Published : 28 Apr 2025, 12:11 PM
মাজারকেন্দ্রিক ধর্মীয় অনুভূতির বিপরীতে বাংলাদেশের অধিকাংশ ইসলাম ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের মধ্যে সালাফি আন্দোলন বা ইসলামবাদী তাত্ত্বিক সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীর চিন্তাধারার প্রভাব দেখা যায়। সালাফিদের ওহায়াবি বলেও ডাকা হয় এবং তাদের অনেক মিল রয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, হাম্বলি মাজহাবের অন্তর্গত সালাফি ধারার ইসলাম চর্চার প্রতি বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলমানের আগ্রহ গত আড়াই থেকে তিন দশক ধরে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ধারার ইসলাম যারা চর্চা করেন, তারা মাজার এবং কবরের চিহ্ন রাখবার বিরোধী।
এই ধারার ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখলেও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) কোনো বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শ অনুসরণ করতে চায় না বলে তাদের নেতাদের নানা বক্তব্যে উঠে এসেছে। ফলে একই সঙ্গে এ প্রশ্নটিও রাজনৈতিক অঙ্গনে দেখা দেওয়া স্বাভাবিক যে, কোনো বিশেষ মতাদর্শের অনুগামী না হয়ে একটি সংগঠনের পক্ষে রাজনৈতিক দল হয়ে ওঠা সম্ভব কিনা?
শুধু রাজনৈতিক মতাদর্শই নয়, এনসিপি বাঙালি বা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী ধারাও অনুসরণ করতে চায় না। উত্তর জাতীয়তাবাদী ধারণার বিকল্প হিসেবে দলটি সামনে আনতে চায় সভ্যতার ধারণা। সভ্যতা প্রত্যয়কে ধরে রাজনীতি করার বিষয়টি নতুন কিছু নয়। সোভিয়েত ইউনিয়নকেন্দ্রিক সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতনের পর মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল ফিলিপস হান্টিংটন সভ্যতার দ্বন্দ্বের ধারণাটি সামনে আনেন। সোভিয়েত উত্তর বিশ্ব ব্যবস্থায় তিনি আটটি প্রধান সভ্যতা চিহ্নিত করেন। এ ব্যবস্থায় আদর্শগত দ্বন্দ্বের জায়গা সভ্যতাকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব দ্বারা প্রতিস্থাপিত হবে বলে উল্লেখ করেন।
আটটি সভ্যতার মধ্যে পশ্চিমা বনাম ইসলামিক সভ্যতার দ্বন্দ্বই প্রধান দ্বন্দ্ব হবে বলে হান্টিংটন মনে করেছিলেন। এ কারণে যারা ইসলাম ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করেন, তাদের এ কাছে এ তত্ত্ব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। হান্টিংটনের তত্ত্ব ইসলামবাদী রাজনীতির বিকাশে একটা শক্ত ভিত্তি দিয়েছিল।
এনসিপির একটি বড় দুর্বলতা হলো এ সভ্যতাকেন্দ্রিক তত্ত্বকে ধরে তারা বাংলাদেশে কীভাবে তাদের রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, তার কোনো ব্যাখ্যা এখনো দিতে পারেননি তারা।
একইভাবে স্পষ্ট করেননি কীভাবে তারা নন-বাইনারি, অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি করবেন। সব ঘরানার কমিউনিস্ট ও মার্কসবাদীরা মনে করেন, নন-বাইনারি রাজনীতি তখনই সম্ভব, যখন সব রাষ্ট্র বিলুপ্ত হয়ে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠিত হবে। বাইনারি প্রত্যয়ের জায়গায় অবশ্য তারা ব্যবহার করেন দ্বন্দ্ব প্রত্যয়।
কমিউনিজমকে অনেকে কল্পিত বা ইউটোপীয় মনে করেন, যা বাস্তবে অর্জন অসম্ভব। কমিউনিজমের একটা দুর্বল বাংলা করা হয়েছে সাম্যবাদী সমাজ, যেখানে সব শ্রেণি বিলুপ্ত হবার ফলে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, জেন্ডারসহ সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে যত রকমের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে, তার সবকিছুরই অবসান ঘটবে। দ্বন্দ্বের অবসান হলে রাজনীতিরও অবসান হবে; কেননা অর্থনৈতিক, সামাজিকসহ নানাবিধ দ্বন্দ্বের প্রতিফলনই হলো রাজনীতি।
সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত কমিউনিস্টরা মনে করেন, রাষ্ট্র এবং সমাজে নানাবিধ দ্বন্দ্ব বিদ্যমান থাকবে। এ সমস্ত দ্বন্দ্বের মধ্যে দুটি প্রধান বিপরীত শক্তির মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, সেটি হলো প্রধান দ্বন্দ্ব— যা একটি রাষ্ট্র, সমাজ এবং রাজনীতির মূল গতিপথ নির্ধারণ করে।
দ্বন্দ্ব প্রত্যয়টিকে এনসিপির সঙ্গে যুক্ত অনেকে প্রতিস্থাপন করেছেন বাইনারি প্রত্যয় দিয়ে। অর্থাৎ, রাষ্ট্র দুটি প্রধান বিপরীতমুখী শক্তি, দল, মতাদর্শ এবং সংস্কৃতির ধারায় ও ধারণায় বিভক্ত। তাদের আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে, এ বাইনারি বা বিভক্তির অবসান ঘটানো।
এনসিপি সংশ্লিষ্টরা রাজনীতিতে নতুনত্ব আনা বিষয়ক নানা কথা বললেও রাষ্ট্র এবং সমাজে বৈষম্যের উৎসভূমি যে অর্থনীতি, ওই ব্যাপারে রয়েছেন সম্পূর্ণ নীরব। ফলে তারা কী ধরনের অর্থনীতি চান, অথবা বর্তমান মুক্তবাজার নির্ভর পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে থেকে তারা কীভাবে বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্র গড়ে তুলবেন— ওই বিষয়গুলো এখনো পরিষ্কার করতে পারেননি।
উপরন্তু যে বিষয়টি জনমানসে প্রতিভাত হচ্ছে তা হলো, পুরানো রাজনৈতিক বন্দোবস্তে আওয়ামী লীগ, বিএনপির মতো বুর্জোয়া দলগুলোর সঙ্গে পুঁজিপতি শ্রেণির যে সম্পর্ক, ওই একই ধরনের সম্পর্ক এনসিপি গড়তে চাচ্ছে এ শ্রেণিটির সঙ্গে। সম্ভবত এর ফলেই বেতন, ভাতাসহ নানা বিষয়ে শ্রমিক শ্রেণি এবং শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর যে বঞ্চনা, তার পাশে এনসিপিকে দাঁড়াতে দেখা যাচ্ছে না।
শুধু তাই নয়, এনসিপির ইফতার সংস্কৃতিতে দেখা গেছে পুরাতন বন্দোবস্তের ওই বৈষম্যের প্রতিফলন। রাস্তার পাশে, না পাঁচ তারকা হোটেলে ইফতার পার্টির আয়োজন করা হবে, দলটি সেটা ঠিক করেছে শ্রেণিভেদ বিবেচনায়। এনসিপির এ ধরনের চর্চা শুরুতেই দলটির বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
এসবের পাশাপাশি এনসিপি নেতাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, মাঠের রাজনীতির চেয়ে ফেইসবুক নির্ভর রাজনীতির প্রতি বেশি আগ্রহ, দলীয় নেতৃত্বের ফেইসবুকে জনপ্রিয় হবার আকাঙ্ক্ষা, দলের অভ্যন্তরীণ বিষয় খোলামেলাভাবে ফেইসবুকে পোস্ট দেওয়া ইত্যাদি সবকিছুই নেতৃত্বের অপরিপক্কতার দিকে দিকনির্দেশ করে।
পরিপক্কতার অভাব অথবা নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা বা উভয় কারণেই এখন পর্যন্ত এনসিপি বিশেষ কোনো একজনকে— যেটা সাধারণত দলের সভাপতি বা ক্ষেত্রবিশেষে সাধারণ সম্পাদক হয়ে থাকেন— গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে জাতির সামনে তুলে ধরেনি। ফলে সাধারণ জনগণের অনেকের কাছেই এনসিপি নেতৃত্বের সঙ্গে সেভাবে পরিচয় ঘটছে না— যেটি একটি দলের বিকাশের জন্য ইতিবাচক নয়।
এনসিপি মূলত গড়ে উঠেছে শহুরে মধ্যবিত্ত তরুণ শ্রেণির একটি অংশকে ঘিরে। কিছু ব্যতিক্রম বাদে এদের প্রায় সবাই সেক্যুলার প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছেন। দলটিতে অন্য শ্রেণি, পেশা এবং বয়সের মানুষ প্রায় অনুপস্থিত।
বিগত প্রায় তিন দশক ধরে বাংলাদেশে পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিকাশের ফলে নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির রূপান্তরের মধ্য দিয়ে একটি নতুন শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছে। মার্ক্সবাদী লিটারেচার অনুযায়ী, এ মধ্যবিত্ত শ্রেণির মাঝেই সবচেয়ে বেশি লুম্পেন বা সুবিধাবাদী প্রবণতা বিরাজমান।
মধ্যবিত্ত শ্রেণির তরুণ অংশটি খুব দ্রুত দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে আধুনিকায়ন প্রত্যাশী। এ আধুনিকায়ন সম্পর্কে তাদের মনোজাগতিক অবস্থান মিশ্র। লক্ষ্যণীয় যে, তাদের কাছে উন্নয়নের মডেল হচ্ছে ব্যাংকক বা সিঙ্গাপুর, দোহা বা দুবাই নয়। গত সাড়ে পনের বছর একটানা আওয়ামী শাসনামলে এ আকাঙ্ক্ষার জন্ম হয়। তবে এ তরুণ সমাজের উল্লেখযোগ্য অংশ একই সঙ্গে এটাও মনে করেন, উন্নয়নের এ মডেলটা হতে হবে শুধুই অবকাঠামোগত— মতাদর্শিক বা সাংস্কৃতিক নয়।
