দেশের সব এলাকায় লোড শেডিংয়ের ‘সমবণ্টন’ হচ্ছে না। ফলে কোনো কোনো এলাকায় বিদ্যুতের যাওয়া আসা কম, কোথাও আবার মানুষ অতিষ্ঠ।
Published : 02 May 2024, 01:36 AM
বিদ্যুতের রেকর্ড উৎপাদনের পরও নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, কারণ চাহিদা এর চেয়েও বেশি।
সরবরাহ সংকটের মধ্যে একদিনে সর্বোচ্চ ৩১০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত ঘাটতি থাকলেও সাধারণভাবে উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে ঘাটতি থাকছে এক থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট, যা চাহিদার ১৩ শতাংশের মত।
কিন্তু দেশের সব এলাকায় লোড শেডিংয়ের ‘সমবণ্টন’ হচ্ছে না। ফলে কোনো কোনো এলাকায় বিদ্যুতের যাওয়া আসা বেশ কম, কোথাও কোথাও মানুষ অতিষ্ঠ। কোথাও দিনে এক ঘণ্টা আবার কোথাও ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা লোড শেডিংয়ের তথ্য মিলছে।
আবার অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্থাপনা আছে, যেখানে বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে হয়। এসব স্থাপনায় একাধিক লাইন থাকে, একটিতে বিদ্যুৎ না থাকলে আরেকটি চালু করা হয়। এগুলো বাদ দিয়ে যে ঘাটতি দেখা দেয়, তার বেশিরভাগই যায় পল্লী বিদ্যুতের ওপর দিয়ে।
সদ্য সমাপ্ত এপ্রিল মাস ধরে প্রায় বৃষ্টিহীনই গেছে। গত ১০ দিন ধরে দেশে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির কাছাকাছি অবস্থান করায় জারি করা হয় সতর্কতা। মঙ্গলবার যশোরে তাপমাত্রা উঠেছিল ৪৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
এই গরমের মধ্যে বিদ্যুৎ চলে গেলে জীবন হয়ে উঠছে দুর্বিষহ। সবচেয়ে বেশি ভুগতে হয় বয়স্ক ও শিশুদের।
সবচেয়ে বেশি তাপপ্রবণ জেলাগুলোর মধ্যে যশোর, চুয়াডাঙ্গা, জয়পুরহাট, নীলফামারী অঞ্চলে লোড শেডিং পরিস্থিতি গত বছরের তুলনায় উন্নতির কথা জানাচ্ছেন গ্রাহকরা। অন্যদিকে বৃহত্তর ময়মনসিংহ, নোয়াখালী ও কুমিল্লার কিছু অঞ্চলে অসহনীয় পরিস্থিতির কথা আসছে। এমনও হচ্ছে, একই জেলায় কোথাও তেমন সংকট নেই, কোথাও আবার বিদ্যুতের যাওয়া আসা স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
এর মধ্যে নেত্রকোণা পাচ্ছে চাহিদার অর্ধেকের কিছু বেশি বিদ্যুৎ। অন্যদিকে গত বছর পরিস্থিতি খারাপ থাকলেও উত্তরবঙ্গে এবার পরিস্থিতি সহনীয়।বিদ্যুৎ বিভাগের প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোনো কোনো পকেট এরিয়াতে সমস্যা হচ্ছে। সংকট হচ্ছে নেত্রকোণা বা অন্য কোনো অঞ্চলে। সেসব অঞ্চলে যেসব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ দিত, কোনো কারণে এলাকায় কেন্দ্রগুলো হয়ত পুরোপুরি কার্যকর করা যাচ্ছে না। সেটি জ্বালানির অভাবও হতে পারে, কেন্দ্র শাটডাউনের কারণেই হোক, বা অন্য কোনো কারণে হতে পারে।”
বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সঞ্চালনের ব্যবস্থাপনা হয় আলাদা অঞ্চল ধরে। এক অঞ্চলের বিদ্যুৎ দিয়ে অন্য অঞ্চলের সংকট সমাধান করা কঠিন। যেমন বরিশাল অঞ্চলে উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ চাইলেই ময়মনসিংহ অঞ্চলে নিয়ে এসে ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব না।
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক বলেন, “কিছু অঞ্চলে এবার ডিমান্ড এত বেশি বেড়ে গেছে, সেখানে সক্ষমতা নেই। যেমন নোয়াখালীতে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি চাহিদা। বর্তমান অবকাঠোমোতে সেটা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এমনও আছে, গ্রিডে বিদ্যুৎ আছে, কিন্তু এত বেশি চাহিদা লোড দেওয়ার সক্ষমতা নেই।”
রেকর্ড উৎপাদনেও থেকে যাচ্ছে ঘাটতি
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি), জাতীয় সঞ্চালন কর্তৃপক্ষ (পিজিসিবি)-এর বিভিন্ন পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তাপপ্রবাহ শুরু হওয়ার পর বিদ্যুতের চাহিদা ১৫ হাজার থেকে ১৭ হাজার মেগাওয়াটে ওঠানামা করছে। এর বিপরীতে উৎপাদন ১৩ হাজার মেগাওয়াট থেকে সাড়ে ১৬ হাজার মেগাওয়াটের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে।
গত সপ্তাহ জুড়ে প্রতি ঘণ্টায় লোড শেডিংয়ের পরিমাণ গড়ে ২ হাজার মেগাওয়াটের মধ্যে ছিল। মাঝে মধ্যে লোড শেডিং ৫০০ মেগাওয়াটের নিচে চলে আসার ঘটনাও রয়েছে। আবার গত সোমবার ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুতে বিভ্রাট দেখা দেওয়ায় কয়েক ঘণ্টার জন্য লোড শেডিং তিন হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
মঙ্গলবার রাত ৯টার সময় বিদ্যুতের উৎপাদন ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াটের নতুন মাইলফলক স্পর্শ করে। কিন্তু চাহিদা ১৭ হাজার মেগাওয়াট থাকায় তখনও ৫০০ মেগাওয়াটের লোড শেডিং চলছিল।দেশে ১৫০টি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা ২৬ হাজার মেগাওয়াটের কিছু বেশি হলেও আপাতত উৎপাদন আর বেশি বাড়ানো যাচ্ছে না।
বিদ্যুৎ খাত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়, তার ৭ শতাংশের মত গ্রাহক পর্যায়ে যায় না। কেন্দ্রগুলো নিজের জন্য লাগে, সঞ্চালনে কিছু ক্ষয় হয়, আবার সিস্টেম লসও আছে। এই হিসাবে সাড়ে ১৬ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন হলেও সরবরাহ আসলে সাড়ে সোয়া ১৫ হাজার মেগাওয়াটের কিছু বেশি।
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক বলেন, “উৎপাদন সক্ষমতা অনেক বেশি থাকলেও নানা সীমাবদ্ধতার কারণে চাহিদা পূরণ করা যাচ্ছে না। তবে পরিস্থিতি গত বছরের তুলনায় উন্নত হয়েছে।”
ঢাকার চিত্র কী
রাজধানীর ইস্কাটন এলাকায় এবার পরিস্থিতি বেশ সহনীয়। গত বছর এই সময়ে বিদ্যুৎ ঘাটতি বেশি থাকলেও এবার ভোগান্তি নেই।
গাউসনগর এলাকায় একটি বাসার কেয়ারটেকার শহীদুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগের বারের চেয়ে অনেক ভালো। গত বছর প্রায় প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে কয়েকবার লোড শেডিং থাকত, কিন্তু এবার গেলে কিছুক্ষণ পরেই চলে আসে। কয়েক দিন আগে একবার এক ঘণ্টা লোড শেডিং ছিল।”
