মুন্সীগঞ্জের বিস্তীর্ণ জনপদ বন্যার পানিতে ডুবেছে; তার ওপর পদ্মায় বিলীন হচ্ছে গ্রামকে গ্রাম; ভিটেমাটি হারিয়ে নিদারুণ দুর্দশায় পড়েছে বহু মানুষ; হারানোর আতঙ্কে ভুগছে আরও অনেকে।
Published : 26 Jul 2020, 01:50 PM
লৌহজং উপজেলার ব্রাক্ষ্মণগাঁও গ্রামের গৃহবধূ নিলুফা বেগম তাদেরই একজন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বানের পানিতে ঘরবাড়ি সব তলাইছে, বইন (বোন)। ঘরে মাজা পানি। খড়কুটা দিয়া টং বানাইয়াও পালের গরুগুলান বাড়িতে রাখতে পারলাম না। পরে একটুখানি উঁচা রাস্তা পাইয়া অন্যের সাথে আশ্রয় নিছি। এখানেই গরু-বাছুরের সাথে আমরাও থাকি। গরু থুইয়া যামু কই?
নিলুফার তাদের গরুগুলো দেখিয়ে বলেন, “বন্যার কারণে পরিচর্যা নাই। খাওন পাইলে সেন দুধ দিত। দুধ পানাইতে গেলে লাথি মারে। রাস্তাও পানিতে ছুঁই ছুঁই। পানি উইঠ্যা গেলে গরু লাইয়া যামু কই? এই আত্রাবে আর কোনো শুকনা জায়গা নেই।”
নিলুফার স্বামী দলিল উদ্দিন হাওলাদার ধুলু (৪০) একজন কৃষক। গরু আর চাষাবাদেই তাদের সংসার চলে। ঘরে রয়েছে তাদের একমাত্র শিশুসন্তান, যার বয়স পাঁচ বছর, শ্বশুর মন্নাফ হাওলাদার (৭৫) ও শাশুড়ি সাফিয়া বেগম (৬৫)। তাদের আছে আটটি গরু আর চারটি বাছুর।
নিলুফার বলেন, “আমাগো খাওয়ার চেয়ে গুরুগুলোকে খাওয়ানো বেশি দরকার। কিন্তু ঘাসকুটা কিছুই নাই। সব তলাইয়া গেছে বানের পানিতে।”
আবার ঘর ভেঙে নিয়েইবা তারা যাবেন কোথায়।
“ওই চরে উঁচু জায়গা পাওয়া গেছে। তবে দূর একটু বেশি। এখান থেকে ছয়-সাত কিলোমিটার দূরে। সেখানে আমাগের আশপাশের পরিচিত অন্তত আড়াই শ পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়া আরও দুই শতাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে লৌহজং উপজেলা সদর ও আশপাশের গ্রামে।”
এলাকাবাসী জানান, গত ১০ দিনের নদীভাঙনে ওই এলাকার অন্তত সাড়ে তিনশ পরিবার বাস্তুহারা হয়েছে। মসজিদ, স্কুলসহ নানা প্রতিষ্ঠানও বিলীন হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক সেবা সংগঠন অ্যাপেক্স বাংলাদেশের জন্য প্রস্তাবিত স্কুলের জমিও বিলীন হয়ে গেছে।
প্লাবনে ডুবে জনপদ আবার স্রোতে-ভাঙনে দেবে যাচ্ছে বলে জানান এলাকাবাসী।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পদ্মার প্রবল স্রোতের মধ্যে পড়েছে জনপদটি। একরকম ধংসস্তূপ চারদিকে। লৌহজং উপজেলার পুরনো কমপ্লেক্স ভবনের পাশে লৌহজং-তেউটিয়া ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের পাশ দিয়ে এবং উপজেলা ভূমি দপ্তরের সামনে প্রতিদিন ভেঙে নিয়ে আসা ঘরবাড়ি নিয়ে ট্রলার ভিড়তে দেখা যায়। এছাড়া কনকসার ও হলদিয়া দিয়েও বাড়িঘর ভেঙে নিয়ে আসা ট্রলার ভিড়ছে।