সংস্কৃতি, রাজনীতি এবং আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে এ অংশটি মুসলিম সত্ত্বা এবং ইসলামের ভূমিকা দেখতে আগ্রহী। এ আকাঙ্ক্ষা অবশ্য মৌলিক বা নতুন নয়— ১৯৪৭ সালের কিছু আগে থেকেই বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠবার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, সে সময় থেকেই মননগতভাবে তাদের বড় অংশটি এ ধারণা লালন করতেন— যা ক্রমান্বয়ে মুসলিম সমাজে প্রভাবশালী আকাঙ্ক্ষা হয়ে উঠে এবং পাকিস্তান আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এ ধারণার একটি শক্তিশালী অবস্থানিক ধারাবাহিকতা ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে, এমনকি ১৯৭১-এ বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরেও জোরালোভাবে রয়ে যায়। এটি বর্তমানেও শ্রেণি নির্বিশেষে মুসলমান সমাজের একটি প্রভাবশালী আকাঙ্ক্ষা। আজকের উঠতি নব্য মধ্যবিত্ত তরুণদের উল্লেখযোগ্য অংশও এ আকাঙ্ক্ষা দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। এ ধরনের চিন্তাধারার তরুণদের একটা বড় উপস্থিতি এনসিপিতেও রয়েছে।
এ তরুণরা একই সঙ্গে জুলাই আন্দোলনের যে মর্মবস্তু— সাম্য, মানবিক মর্যাদা, ন্যায়বিচার, ইনক্লুসিভনেস, গণতন্ত্র, বৈষম্যহীনতা এবং বহুত্ববাদিতার ভিত্তিতে নতুনভাবে রাষ্ট্র গড়ে তুলতে আগ্রহী। এসবই হলো বামপন্থী ধারণা; বা আরও স্পষ্ট করে বললে, পশ্চিম ইউরোপে সোভিয়েত ধাচের সমাজতান্ত্রিক মতবাদের বিপরীতে যে নিউ লেফট বা নব্য বামপন্থী ধারণা গড়ে উঠেছিল, তার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ ধারণা। ফলে এনসিপির সামনে যে চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে তা হলো, দলটিতে যুক্ত ডানপন্থী চিন্তা চেতনার বিপুল সংখ্যক তরুণদের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে জুলাই আন্দোলনের মর্মবস্তুর সামঞ্জস্য ঘটানো।
সামঞ্জস্য ঘটাবার লক্ষ্য নিয়েই হয়তো এনসিপি মধ্যপন্থী দল হিসেবে নিজেদের পরিচিত করাতে চাচ্ছে, যদিও রাজনৈতিক অবস্থানের দিক থেকে তাদের ঝোঁক ডানপন্থার দিকে বলে জনমানসে পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিএনপি নিজেদের পরিচয় দেয় মধ্য ডানপন্থী দল হিসেবে। অবশ্য রাজনৈতিক চর্চার দিক থেকে তাদের মধ্যে গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে ডানপন্থার ঝোঁক স্পষ্ট।
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ, বিএনপির সম্মিলিত ভোট ব্যাংক মোটা দাগে ৮৫ শতাংশ। বাকি ১৫ শতাংশ ইসলামবাদী, জাতীয় পার্টি, বামপন্থী এবং অন্যান্যদের। এনসিপি আগামীদিনে কতটা সফল হবে তা নির্ভর করছে বিএনপির ভোট ব্যাংককে কতটা সফলতার সঙ্গে তারা তাদের পক্ষে আনতে পারবে তার ওপর।
আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি যেহেতু এনসিপির সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের দ্বারাই ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে, তাই ব্যতিক্রমী দুই-একজন বাদে, এ অংশের সমর্থন এনসিপির পাবার কথা নয়। তাদের লক্ষ্যও ওদিকে নয়। কিছু ব্যতিক্রম বাদে ইসলামবাদী বা বামপন্থী অংশের ভোট এবং সমর্থনও তারা পাবেন না। সুতরাং তারা পুরোপুরি টার্গেট করবেন বিএনপির ভোট ব্যাংক এবং সমর্থনকে লক্ষ্য করে।
এনসিপি যদি এতে সফল হয় তাহলে বিএনপির রাজনীতি প্রান্তে চলে যেতে পারে। আর তারা যদি সফল হতে না পারে, তাহলে রাজনীতিতে তাদের অবস্থা এক এগারোর সময় সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত ফেরদৌস আহমদ কোরেশীর দল পিডিপির মতো হতে পারে।
আরও পড়ুন