উত্তরা সেক্টর ৫ এর ৮ নম্বর সড়কের বাসিন্দা শিফাতুল্লাহ শার্ফীর বিদ্যুৎ নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা নেই। তিনি বলেন, “খুব বেশি তো যায় না, কোনো দিন একবার, কোনো দিন একবারও যায় না। একবার গেলে আধা ঘণ্টা বা এক ঘণ্টার আগেই চলে আসে।”
পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজার এলাকার বাসিন্দা বোরহান উদ্দিন বলেন, “গত এক সপ্তাহেই দিনে এক থেকে দুই বার লোড শেডিং হয়েছে, সর্বোচ্চ ২০ মিনিট থাকে না। এর মধ্যে কেবল মঙ্গলবার চার বার গেছে, ১০ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে চলে আসে।”
মোহাম্মদপুরের শিয়া মসজিদ এলাকায় মোহাম্মদিয়া হাউজিং লিমিটেডের বাসিন্দা কাজী রফিকও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ে সন্তুষ্ট।
বিদ্যুৎ পরিস্থিতি কেমন- এই প্রশ্নে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভালোই তো। দিনে একবার বড়জোর একবার যায়।”গেলে কতক্ষণ পরে আসে?- জবাব এল, “কখনো এক ঘণ্টা, কখনো আধা ঘণ্টা।”
‘তাহলে তো ভালোই’- এমন মন্তব্যের পর তিনি বললেন, “না, আমার বাসার এলাকা দিয়ে আপনি পুরো মোহাম্মদপুরের কথা বিবেচনা করতে পারবেন না। মোহাম্মদপুরের বর্ধিত এলাকা নবীনগর, সাতমসজিদ হাউজিং, চাঁদ উদ্যান এসব এলাকাতেই আবার দুই থেকে ৩ ঘণ্টা লোড শেডিং থাকে। উর্দুভাষী ক্যাম্পে ৫ থেকে ছয় ঘণ্টা।”
সাভারের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে আমবাগান এলাকার বাসিন্দা শামসুজ্জামান শামস বলেন, “দিনের বেলায় চার থেকে ৫ বার যায়, রাতে দুই থেকে তিনবার যায়, কখনো আধা ঘণ্টা, কখনো এক ঘণ্টা থাকে না।
তবে ব্যাংক কলোনির কলেজ রোডের শাকিল হোসেন বলেন, “দিনের বেলায় পাঁচ থেকে ছয় বার যায়, প্রতিবার ঘণ্টাখানেক থাকে না, সন্ধ্যা পর থেকে ১২টা পর্যন্ত এক ঘণ্টা থাকে, এক ঘণ্টা থাকে না।”
একই চিত্র সারা দেশে। কোনো জেলা শহরে বিদ্যুতের যাওয়া আসা একেবারেই কম, কোথাও তা পরিস্থিতি অসহনীয়। আবার একই জেলায় কোনো অঞ্চলে স্বস্তিতে মানুষ, কোনো অঞ্চলে ত্যক্ত বিরক্ত।
‘ভালো নেই’ চট্টগ্রাম
রাজধানীর পরিস্থিতি খুব একটা খারাপ না হলেও দেশের দ্বিতীয় প্রধান শহর চট্টগ্রামে বিদ্যুতের যাওয়া আসা নিত্য ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
শহরের লাভ লেইন এলাকার বাসিন্দা মোহন চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুই সপ্তাহের বেশি ধরে দিনে দুই থেকে তিন বার বিদ্যুৎ চলে যায়। একবার গেলে ৩০ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা পরে আসে। রাতেও প্রায় এক ঘণ্টার মত বিদ্যুৎ থাকে না।”
তিনি জানান, নগরীর অন্য এলাকার পরিস্থিতি এর চেয়ে খারাপ। বেশিরভাগ এলাকায় দিনে চার থেকে পাঁচ বার এবং রাতেও এক থেকে দুইবার বিদ্যুৎহীন থাকে।
পল্লী বিদ্যুতের আওতাধীন বোয়ালখালী উপজেলার পরিস্থিতি আরো খারাপ বলে তথ্য মিলেছে পশ্চিম সারুয়াটুলী গ্রামের বাসিন্দা শুভ সেনের ভাষ্যে।
