বন্যার এক মাস: দেশে ৩১% এলাকা প্লাবিত

কুড়িগ্রামের উলিপুর তিন দফা বন্যার মুখোমুখি হল এক মাসেই। উপজেলার নিম্নাঞ্চলে তিন সপ্তাহ ধরে অনেক পরিবারের রান্নাবান্না হচ্ছে চৌকির উপরে; কারও বা দিন কাটছে ঘরে চালে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 July 2020, 06:47 PM
Updated : 26 July 2020, 01:07 PM

উলিপুর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান রিপা সরদার বললেন, এবারের বন্যার ধরন তার কাছে একটু ‘অন্য রকম’ বলে মনে হচ্ছে।

শনিবার টেলিফোনে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “একটু ভালো হতে না হতেই আমরা আবার বন্যার মধ্যে পড়েছি। তিনবার খেয়ে গেল। আর কত দিন থাকবে বুঝতে পারছি না। এলাকার লোকজন পড়েছে ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে। গবাদি পশু থেকে মানুষ- সবাই অসহায় অবস্থায় আছি।”

শুধু কুড়িগ্রাম নয়, দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর পূর্বাঞ্চল, মধ্যাঞ্চল মিলিয়ে অন্তত ১৮ জেলার বিস্তীর্ণ নিম্নাঞ্চল টানা তিন সপ্তাহ ধরে বানের জলে ভাসছে।  

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, চলমান বন্যায় দেশের অন্তত ৩১ শতাংশ নিম্নাঞ্চল ইতোমধ্যে প্লাবিত হয়েছে। শনিবার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে, তাতে আগামী কয়েক দিনে প্লাবিত এলাকা আরও বাড়বে।

আরও সাত থেকে দশ দিন পর পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, “বন্যা এবার দীর্ঘায়িত হল। কোথাও দ্বিতীয় দফা চলছে, কোথাও তৃতীয় দফা বন্যা শুরু হল। অধিকাংশ নিম্নাঞ্চল থেকে পানি নেমে যাওয়ার সময়ই পেল না। অন্তত তিন সপ্তাহের বেশি টানা দুর্ভোগের মধ্যে রয়েছে বানভাসিরা।”

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, এক মাসের মধ্যে তিন দফায় দেশের ৩১টি জেলা বন্যা কবলিত হয়েছে; ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ।  

বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তিন বছর আগেও বন্যায় দেশের ৪২ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। সে হিসেবে এবারের বন্যার ব্যাপ্তি ততটা মারাত্মক হয়নি।

“কিন্তু স্থায়িত্ব বেড়ে যাওয়ায় মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। এত দীর্ঘ সময় বন্যা থাকলে বাঁধ টেকে না, নদীর পার ভাঙে বেশি; রোগের প্রাদুর্ভাবও বাড়ে।”

তিনি জানান, গেল বছর ১২ জুলাই বন্যা শুরু হয়েছিল। এবার শুরু হয় ২৬ জুনের দিকে। গতবার দুই-তিন দফা বন্যা হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এমনিতে প্রতিবার বন্যা ১০ থেকে ১৪ দিনের মত স্থায়ী হয়, পরে পানি নেমে যায়। কিন্তু এবার দুই ঢলের মাঝে সময়ের ব্যবধান কম হওয়ায় ইতোমধ্যে টানা বন্যার তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে।

“এতো আগে শুরু হয়ে টানা এত দিন থাকায় বিষয়টি একটু ‘ডিফরেন্ট’… এবারের গতি-প্রকৃতি দেখে মনে হচ্ছে বন্যা একটু আগেই শুরু হয়েছে।”

মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, ১৯৮৮ বা ১৯৯৮ সালের বন্যার মত অবস্থা এখনও হয়নি, তেমন আশঙ্কাও করছি না এবার।”

১৯৮৮ সালের বন্যায় দেশের ৬১ শতাংশ এলাকা দুই মাস ধরে, ১৯৯৮ সালের বন্যায় ৬৮ শতাংশ এলাকা এক মাস ধরে প্লাবিত ছিল বলে প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান জানান।

অগাস্টের প্রথম সপ্তাহে উন্নতির আভাস

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, আগামী তিন-চার দিন ভারতের আসাম, মেঘালয় ও পশ্চিমবঙ্গে ভারি বর্ষণ হতে পারে। এ সময় বহ্মপুত্র-যমুনার পানি স্থিতিশীল থাকবে।

তবে আগামী ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিম্নাঞ্চলের পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে।

অন্যদিকে মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, চাঁদপুর, রাজবাড়ি, শরীয়তপুর, ঢাকা, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নাটোর, বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও নওগাঁ জেলার নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে।

দেশের নদ-নদীগুলোতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১০১টি পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে ৪৩টি পয়েন্ট শনিবার পানি বেড়েছে; কমেছে ৫৮টি পয়েন্টে। ১৭টি নদীর ২৭টি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার উপরে বয়ে যাচ্ছে।

কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জমান ভূইয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চলমান বন্যা পরিস্থিতি জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। অগাস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে ক্রমান্বয়ে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।”

ঢাকার আশপাশের ডেমরা ও নারায়ণগঞ্জ পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার উপরে বয়ে চলায় নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি এক সপ্তাহ দীর্ঘায়িত হতে পারে বলে জানান তিনি।

সাপে কাটা রোধে সুপারিশ

বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের জ্যেষ্ঠ গবেষক মোহন কুমার দাশ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, উত্তরবঙ্গের অনেক জেলা বরাবরই বন্যাপ্রবণ। সেখানে চরাঞ্চলে বন্যার সময় নানা রোগের পাশাপাশি সাপের দংশনেও অনেকের মৃত্যু হয়।

“নদীর স্রোতে ভেসে যাওয়া (বিশেষ করে মহিলা ও শিশু), নৌ দুর্ঘটনা, সাপের ছোবলে মৃত্যু প্রতিবারের মত এবারের বন্যায়ও হচ্ছে।  উত্তরণের ব্যবস্থা হিসেবে জনসচেতনতা, উন্নতমানের নৌ ব্যবস্থাপনা, কার্বলিক এসিড, এন্টিভেনম সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকা দরকার।”

বন্যা ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনায় বিভিন্ন অধিদপ্তরের মধ্যে আরও বেশি সমন্বয়ের প্রয়োজন বলে মনে করেন এ গবেষক।