কাশ্মীর ভারতের একটি সংবেদনশীল, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে জটিল অঞ্চল। এখানে উন্নয়ন চাই, কিন্তু চাই সংলাপও। চাই সেনা, কিন্তু চাই হৃদয়ের সম্পর্কও।
Published : 26 Apr 2025, 08:38 PM
পেহেলগামের নির্জন পাইনবনে যখন বুলেটের শব্দে আকাশ বিদীর্ণ হচ্ছিল, তখন সেখানে উপস্থিত পর্যটকদের মনে হচ্ছিল এটা কোনো দুঃস্বপ্ন। কিন্তু এটি ছিল নির্মম বাস্তবতা। জঙ্গিদের টার্গেটেড হামলায় ২৬ জন নিরীহ পর্যটকের প্রাণহানি শুধু একটি সংখ্যা নয়, এটি ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর এক কঠিন প্রশ্নচিহ্ন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে রাজনৈতিক আলোচনা শুরু হয়েছে, তা সমস্যার সমাধান না করে বরং নতুন সংকট তৈরি করছে।
এই ঘটনার বিশ্লেষণে আমাদের স্পষ্ট করে বুঝে নিতে হবে— এটা নিছক জঙ্গি হানা নয়, বরং এক বহুমাত্রিক সন্ত্রাস। এতে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ জড়িত, আছে ভৌগোলিক নিরাপত্তার প্রশ্ন, আছে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা এবং আছে আন্তর্জাতিক চক্রান্তের আভাস। কাশ্মীরে হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি নিয়ে কথা বলার আগে একটি প্রশ্ন মাথায় আসে— মানুষকে হত্যা করে আসলে কোন স্বার্থ হাসিল করা যায়? এই হত্যাকাণ্ডে পাকিস্তানি জঙ্গিরা জড়িত বলে নানা মহল থেকে অভিযোগ উঠেছে। জঙ্গি গ্রুপগুলোর কেউ কেউ হত্যাকাণ্ডের দায়ও স্বীকার করেছে।
তবে এই হত্যাকাণ্ডের পর ভারতে যা চলছে, তা আরও ভয়ানক। কিছু রাজনৈতিক দল এই ঘটনাকে ধর্মীয় বিভাজনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে, যেন এটাই তাদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ, যাদের অধিকাংশই মুসলিম, তারা এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। পেহেলগামের পর উপত্যকাজুড়ে বন্ধ পালিত হয়েছে, মোমবাতি জ্বালিয়ে শোক প্রকাশ করা হয়েছে। তাহলে কেন এই হত্যাকাণ্ডকে মুসলিম বিরোধী প্রচারণায় রূপ দেওয়ার চেষ্টা চলছে?
এই হামলার সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি নিরাপত্তা ব্যবস্থার ব্যর্থতা নিয়ে। একটি পর্যটন স্পট, যেখানে প্রতিদিন শতাধিক মানুষ আসেন। অথচ হামলার সময় সেখানে কোনো কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী ছিল না। গোয়েন্দা তথ্য কি একেবারেই ছিল না? নাকি প্রশাসনের ঔদাসীন্যেই এই হামলা সম্ভব হয়েছে? ভারত তাদের গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা নিয়ে যে বড় বড় কথা বলে কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে এক ভয়ানক শূন্যতা। ২০১৯ সালে ৩৭০ ধারা বাতিলের পর সরকার দাবি করেছিল যে কাশ্মীরে শান্তি ফিরেছে। কিন্তু তারপরও উরি, পুলওয়ামা, অমরনাথ— একের পর এক হামলায় প্রাণ গেছে নিরীহ মানুষের। প্রতিবারই সরকার ‘কড়া জবাব’ দেওয়ার কথা বলে, কিন্তু জঙ্গিরা ফের মাথা চাড়া দেয়। এবারও একই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু সাধারণ মানুষের আস্থা ক্রমশ কমছে।
আন্তর্জাতিক অনেক সংবাদমাধ্যম বলছে, পাকিস্তানে প্রশিক্ষিত জঙ্গিদের মূল লক্ষ্য কাশ্মীরের অর্থনীতিকে ধ্বংস করা। পর্যটন কাশ্মীরের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। গত কয়েক বছরে শান্তি ফিরে আসায় পর্যটক সংখ্যা বেড়েছে। ২০২৩ সালে প্রায় ৩০ লাখ পর্যটক কাশ্মীর ভ্রমণ করেছিলেন। এই প্রবৃদ্ধি ভারত বিরোধীদের জন্য অসহনীয়। তাই তারা পর্যটকদের ওপর হামলা চালিয়ে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করতে চায়। তাদের কৌশল সফল হলে কাশ্মীর আবারও পর্যটকশূন্য হয়ে পড়বে, বেকারত্ব বাড়বে এবং স্থানীয় তরুণরা জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকবে। কিন্তু এই গোটা পরিকল্পনা ব্যর্থ হবে যদি কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ জঙ্গিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। পেহেলগাম হামলার পর স্থানীয়দের প্রতিবাদ দেখে তা স্পষ্ট।