তিনি বলেন, “দিনরাত মিলিয়ে ছয় থেকে আট বারও বিদ্যুৎ যায়। এক বার গেলে দেড় ঘণ্টাতেও আসে না মাঝেমধ্য। সব মিলিয়ে ২৪ ঘণ্টায় দিনে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা থাকে না।” তবে মে দিবসের সরকারি ছুটির দিন নিস্তার পেয়েছেন চট্টগ্রামের মানুষ। যে কারণে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড চট্টগ্রামের প্রধান প্রকৌশলী রেজাউল করিম দাবি করছেন, তাদের লোড শেডিং নেই।
তিনি বলেন, “গড়ে ১৩০০ মেগাওয়াট চাহিদা থাকে, সেটা এখন পাওয়া যাচ্ছে।”
তাহলে বিদ্যুৎ কেন এতবার যায়- এই প্রশ্নে পাল্টে যায় তার বক্তব্য। তিনি বলেন, “যখনই পাওয়া যায় না, তখনই লোড শেডিং হয়। তখন সমন্বয় করতে হয়। সে কারণে মাঝেমধ্যে বিদ্যুৎ যায়।”
একই জেলায় বিপরীত চিত্র
সাজেদুর রহমান ভুঁইয়া প্রান্ত থাকেন কিশোরগঞ্জের নগুয়া এলাকায়। তিনি বলেন, “বিদ্যুৎ তো খুব ভালো। সন্ধ্যার পর এক আধবার যায়, কোনো দিন ঘণ্টাখানেক থাকে না, কোনো দিন আগেই চলে আসে।”
তবে তারই ভাই সাইদুর রহমান ভুঁইয়া দীপ্ত থাকেন নগুয়া থেকে কিলোমিটার ছয়েক দূরের রামপুর গ্রামে। সেখানে পল্লী বিদ্যুতের সংযোগ তাদের বাড়িতে। তিনি বলেন, “বিদ্যুৎ তো কমই থাকে। কখন আসে যায় গ্যরান্টি নাই। আজকে (বুধবার) দারুণ সার্ভিস। সকাল থেকে ছয়টা পর্যন্ত একবারও যায়নি। তবে অন্যদিন তিন থেকে চার বার যায়। রাতেও তিন থেকে চার বার যায়। কোনো সময় আধা ঘণ্টা, কোনো দিন এক ঘণ্টা, আবার দুই ঘণ্টা পরেও আসে।”
পল্লী বিদ্যুতের সংযোগ আছে কুমিল্লার সংবাদকর্মী মাহফুজ নাণ্টুর বাড়িতে। কিন্তু সেখানে পরিস্থিতি শহরের চেয়ে ভালো।
আদর্শ সদর উপজেলার শিমরা গ্রামে তার বাড়ি। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “গত কয়েক সপ্তাহ ধরে রাতে কেবল এক ঘণ্টার জন্য যায়, সেটা ১১টা থেকে ১২টা পর্যন্ত।”
আর শহরে? মাহফুজ বলেন, “শহরে ভেতরে ঠাকুরপাড়া, রেসকোর্স, মোঘলটুলি ও কান্দিরপাড়া এলাকায় বিদ্যুতের পরিস্থিতি রেশনিংয়ের মত। এক এলাকায় থাকলে আরেক এলাকায় থাকে না। দিনে কোনো দিন একবার, কোনো দিন দুইবার, কখনো আবার একবারও যায় না।”
কিন্তু এই জেলার ১৪ গ্রাম উপজেলাতেই আবার বিদ্যুতের যাওয়া আসায় মানুষের জীবন অতিষ্ঠ। কেন এমন- এই প্রশ্নে মাহফুজ বলেন, “সেখানে বিসিক শিল্প নগরী আছে, বিদ্যুতের চাহিদা বেশ,” এ কথা বলেন কর্মকর্তারা।
ময়মনসিংহ অঞ্চলে লোড শেডিং ‘লাগাম ছাড়া’
ময়মনসিংহ নগরীর সানকিপাড়া এলাকার বাসিন্দা নাজমুল ইসলাম খান বলেন, “দিনে দুইবার এবং রাতে দুই থেকে তিনবার লোড শেডিং হচ্ছে। ১০ মিনিট থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। সাধারণত আমাদের এলাকায় লোড শেডিং হত না। এর মধ্যে গত এক সপ্তাহ ধরে এমন অবস্থায় নিজেকে মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে।“
