Published : 28 Apr 2025, 12:58 PM
দাউদ হায়দার চলে গেলেন ৭৩ বছর বয়সে। ২২ বছর বয়সে তিনি দেশান্তরিত হয়েছিলেন। যে-কবিতাটির জন্য তাকে আজীবন দেশান্তরের শাস্তি বয়ে বেড়াতে হয়েছিল সেটি প্রকাশিত হয়েছিল ২২ জানুয়ারি ১৯৭৪ সালে দৈনিক সংবাদ-এ।
পরের দিনই শুরু হয়েছিল দাউদ হায়দারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও মিছিল। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি নবীকে অবমাননা করেছেন। ঘটনাটি ঘটেছে ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে স্বাধীন হওয়া দুই বছর বয়সী বাংলাদেশে, যখন কিনা রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
কবিতাটির নাম ছিল ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যা’। কী ছিল ওই কবিতায়, তা অনেকেরই জানা আছে।
কবিতাটি যে খুব অসাধারণ কিছু, এমনটা সত্যিকারের কাব্যরসিক কিংবা কাব্যসমালোচকরা হয়তো বলবেন না। কিন্তু ২২ বছর বয়সী এক সদ্যযুবকের কবিতা হিসেবে এটি মোটেই অপরিপক্ক মন ও উপলব্ধিজাত ছিল না। তবে ধর্মের পান থেকে চুন খসিয়ে ফেলার মতো গোস্তাকি করার কারণে তাকে প্রথমে কারারুদ্ধ করা হয়েছিল।
কবিকে কারারুদ্ধ করেও ধর্ম অবমাননার অভিযোগকারীদের রোষ নেভাতে পারবে না ভেবেই সম্ভবত তৎকালীন সরকার তাকে দেশান্তরিত করতে বাধ্য হয়। দাউদ হায়দার অবশ্য তাকে নির্বাসন দণ্ডে পাঠাবার জন্য সেই সময়কার সরকারকেও দায়ী করেছেন তার লেখায় এবং সাক্ষাৎকারেও।
ধর্মের দোহাই দিয়ে একাত্তর সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিল একটি গোষ্ঠী, অজুহাতে তারা মুসলমান হয়েও মুসলমানদের হত্যা এবং নারীদের লজ্জা ও সম্ভ্রম লুণ্ঠনে পাকিস্তানিদের সাহায্য করেছিল, সেই গোষ্ঠীর আপত্তিতেই দাউদ হায়দারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
এর মধ্য দিয়ে জন্মের মাত্র দুই বছরের মাথায় বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির আদর্শিক পরাজয় সূচিত হতে শুরু করে তাদেরই শাসনামলে, যারা সেই আদর্শের জন্য লড়াই করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছিল। এবং করুণ পরিহাস, সেই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরাই ছিল তখন রাষ্ট্রক্ষমতায়।
প্রশ্ন এটাও, যারা ধর্মনিরপেক্ষতার স্লোগান তুলেছিলেন, তারা কি সেটাকে শুধুই স্লোগান হিসেবে নিয়েছিলেন জনরঞ্জনের লোভে? তা না হলে কেন এত দ্রুত পরাজিতদের কাছেই পরাজয় মেনে নেয়ার নির্বাহী আয়োজন শুরু হয়ে গিয়েছিল?
ধর্ম এক স্পর্শকাতর বিষয়। আর সেটা রাজনীতিবিদদের চেয়ে এত ভালো আর কে জানে! তারাই তো এর ব্যবহার করেন বেশি। কিন্তু রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সমাজে যে সংক্রমণ শুরু হয়েছিল, তা ঠেকাবার কোনো প্রস্তুতি তখনকার ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদদের ছিল না। বঙ্গবন্ধু নিজেও এর বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন বলে মনে হয় না। ফলে, ১৯৭৪ সালের জানুয়ারিতে দাউদ হায়দারের শাস্তির দাবিতে যখন রাজশাহী উত্তাল হয়ে উঠল, তখন তাকে গ্রেপ্তার করা ছাড়া আর উপায় ছিল না।
শুধু গ্রেপ্তারই নয়, নিজেকে নিরাপদ রাখতে সরকার তখন কবিকে দেশান্তরিত করাই নিরাপদ ভেবেছিল। দাউদ হায়দার ২২ বছর বয়সে মাতৃভূমি হারালেন। আর শাসকরা কী হারালেন?
