পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর মূলে রয়েছে সচেতনতার অভাব; অথচ সরকারি-বেসরকারি সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ না থাকায় কুড়িগ্রামে থামানো যাচ্ছে না এ নীরব মহামারী।
Published : 22 Jul 2020, 03:04 PM
জনসংখ্যার অনুপাতে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি শিশু পানিতে ডুবে মারা যায় বাংলাদেশে। আর উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর মধ্যে কুড়িগ্রামকে এ দিক দিয়ে ‘সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপ্রবণ’ হিসেবে চিহ্নিত করছেন জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা-ইউনিসেফের কর্মকর্তারা।
এ জেলায় গত পাঁচ বছরে শুধু বন্যার পানিতে ডুবে ৭৯ জনের মৃত্যু হয়েছে; যার মধ্যে ৫৭ জনই ছিল শিশু। চলতি বন্যায় পানিতে ডুবে এরই মধ্যে ১৪টি শিশুসহ ১৯ জনের মৃত্যু খবর এসেছে।
পানিতে ডুবে মৃত্যু দেশে শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ হলেও এর প্রতিকারে সরকারি-বেসরকারি কোনো সুনির্দিষ্ট কার্যকর কর্মসূচির কথা বলতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা।
“বন্যার মধ্যে মানুষ তার পশু-পাখিসহ সব সম্পদ রক্ষা করতে পারলেও সবচেয়ে বড় সম্পদ প্রিয় সন্তানকে আগলে রাখতে পারছে না।”
পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু ঠেকাতে আলাদা করে কোনো কর্মসূচি না থাকার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, জেলায় দুস্থ মহিলা উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় অন্য অনেক বিষয়ের মত পানিতে ডুবে মৃত্যুর বিষয়েও নারী ও কিশোরীদের সচেতন করা হয়। তবে করোনাভাইরাস সংকট শুরুর পর তাও বন্ধ রয়েছে।
কুড়িগ্রাম জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা এমএ বকর বলেন, তাদের কর্মকাণ্ড মূলত শহর কেন্দ্রিক শিক্ষা, সাংস্কৃতিক, প্রশিক্ষণ ও বিভিন্ন দিবস কেন্দ্রিক প্রতিযোগিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ।
“মাঠ পর্যায়ে শিশু সুরক্ষার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি কিংবা অন্য কোনো কাজ নেই। আর এখন মহামারীর মধ্যে তো প্রায় সব ধরনের কাজই বন্ধ।”
আর দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর মধ্যে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার কুড়িগ্রামে সবচেয়ে বেশি জানিয়ে ইউনিসেফের রংপুর অফিসের চাইল্ড প্রটেকশন অফিসার জেসমিন হোসাইন বলেন, “আমরা আমাদের শিশুদের বাঁচার সুযোগ করে দিতে পারছি না।”
পানিতে ডুবে মারা যাওয়া কমানো না গেলে দেশে শিশু মৃত্যুর হারও কমানো যাবে না মন্তব্য করে জেসমিন বলেন, বন্যা ছাড়াও দুই ঈদ উৎসবের সময় শিশুরা পানিতে ডুবে বেশি মারা যায় বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।
“মূলত শিশুরা পানি দেখে আবেগতাড়িত হয়ে যায়। পানিতে নামার তীব্র আগ্রহ সৃষ্টি হয়। তারা ঝুঁকির কথা না ভেবেই আর একেবারে অবুঝ শিশুরা তো না বুঝেই পানির দিকে ছুটে যায়। এটা ন্যাচারাল। আমরা রিসার্চ করছি, রিভিউ করছি।”
এ বিষয়ে কুড়িগ্রামে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে ইউনিসেফ কিছু কাজ করছে জানিয়ে জেসমিন বলেন, “গতবছর সাঁতার শেখার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এটি সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এ বছর কাজের অগ্রগতি হয়নি।”
সংসারের নানা কাজ সামলে সদ্য কৈশোরে পা রাখা দুই ছেলেকে ঘরে রাখা তার জন্য কঠিন হয়ে যায়।
“আমরা নিজেদের মত করে চেষ্টা করি, যাতে বাচ্চাদের নিরাপদ রাখা যায়। ছেলেদের পানি থেকে দূরে থাকতে বলি।”
তিনি বলেন, “অভিভাবকরা সব সময় অত খেয়াল করেন না, বন্যার এই দুর্যোগে অনেকেই এ দিকে মনোযোগ দেন না। ফলে দুর্ঘটনা ঘটছে। সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে মানুষকে সচেতন করার জন্য উদ্যোগ থাকা দরকার।”
কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলায় ব্রহ্মপুত্রের চর সাহেবের আলগা ইউনিয়নের জাহাজের আলগা গ্রামের পল্লী চিকিৎসক আক্তারুজ্জামান (৫০) জানান, তাদের এলাকাতেও পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু হয় প্রতিবছর। কিন্তু এ বিষয়ে কেউ কখনও সচেতন করতে আসেনি।
