তরাষ্ট্র খুনি মেজর মহিউদ্দিনকে এবং থাইল্যান্ড খুনি বজলুল হুদাকে পাঠিয়ে দিয়েছিল। এই প্রক্রিয়াও অত্যন্ত সহজ। এই ক্ষেত্রে এটি দেখানোরও কোনো প্রয়োজন হয় না যে পলাতক ব্যক্তিগুলো তাদের দেশে অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত। একটি দেশ সে দেশ থেকে ইমিগ্রেশন আইনের অন্যান্য শর্ত সাপেক্ষে নিরাপরাধ ব্যক্তিদেরও ফেরত পাঠাতে পারে। সিয়াম এবং অন্যান্য পলাতক বাংলাদেশী নাগরিকদের নেপালের ইমিগ্রেশন আইন প্রয়োগ করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে এক্সট্রাডিশন চুক্তির কোনো দরকার নেই, কেননা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে এক্সট্রাডিশন পদ্ধতিতে পাঠানো হচ্ছে না, পাঠানো হচ্ছে ইমিগ্রেশন আইন প্রয়োগ করে।
কয়েক দশক আগে এক রায়ে বিলেতের স্বনামধন্য বিচারপতি লর্ড ডেনিং এই মর্মে রায় দিয়েছিলেন যে ইমিগ্রেশন আইনের মাধ্যমে কাউকে নিজ নাগরিকত্বের দেশে এমন অবস্থায়ও ফেরত পাঠানো যাবে যেখানে ফেরত পাঠানোর অর্থ হবে পেছনের দরজা দিয়ে আসলে এক্সট্রাডিশন প্রক্রিয়াই কার্যকর করা।
সুতরাং নেপালের কাছে বাংলাদেশ সরকারকে এমনটি জানাতে হবে, যা এরই মধ্যে বাংলাদেশ সরকার কাঠমান্ডুতে বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে জানিয়েছে বলে প্রকাশ, যে প্রতারণার মাধ্যমে নেপালের ইমিগ্রেশন আইন লংঘন করে বাংলাদেশে খুনের অপরাধে অভিযুক্ত সিয়াম নামক ব্যক্তি সেখানে অবস্থান করছে, যার জন্য তাদের ইমিগ্রেশন আইন প্রয়োগের মাধ্যমে যেন তাকে বাংলাদেশে ডিপোর্ট করা হয়। এতে শতভাগ সাফল্যের সম্ভাবনা রয়েছে, কোনো আইনি জটিলতাও থাকার সম্ভাবনা নেই। শুধু বাংলাদেশ সরকারের পদক্ষেপই যথেষ্ট। এখানে উল্লেখযোগ্য যে বিদেশী কোনো নাগরিক একটি দেশে প্রবেশ করতে চাইলে তাকে এই মর্মে অঙ্গীকার করতে হয় যে সে অন্য কোনো দেশে কোনো অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত হয়নি বা অভিযুক্ত নয়। সিয়াম রাজনৈতিক আশ্রয়ও পাবে না, কেননা, রিফিউজি কনভেনশনে বলা আছে যে, অন্য দেশে মারাত্মক অপরাধ করা ব্যক্তি রাজনৈতিক আশ্রয় পেতে পারে না। নেপালের সঙ্গে ভারতের এক্সট্রাডিশন চুক্তি রয়েছে। ভারত নেপালের কাছে সিয়ামের হস্তান্তর চাইলে জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাই ভারতকে সিয়ামের হস্তান্তর চাওয়া থেকে নিবৃত্ত রাখার চেষ্টা করা উচিত হবে আমাদের।