শহরের পাশেই গৌরীপুর উপজেলার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম মীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঈদের পর থেকেই তীব্র দাবদাহের মধ্যে দিনে ১০ থেকে ১২ বার লোড শেডিং হচ্ছে। দুই দিন ধরে রাতের তুলনায় দিনে বেশি লোড শেডিং হচ্ছে।”
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ময়মনসিংহ দক্ষিণের নির্বাহী প্রকৌশলী সুব্রত রায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তীব্র দাবদাহের কারণে হঠাৎ চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় লোড শেডিং একটু বেশি হচ্ছে।”
বৃহত্তর ময়মনসিংহের টাঙ্গাইল, জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোণা ও কিশোরগঞ্জে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় ময়মনসিংহ বিদ্যুৎ গ্রিড থেকে। ৬ জেলায় প্রতিদিন বিদ্যুতের মোট চাহিদা ১৩৫০ মেগাওয়াট থেকে ১৩৮০ মেগাওয়াট। এই চাহিদার বিপরীতে দিনে ২০০ থেকে ২২০ মেগাওয়াট ঘাটতি থাকছে।তবে এই ঘাটতি সবার ওপর সমভাবে বণ্টন করা হয় না। শহর অঞ্চলে হাসপাতাল, সেনানিবাসসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। ময়মনসিংহ শহর ও ও অন্যান্য জেলা শহরে লোড শেডিং কম দেওয়া হচ্ছে।
নেত্রকোণায় পরিস্থিতি আরো খারাপ। সেখানে পল্লী বিদ্যুতে চাহিদার অর্ধেক আর পিডিবি পাচ্ছে চাহিদার দুই তৃতীয়াংশ। এই জেলায় সরবরাহ কেন এত কম, সেই প্রশ্নের জবাব মেলেনি।
জেলা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সহকারী প্রকৌশলী বরুণ ব্যানার্জি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নেত্রকোণা শহরে ২২ থেকে ২৪ মেগাওয়াট চাহিদার রয়েছে। কিন্তু সরবরাহ ১৪ থেকে ১৫ মেগাওয়াট। অর্থাৎ এক তৃতীয়াংশ ঘাটতি হচ্ছে। গরমে চাহিদা বাড়ায় শহরে থাকা নয়টি ফিডারেই লোড শেডিং দিতে হচ্ছে।”
মোক্তারপাড়ার বাসিন্দা সুস্থির সরকার বলেন, “গত প্রায় ২০ দিন ধরে দিনে রাতে মিলিয়ে গড়ে ৮ থেকে ৯ বার বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। প্রতিবারে অন্তত এক ঘণ্টা লোড শেডিং থাকে। এই গরমে অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছি। রাতে ঘুমানো যায় না; অসুস্থ হয়ে পড়ছি আমরা।”
কলমাকান্দা উপজেলার কনুড়া গ্রামের সন্তোষ বিশ্বশর্মা বলেন, “বিদ্যুৎ কতবার যায় সেটা বলার চেয়ে কতক্ষণ থাকে সেই উত্তর আরও সহজ হবে। দিনে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাই।”
কেন্দুয়া উপজেলার সাগুলি গ্রামের নজরুল ইসলাম বলেন, “আমাদের এখানেও বড়জোর দিনে সর্বোচ্চ ১১ থেকে ১২ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে।”
নেত্রকোণা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জিএম মাসুম আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পিক আওয়ারে জেলায় পল্লী বিদ্যুতের চাহিদা ১২০ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে পাওয়া যায় ৬০ থেকে ৬৫ মেগাওয়াট। এতে করে লোড শেডিং দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।”
পরিস্থিতি খারাপ আরও যেখানে