দাউদ হায়দার হলেন বাংলাদেশের প্রথম নির্বাসিত লেখক। তাকে নির্বাসনের মাধ্যমে বাংলাদেশও আদর্শচ্যুত হয়ে নির্বাসিত হলো গোলকধাঁধায়।
দাউদ হায়দার নির্বাসিত জীবনের প্রথম যে দেশে আশ্রয় পেয়েছিলেন, সেটি পার্শ্ববর্তী ভারত। এও এক কৌতুক, যে রাজনৈতিক দলটির সময়ে কবি নির্বাসিত হয়েছিলেন, সেই দলটির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বেশির ভাগ এখন নির্বাসিত ওই ভারতে।
দাউদ হায়দার দেশ হারিয়েছেন বটে, তবে ভারতে গিয়ে তিনি গৌরকিশোর ঘোষ, অন্নাদশঙ্কর রায় এবং পরে আবু সয়ীদ আইয়ুবের মতো মনীষীদের আশ্রয় থাকার সুযোগ অর্জন করেছিলেন। লীলা রায়ের মতো প্রথম সারির লেখক ও অনুবাদক তার পাঁচটি বই অনুবাদ করেছেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন শঙ্খ ঘোষ, স্বপন মজুমদার, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেশ গুহ, সুবীর রায় চৌধুরী, নবনীতা দেবসেন প্রমুখ লেখককে। আর সবশেষে গুন্টার গ্রাসের সহায়তায় ১৯৮৭ সালে তিনি জার্মানিকে দেশ হিসেবে বরণ করে নেন।
দাউদ হায়দারকে আমি কখনো দেখিনি, তার সাথে আমার কোনো মাধ্যমে পরিচয়ও হয়নি কখনো। কিন্তু আমাদের লেখকজীবনের শুরু থেকেই তার নাম ও লেখার সাথে পরিচিত হয়ে উঠেছিলাম। আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, সৈয়দ হক বা মান্নান সৈয়দের মতো প্রথম সারির লেখক ছিলেন না বটে, কিন্তু ওই নির্বাসনে থাকতে বাধ্য হওয়ার কারণে তিনি অত্যন্ত পরিচিত ছিলেন লেখক-শিল্পীদের মধ্যে।
তার ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’ বইটির কথা আমাদের মুখস্তপ্রায়। যে-কবিতাটির জন্য গুরুদণ্ড পেয়েছেন, সেটিও আমাদের পড়া হয়ে গেছে, যদিও সেটা কোনো বইয়ে জায়গা পায়নি। কবি নিজেই, নির্বাসিত হওয়ার আগে, ওই কবিতার জন্য ক্ষমা চেয়ে বলেছিলেন কবিতাটি তিনি তার কোনো গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করবেন না। তখনও পর্যন্ত প্রকাশিত তার কোনো গ্রন্থে আমরা সেই কবিতা খুঁজে পাইনি। কিন্তু বইয়ে না পেলেও, নিষিদ্ধ বস্তু দুষ্প্রাপ্য থাকে না।
দাউদ হায়দার নির্বাসিত বলে যেমন একটা আকর্ষণ হিসেবে ছিলেন সত্তরের ও আশির দশকে, তেমনি, হঠাৎ করে আশির দশকের একেবারে শুরুতেই অলোকরঞ্জনের ‘লঘুসংগীত ভোরের হাওয়ার মুখে’ নামক কাব্যগ্রন্থে ‘দাউদ হায়দার’ শীর্ষক একটি কবিতা পড়ে অন্য এক সমীহ জেগে উঠেছিল। অলোকরঞ্জন মানেই কবিকুল চূড়ামনি, কবিকঙ্কন, কুলীনকুলসর্বস্ব এক ব্যক্তিত্ব। সেই তিনি দাউদ হায়দারকে নিয়ে আস্ত একটি কবিতা লিখে ফেলেছেন দেখে চমৎকৃত হয়েছিলাম।