একই কথা বলেন ওই গ্রামের কৃষক হবি মোল্লা। আঞ্চলিক ভাষায় তিনি বলেন, “আইজ পর্যন্ত এমন আও-বাও শোনং নাই বাহে।”
“শিশু মানব সম্পদ রক্ষায় জিও কিংবা এনজিও কারোই সুনির্দিষ্ট প্রকল্প, বাজেট কিংবা পরিকল্পনা নেই। সবার দৃষ্টি রিলিফ, ভাঙন প্রতিরোধ, উদ্ধার ও পরিবারের অন্যান্য সম্পদ রক্ষায়। মৃত্যুর মিছিল দেখে এখন ফিল করছি কিছু একটা করতে হবে।”
পরিবারের সবার সচেতনা ও বাড়িতে শিশুদের নিরাপত্তা জোরদার করলে অনাকাঙ্ক্ষিত এ মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব মনে করেন তিনি।
আরেক বেসরকারি সংস্থা সলিডারিটি’র নির্বাহী পরিচালক এসএম হারুন অর রশিদ লাল বলেন, “প্রাকৃতিক দুর্যোগ কবলিত শিশুদের রক্ষায় সত্যিকার অর্থে কোনো কাজ নেই।”
এবারের বন্যায় এ পর্যন্ত পানিতে ডুবে মারা যাওয়া শিশুদের বেশিরভাগের বয়স পাঁচ বছরের নিচে জানিয়ে তিনি বলেন, “তাদের সাঁতার শেখার বয়সও হয়নি। কাজেই অভিভাবকদের সচেতনতা দরকার সবার আগে।”
কুড়িগ্রামে নতুন যোগ দেওয়া এই ডিসি বলেন, পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো প্রতিষ্ঠানের কোনো কাজ নেই।
“আমরা সরকারের সব দপ্তর এবং জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে ব্যাপকভাবে সচেতনতামূলক কর্মসূচি হাতে নেব; যাতে আগামীতে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস পায়।”
কুড়িগ্রাম ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের বন্যায় এ জেলায় ২১ জনের মৃত্যু হয়; এর মধ্যে ১৬ জন ছিল শিশু। ২০১৮ সালে পানিতে ডুবে কোনো মৃত্যুর খবর পাওয়া না গেলেও ২০১৭ সালে ৩০ জনের মৃত্যু হয়, যাদের ২০ জনই ছিল শিশু।
এর আগে ২০১৬ সালে ছয়টি শিশুসহ ৮ জন এবং ২০১৫ সালে একটি শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের দেওয়া তথ্যই জেলা প্রশাসনের এই দপ্তর প্রকাশ করে থাকে। সরকারি এ তথ্যে, বন্যায় শিশুর জীবনের ঝুঁকির বিষয়টি স্পষ্ট।
চলতি বন্যায় মৃত্যুর তথ্য দিয়ে কুড়িগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ের কন্ট্রোল রুম জানিয়েছে, গত ২০ জুন থেকে ১৯ জুলাই পর্যন্ত কুড়িগ্রামে বন্যার পানিতে ডুবে মারা গেছে ১৪টি শিশুসহ ১৯ জন। ওই ১৪ শিশুর মধ্যে ছয়টি মেয়ে ও আটটি ছেলে।
১৯ জুলাই উলিপুরে গুনাইগাছ ইউনিয়নে গুনাইগাছ পূর্বপাড়া গ্রামে লাদেন (৭) খেলতে গিয়ে সবার অগোচরে বাড়ির পাশের পুকুরে পড়ে ডুবে যায়।
চলতি বন্যায় কুড়িগ্রামে প্রথম পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটে গত ২০ জুন। সেদিন নাগেশ্বরী উপজেলার মোল্লাপাড়া গ্রামে আরাফাত আলী (৭) বাড়ির পাশের ডোবায় ডুবে মারা যায়। সেও খেলতে গিয়েছিল।
এছাড়া বাড়ির পাশে খেলতে গিয়ে সবার অগোচরে বন্যার পানিতে ডুবে মারা যায় কুড়িগ্রাম সদরের মোগলবাসা ইউনিয়নের কথা রায় (২), চিলমারী উপজেলার থানাহাট ইউনিয়নের বজরা তবকপুর গ্রামের সুচরিতা (২) এবং নাগেশ্বরী উপজেলার বল্লবেরখাস ইউনিয়নের ব্রক্ষতর গ্রামের লামিয়া খাতুন (২)।
পরিবারের লোকজনের অগোচরে বাড়ির উঠানের পানিতে পড়ে মারা যায় উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের চিড়া খাওয়া গ্রামের মুন্নি (১৮ মাস), নাগেশ্বরী উপজেলার নারায়নপুর ইউনিয়নের চৌদ্দঘুরি গ্রামের মাহিন (১৭ মাস), উলিপুর উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের জানজাইগীর গ্রামের মুক্তাসিন (১৪ মাস)।
বন্যার পানিতে গোসল করতে গিয়ে ডুবে মারা যায় নাগেশ্বরী উপজেলার নারায়নপুরের মোল্লাপাড়া গ্রামের আমির আলী মোল্লার ছেলে বেলাল হোসেন (৫)। আর শখের বশে মাছ ধরতে গিয়ে মারা যায় চিলমারী উপজেলার সবুজপাড়া গ্রামের রাকু (১৫)।
তিনি জানান, স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে সব চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মাঠ পর্যায়ের সব কর্মী যাতে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার পাশাপাশি শিশুদের সতর্ক রাখতে অভিভাবকদের সতর্ক করেন, সে পরামর্শও দেওয়া হচ্ছে।
“তবে শুধু স্বাস্থ্য বিভাগ প্রচার চালালে চলবে না। জেলা প্রশাসন, পুলিশ বিভাগ, জনপ্রতিনিধিসহ সব পক্ষকে সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে সচেতনতার কাজটি করতে হবে।”
সবাই সমন্বিতভাবে কাজ করলে ‘ভালো ফল’ পাওয়া যেতে পারে বলে আশা এই স্বাস্থ্য কর্মকর্তার।