স্থানীয় কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, ১৫০ হেক্টর আবাদি চর/জমি বিলীন হয়ে গেছে, যেখানে সবজি ও দুধ উৎপাদন হত ব্যাপক।
ঘরের উঠানেও ছিল অনেক সবজি। ডুবে যাওয়া ঘরের চালে বেয়ে ওঠা চালকুমড়া ও লতাপাতা এখনও ঝুলছে। ছোট ছোট মিষ্টি কুমড়াসহ লতাপাতা ঝুলে আছে।
উপজেলা পরিষদের তথ্যমতে, ১৯৯২ সালে ভাঙন শুরুর পর উপজেলার ৩৯ গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ১২ ইউনিয়নের উপজেলাটি এখন ১০ ইউনিয়নে রূপ নিয়েছে। ‘ধাইধা ইউনিয়ন পরিষদ’ অস্তিত্ব হারিয়েছে। আর লৌহজং ইউনিয়ন ও তেউটিয়া ইউনিয়নের একাংশ বিলীন অবশিষ্টাংশকে একসঙ্গে ‘লৌহজং-তেউটিয়া’ নামে একটি ইউনিয়ন গঠন করা হয়েছে।
ব্রাম্মনগাঁও, রাউৎগাঁও, পাইকারা, ভোজগাঁও, দুয়াল্লি, গাঁওপাড়া, সাইনহাটি, উত্তর দিঘলী, ঝাউটিয়া ও ধাইধা গ্রামের সহস্রাধিক পরিবার চরম দুভোর্গে দিনাতিপাত করছে।
পুরো ১০ গ্রামের কোথাও শুকনো জায়গা নেই। সবখানেই পানি আর পানি। রাউৎগাঁও-পাইকারা ছোট্ট রাস্তাটির একটি অংশ উঁচু। সেখানেই কয়েকশ গরু গাদাগাদি করে রাখা হয়েছে। তবে এই রাস্তাও পানি ছুঁই ছুঁই করছে। গো-খাদ্যের সংকট প্রকট। বানের পানিতে ভাসলেও আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে চায় না পরিবারগুলো। গরু-বাছুর নিয়ে বাড়ির কাছেই আছে এখনও। কিন্তু থাকা যে হবে না তাও তারা নিশ্চিত।
জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ দপ্তর জানিয়েছে, মুন্সীগঞ্জের ১৫৪ গ্রাম বন্যায় প্লাবিত হয়েছে, যেখানে রয়েছে প্রায় ২৯ হাজার পরিবার।
তাদেরই একজন কৃষক মহন বেপারী।
“এখন আবার কোথায় যাব জানি না। চারশ হাত পাশেই পদ্মা। সপ্তাহ খানেক আগে বাড়ির উঠানে পানি আসে। তিন দিন আগে রান্নাঘর, টিউবওয়েল ডুবে গেছে। থাকার ঘরেই রান্নাবান্না, খাওয়াদাওয়া চলে। দুই দিন ধরে পানি আরও বাড়ছে। এতে থাকার ঘরটিও প্লাবিত হতে পারে।”
বাদশা মাদবর বলেন, “ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে বড় কষ্টে আছি। বাচ্চাদের খাবারদাবারের অভাবে কষ্টে দিনযাপন করতে হচ্ছে। বাড়ি পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সাপের ভয় আছে। বাচ্চারা পানিতে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটার ভয়ে দিন কাটছে।”
জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ মুন্সীগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি বলেন, তারা ত্রাণতৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন। বন্যার্তদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। শুক্রবার থেকে সেখানে রান্না করা খাবার বিতরণ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া নদীভাঙন রোধের ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে তাগাদা দেওয়া হয়েছে।