দাউদ হায়দারের মতো নির্বাসিত হওয়ার দুর্ভাগ্য আমার হয়নি বটে, কিন্তু প্রবাসে থাকার অভিজ্ঞতা থেকে দীর্ঘ সময় দেশ থেকে দূরের থাকার মনোকষ্ট বুঝতে পারি। অবশ্য এই মনোকষ্ট নির্বাসিতের শতভাগের এক ভাগের সমানও নয়, কারণ প্রবাসী জানে সে দেশে ফিরতে পারবে, তার দেশ আছে তা সে যত দূরেই হোক না। কিন্তু নির্বাসিত জন জানেন যে তার দেশ উধাও হওয়ার সাথে কেবল ভূখণ্ড নয়, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবসহ সবই উধাও হয়ে যায়।
দাউদ হায়দার মাতৃভূমি থেকে বঞ্চনার শেষ বিষটুকু পান করে ২৬ এপ্রিল বার্লিনে অনন্ত নির্বাসনে চলে গেলেন।
দাউদ হায়দার যে-বয়সে দেশান্তরিত হয়েছেন সেই বয়সে নতুন কোনো দেশকে সহজেই নিজের দেশ করে নিতে পারতেন, হয়তো করেছেনও। পশ্চিমবঙ্গের সাথে আমাদের সাংস্কৃতিক ও ভাষিক সাদৃশ্যের কারণে সেই ভারতের সেই রাজ্যটিকে নিশ্চয় তার কাছে দূরের মনে হতো না। তবুও তা শেষ পর্যন্ত বিদেশই।
জার্মানি তো ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ও ভাষিক, সব দিক থেকেই দূরবর্তী। তবু চল্লিশ বছরের নির্বাসনে সেটিও নিজের দেশ বলে মনে হওয়ার কথা। কিন্তু দাউদ হায়দারের ক্ষেত্রে সেটা যে শেষ পর্যন্ত হয়নি তার প্রমাণ নিচের এই কবিতা।
“আকাশে জমেছে মেঘ, বাতাসে বৃষ্টির গান
রাত্তির বড় দীর্ঘ; কিছুতেই
ঘুম আর আসছে না। একবার এপাশ, একবার ওপাশ, আর
বিশ্বচরাচর জুড়ে… নিথর স্তব্ধতা।
মাঝে মাঝে মনে হয়
অসীম শূন্যের ভিতরে উড়ে যাই।
মেঘের মতন ভেসে ভেসে, একবার
বাংলাদেশ ঘুরে আসি।
মনে হয়, মনুমেন্টের চুড়োয় উঠে
চিৎকার করে
আকাশ ফাটিয়ে বলি:
দ্যাখো, সীমান্তের ওইপারে আমার ঘর
এইখানে আমি একা, ভিনদেশী।”
(‘তোমার কথা’– দাউদ হায়দার)
একটা রাষ্ট্র মানুষকে নির্বাসিত করতে পারে, ছিনিয়ে নিতে পারে তার জন্মভূমিকে। কিন্তু যে দেশ থেকে তিনি বঞ্চিত হয়েছেন, সেই দেশটিকে যে তিনি কখনোই ছেড়ে দেননি, দিতে পারেননি, সেই যন্ত্রণা আকুতির অক্ষরে ধ্বনিত হয়েছে এই কবিতায়।এই বঞ্চনা ও যন্ত্রণা সত্ত্বেও আমি কখনো তার কোনো লেখায় মাতৃভূমির প্রতি কোনো ক্রোধ বা কুৎসা উগড়ে দিতে দেখিনি। তাকে আমার শেষ প্রণতি।