কুমিল্লায় শহরের পরিস্থিতি খুব একটা খারাপ না, কিন্তু চৌদ্দগ্রাম ও মনোহরগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দারা গত মাস খানেক ধরেই বাজে পরিস্থিতির কথা জানাচ্ছেন সামাজিক মাধ্যমে।
কাশিনগর ইউনিয়নের যাত্রাপুর গ্রামের বাসিন্দা আবুল বাশার রানা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সারাদিনই বলতে গেলে দুই এক ঘণ্টা পরপরই লোড শেডিং হয়। সন্ধ্যার পর থেকে সমস্যা আরও তীব্র হয়। দেখা গেল বিদ্যুৎ আসল ৯টা থেকে সাড়ে ৯টার দিকে, এরপর সাড়ে ১০ টার দিকে গেলে আবার আসে রাত একটা থেকে দেড়টার দিকে। মানুষ একটু ঘুমালে গভীর রাতে আবার চলে যায়। এই গরমের মধ্যে শিশুদের অবস্থা খুবই খারাপ। গত এক মাস ধরে একই অবস্থা।”
মনোহরগঞ্জ উপজেলার বাইশগাঁও ইউনিয়নের মান্দারগাঁও গ্রামের ফরহাদ আল মাহমুদ বলেন, “বিদ্যুৎ সারাদিনই আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকে। সন্ধ্যার পর থেকে আর বিদ্যুতের দেখা পাওয়া যায় না। রাত ১০টার পর একবার এলেও একটু পরেই চলে চায়। গভীর রাতে আবার এলে বেশিক্ষণ থাকে না। কারেন্ট মনে হয় যেন মিসড কল মারে।”শহরের বাসিন্দা মাহাবুব আলম বলেন, “আমাদের এলাকায় আগে লোড শেডিং কম হত। এখন দিনে এবং রাতে লোড শেডিং হচ্ছে।”
নোয়খালীর মাইজদী শহরের বাসিন্দা এআর আজাদ সোহেল জানান, গত এক সপ্তাহ ধরে বিদ্যুৎ সরবরাহের অবস্থা বেশি খারাপ। বিদ্যুতের অফিসে ফোন দিলে বলে ‘বিদ্যুতের ঘাটতি আছে, লাইনে সমস্যা, মেশিনে সমস্যা’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
চৌমুহনীর ব্যবসায়ী নাজিম উদ্দিন মিলন বলেন, “রাতের পরিস্থিতি ভালো থাকলেও দিনের বেলায় লোড শেডিং হয় বেশি। সন্ধ্যার পর রাতে এক ঘণ্টা করে দুইবার লোড শেডিং হয়। দিনের বেলায় কারেন্ট আসা যাওয়ার মধ্যে থাকে।”
নোয়াখালী ইউনিয়নের বাসিন্দা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “রাতে এক ঘণ্টার জন্য এলে দুই ঘণ্টার জন্য চলে যায়। গত এক সপ্তাহ ধরে এই পরিস্থিতি। আগে পরিস্থিতি আরও ভালো ছিল।”
পিরোজপুর শহরের ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন বলেন, “গত দুই দিন (রবি ও সোম) ধরে প্রতি এক ঘণ্টা পরপরই ঘণ্টাব্যাপী লোড শেডিং হচ্ছে। এতে করে সাধারণ মানুষ দুর্ভোগে পড়েছে। বয়স্ক ও শিশুদের অবস্থা চরম খারাপ।”
ইন্দুরকানীর বাসিন্দা নিলয় হৃদয় বলেন, “উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি এখন মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ দিয়ে থাকে।”
খুলনা বিভাগ ও উত্তরবঙ্গ স্বস্তিতে
এই দুই অঞ্চলে গরম এবার দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় একটু বেশিই। তবে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি মানুষকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দিচ্ছে, যদিও সেচ মৌসুমে বিদ্যুৎ ঘাটতি থাকবে বলে আগেভাগে সতর্ক করা হয়েছিল।