এবার যে হামলা হয়েছে, তা একেবারে নতুন মাত্রা তৈরি করেছে। কারণ, এই প্রথম খুনের আগে পরিচয় যাচাই করে, ধর্ম দেখে হত্যা করা হল। এ এক নির্মম ‘টার্গেট কিলিং’। এই পদ্ধতি শুধু জঙ্গিদের কৌশলের রূপান্তর নয়, বরং এর পেছনে কাজ করছে একটি গভীর মনস্তত্ত্ব— দেশে সাম্প্রদায়িক বিভাজন বাড়িয়ে, ভয় দেখিয়ে, আতঙ্ক ছড়িয়ে উন্নয়নের গতি রুদ্ধ করা। এবং এই কাজটিই সুচারুভাবে করতে সাহায্য করছে দেশের কিছু রাজনীতিক ও মিডিয়া হাউজ। তারা ঘটনাটিকে ব্যবহার করছে একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণা উসকে দিতে। ‘পাকিস্তানি জঙ্গি’ শব্দটা আস্তে আস্তে ঘুরে গিয়ে হয়ে উঠছে ‘মুসলিম জঙ্গি’, আর সেখান থেকে সরাসরি চলে যাচ্ছে ‘মুসলিম’। এ এক ভয়ঙ্কর স্লিপেজ, যা দেশের সামাজিক কাঠামোকে আরও দুর্বল করে তুলছে।
এই পরিস্থিতিতে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠেছেন সইদ আদিল হুসেন শাহের মতো মানুষ। তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন, মানবতা সবকিছুর ঊর্ধ্বে। আদিল যদি হিন্দুদের প্রাণ রক্ষায় নিজের প্রাণ দিতে পারেন, তবে এই ঘটনার দায়ভার আর কেবলমাত্র ধর্ম দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। একইভাবে পশ্চিমবঙ্গের ঝণ্টু আলি শেখ, যিনি দেশের রক্ষায় প্রাণ দিয়েছেন— এই সেনা জওয়ানের আত্মবলিদানও স্মরণ করিয়ে দেয়, জাতীয় নিরাপত্তা এবং দেশপ্রেম কোনও ধর্মবিশেষের একচেটিয়া সম্পত্তি নয়। এই সব উদাহরণই বলে, লড়াইটা ধর্মের নয়, মানবতা ও জঙ্গিবাদের মধ্যে।
এমন এক সংকটের মুহূর্তে রাজনৈতিক নেতারা যদি এই মানবিক দৃষ্টিকোণ ভুলে গিয়ে নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করেন, তবে তাতে শেষ পর্যন্ত লাভ জঙ্গিদেরই হয়। এবং এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন ওঠে আসে— ভারতের বর্তমান নরেন্দ্র মোদীর সরকার আদৌ মানুষের নিরাপত্তার প্রশ্নে কতটা আন্তরিক? একদিকে একের পর এক হামলা, অন্যদিকে পিছু পিছু ঘুরে বেড়ানো প্রতিশ্রুতির ভূত। নোটবন্দির সময় বলা হয়েছিল, জঙ্গিবাদের ফান্ডিং বন্ধ হয়ে যাবে। সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের পর দাবি করা হয়েছিল, জঙ্গি ঘাঁটি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। পুলওয়ামার পর প্রতিশোধ নেওয়ার আশ্বাসে মুখর হয়েছিল গোটা শাসকদল। অথচ পেহেলগাম আবারও প্রমাণ করল—সমস্যার মূল জায়গাগুলোকে অবজ্ঞা করে শুধু প্রচার দিয়েই স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়।
কাশ্মীর ভারতের একটি সংবেদনশীল, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে জটিল অঞ্চল। এখানে উন্নয়ন চাই, কিন্তু চাই সংলাপও। চাই সেনা, কিন্তু চাই হৃদয়ের সম্পর্কও। যে উপায়ে মানুষ জয় করা যায়, সেই উপায়েই শান্তি টেকসই হয়। শুধু ভয় দেখিয়ে, দমননীতি দিয়ে হয়তো সাময়িক নিয়ন্ত্রণ আনা যায়, কিন্তু মন জয় করা যায় না। আজ প্রয়োজন, কেন্দ্র সরকার একটি দীর্ঘমেয়াদি, মানবিক, কৌশলগত কাশ্মীর নীতি তৈরি করুক। শুধু নিরাপত্তা নয়, চাই শিক্ষার প্রসার, চাকরির সুযোগ, তরুণদের জন্য ভবিষ্যতের স্বপ্ন।
একটি বড় ভুল যেটা মোদি সরকার বারবার করে এসেছে—তা হলো, জাতীয় নিরাপত্তাকে এক ধরনের রাজনৈতিক পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করা। প্রতিটি হামলার পর একদিকে বিরোধীদের দেশদ্রোহী তকমা দেওয়া, অন্যদিকে নিজেরাই নায়ক হয়ে উঠার চেষ্টা। কিন্তু মানুষ আজ প্রশ্ন করছে—এই নায়কত্বের ফল কী? মানুষ যদি জঙ্গিদের হাতে অকাতরে খুন হন, তবে এই সরকার কার স্বার্থ রক্ষা করছে?