জয়পুরহাটের পাকুরতলী এলাকার শাহিনুর রহমান ও বানিয়াপাড়া এলাকার উজ্জ্বল হোসেনসহ পল্লী বিদ্যুতের বেশ কয়েকজন গ্রাহক জানান, গত বছরগুলোর তুলনায় লোড শেডিং তুলনামূলক কম। এ কারণে বোরো ধানের ক্ষেতে সেচ দেওয়ায় তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। দিনে গড়ে দুই থেকে সর্বোচ্চ তিন ঘণ্টা লোড শেডিং হয়।
শহরের আরাম নগর এলাকার ওমর ফারুক রবিন ও শান্তিনগর এলাকার রাশেদুজ্জামানসহ কয়েকজন জানান, গত একমাস ধরে নেসকোর বিদ্যুৎ ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ এক থেকে সোয়া ঘণ্টা লোড শেডিং হয়। এমনও হয়, বিদ্যুৎ গেছে ৫ থেকে ১০ মিনিটে আবার ফিরে আসে।
লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা উপজেলার মিজানুর রহমান দুলাল বলেন, “অন্য বছরগুলোতে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা লোড শেডিং থাকলেও এবার দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা।”
আদিতমারী উপজেলার ব্যবসায়ী সাদেকুল ইসলাম বলেন, “লোড শেডিং অনেকটাই কম। দিনে থেকে দেড় ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। অবশ্য গ্রামে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না।“
খুলনা অঞ্চলের চুয়াডাঙ্গায় এবার বারবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হচ্ছে। সেখানে বিদ্যুতের যাওয়া আসার সমস্যা না থাকায় গ্রাহকরা বেশ খুশি।
চুয়াডাঙ্গা জেলায় পৌর এলাকায় বিতরণ সংস্থা ওজোপাডিকো এবং গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে পল্লী বিদ্যুতের সংযোগ।
শহরের কোর্টপাড়ার বাসিন্দা গৃহবধূ মমতাজ আরা বলেন, “গত তিনদিনে সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল ৩০ থেকে ৪০ মিনিটের মতো। মঙ্গলবার দুপুরে ২০ মিনিট বিদ্যুৎ সরবরাহ ছিল না। আগের দিন সোমবার ১৫ মিনিট মতো বিদ্যুৎ বন্ধ ছিল।”
দামুড়হুদা উপজেলায় পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহক মোহাম্মদ সোহাগ বলেন, “দিনে দুতিন বার লোড শেডিং হয়। কখনো আধা ঘণ্টা, কখনো এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। গত তিনদিনে এ রকম হয়েছে বেশ কয়েকবার। বাকি সময়ে ভালোই ছিল।”
ফুরফুরে সিলেট অঞ্চল
সিলেটে এবার তাপপ্রবাহও নেই, বিদ্যুতের সমস্যাও সেভাবে নেই। অথচ গত দুই বছরে গ্রীষ্মে পরিস্থিতি নিয়ে ক্ষোভ ছিল গ্রাহকদের।
মৌলভীবাজার জেলার বাসিন্দা পারুমা বৈদ্য বলেন, “গত ১০ দিন ধরে দিনে সর্বোচ্চ এক ঘণ্টার লোড শেডিং হয়। দুই দিনে ঘুর্ণিঝড়ের কারণে লাইন ছিড়ে বিদ্যুৎ চলে গেছে। এর বাইরে পরিস্থিতি ভালোই ছিল।”
হবিগঞ্জ, সিলেটেও বিদ্যুৎ নিয়ে তেমন কোনো অভিযোগ নেই।
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন নোয়াখালী প্রতিনিধি আবু নাছের মঞ্জু, কুমিল্লা প্রতিনিধি আবদুর রহমান, চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি মানিক আকবর, ময়মনসিংহ প্রতিনিধি ইলিয়াস আহমেদ, নেত্রকোণা প্রতিনিধি লাভলু পাল চৌধুরী, জয়পুরহাট প্রতিনিধি মোমেন মুনি, লালমনিরহাট প্রতিনিধি ফরহাদ আলম সুমন, পিরোজপুর প্রতিনিধি মো. হাসিবুল ইসলাম হাসান ও মৌলভীবাজার প্রতিনিধি বিকুল চক্রবর্তী]