আজ দরকার মুখের বুলি নয়, কাজ। দরকার জাতীয় ঐক্য, তথ্যনির্ভর নিরাপত্তা কৌশল এবং সাংবিধানিক মূল্যবোধে অবিচল থাকা। কাশ্মীরকে ‘ভূস্বর্গ’ বলা হয়—কিন্তু সেই স্বর্গে যদি অবিরত রক্ত ঝরে, তবে সেই নাম একদিন ইতিহাস হয়ে যাবে। আর যদি দেশজুড়ে মানুষের মধ্যে অবিশ্বাস, ঘৃণা, বিভেদ ছড়িয়ে পড়ে—তবে জঙ্গিরা সফল হবে তাদের আসল মিশনে।
এই পরিস্থিতির আরেকটি বিপজ্জনক দিক হলো, এর প্রভাব ভারতের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা। বিশেষ করে বাংলাদেশে। আমাদের দেশে এমনিতেই ভারতবিরোধী এবং হিন্দুবিরোধী মনোভাবের একটি সুপ্ত স্রোত বহুদিন ধরে কাজ করছে। কাশ্মীরে মুসলিম পরিচয় দেখে হিন্দু হত্যার প্রচারণা যদি প্রবল হয়, তবে বাংলাদেশেও কিছু উগ্র গোষ্ঠী এই সুযোগ কাজে লাগাতে চাইবে। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে দিতে, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ঘটাতে তারা মরিয়া হয়ে উঠতে পারে। অতীতে দেখা গেছে, ভারতের কোনো ঘটনার পর বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর প্রতিশোধমূলক হামলার নজির রয়েছে। ফলে এখনই সতর্ক হতে হবে।
বাংলাদেশ ও ভারতের শাসকদের এই মুহূর্তে বিশেষ দায়িত্ব নিতে হবে। উভয় দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বুঝতে হবে, সাম্প্রদায়িক বিভাজন কেবল জঙ্গিদেরই হাত শক্ত করে। তাই এখন প্রয়োজন কূটনৈতিক স্তরে সমন্বয়, গোয়েন্দা তথ্যের আদান-প্রদান, এবং অভ্যন্তরীণ শান্তি রক্ষায় সক্রিয় উদ্যোগ। কেবল আইনশৃঙ্খলা নয়, রাজনৈতিকভাবেও একটা স্পষ্ট বার্তা দরকার—ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের রক্ষা করা শুধু মানবিক দায়িত্ব নয়, এটি জাতীয় নিরাপত্তার অংশও।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আগে যেমন অভিন্ন সন্ত্রাস দমনের জন্য চুক্তি হয়েছে, এখন সময় এসেছে অভিন্ন সাম্প্রদায়িক সহিংসতা প্রতিরোধের কৌশল তৈরির। জঙ্গিবাদ আর সাম্প্রদায়িকতা একই মুদ্রার এপিঠ–ওপিঠ। একটিকে উপেক্ষা করলে অপরটি মাথাচাড়া দেবে। তাই এখনই প্রয়োজন, দুদেশের মধ্যে একটি যৌথ রাজনৈতিক ঐকমত্য—নাফ নদী থেকে গঙ্গা অবধি, পদ্মা থেকে ইন্দাস পর্যন্ত যেন কোনো মানুষ শুধু তার ধর্মের জন্য আক্রান্ত না হয়।
পেহেলগামের রক্তপাত শুধু ২৬টি প্রাণ নেয়নি, এটি ভারতের ঐক্য ও ধর্মনিরপেক্ষতার মর্যাদাকেও আঘাত করেছে। জঙ্গিরা চায় এই ভারতে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হোক, কিন্তু মনে রাখতে হবে— সইদ আদিল হুসেন শাহ যেমন হিন্দুদের বাঁচাতে জীবন দিয়েছেন, তেমনি ঝণ্টু আলি শেখও দেশের জন্য লড়াই করে শহিদ হয়েছেন।
পেহেলগামের ঘটনাটি কেবল কাশ্মীর বা ভারত নয়, এটি গোটা উপমহাদেশের জন্য একটি সতর্কবার্তা। আজ লড়াই শুধু সীমান্তে নয়— চিন্তার সীমান্তেও। মানবতার পক্ষে দাঁড়াতে হবে, বিভাজনের বিরুদ্ধে। প্রতিশোধের আবেগ নয়, প্রতিরোধের প্রজ্ঞা চাই। মোহের অন্ধকার নয়, মুক্তির আলোর দিকে এগিয়ে যেতে হবে। কাশ্মীরের স্বর্গীয় সৌন্দর্য রক্ষা করতে হলে আগে রক্ষা করতে হবে মানুষের অন্তর্নিহিত মানবতাকে। ধর্ম নয়, জাতি নয়, ভাষা নয়— সবকিছুর ঊর্ধ্বে আজ দরকার একটাই পরিচয়— মানুষ।