ঢাবি ছাত্রী ধর্ষণ: মজনুর যাবজ্জীবন

চলতি বছরের শুরুতে রাজধানীর কুর্মিটোলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ মামলায় একমাত্র আসামি মজনুকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।

আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Nov 2020, 09:19 AM
Updated : 19 Nov 2020, 04:27 PM

ঢাকার সপ্তম নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোছা. কামরুন্নাহার বৃহস্পতিবার দুপুরে আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।

ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হওয়ার আগে এই মামলার অভিযোগ গঠন হওয়ায় আগের আইনের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডই দেওয়া হয়েছে আসামি মজনুকে।

সেই সঙ্গে বিচারক তাকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন, যা না দিতে পারলে তাকে আরও ছয় মাস জেল খাটতে হবে।

ধর্ষণের পর ওই শিক্ষার্থীর মোবাইল নিয়ে গিয়ে এক নারীর কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন মজনু, যা পরে র‌্যাব উদ্ধার করে। সে কারণে মামলায় ধর্ষণের পাশাপাশি ছিনতাইয়ের অভিযোগে দণ্ডবিধির ৩৯৪ ও ৪১১ ধারায় মজনুর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছিল।

তবে আদালত ছিনতাইয়ের অভিযোগ থেকে আসামিকে খালাস দিয়ে বলেছে, মজনু ওই মোবাইল ছিনতাই করে নিয়েছিলেন কি না, তা প্রমাণিত হয়নি।

রায়ের জন্য এদিন দুপুরে আদালতে হাজির করার পর মজনু ব্যাপক চিৎকার-চেঁচামেচি ও পুলিশ সদস্যদের গালাগাল শুরু করলে বিচারক সাংবাদিক ও উৎসুক আইনজীবীদের বাইরে যেতে বলে শুধু জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের এজলাসে থাকার অনুমতি দেন এবং পরে রুদ্ধদ্বার কক্ষে রায় ঘোষণা করা হয়।

আসামির পক্ষে কোনো আইনজীবী না থাকায় ঢাকা জেলা লিগ্যাল এইডের রবিউল ইসলাম রবিকে এ মামলায় মজনুর পক্ষে মামলা পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।

রায়ের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আদালত বলেছে, রাষ্ট্রপক্ষ যেভাবে সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করেছে, তাতে অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে।

“আর আসামি পক্ষের আইনজীবী হিসেবে আমি বলব, আসামি ন্যয়বিচার পাননি, তিনি উচ্চ আদালতে যেতে পারেন।”

রায়ের আগে মজনুর আচরণ নিয়ে প্রশ্ন করলে এই আইনজীবী বলেন, “সে নেচারালি এরকম। আজ অনেক লোক যখন প্রশ্ন করেছে, সে ধর্ষণ করেছে কি না সেই সুযোগ সে উল্টো পাল্টা আচরণ করেছে অস্বাভাবিক আচরণ করেছে।”

অন্যদিকে এই রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি আফরোজা ফারহানা আহম্মেদ অরেঞ্জ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মজনুর ১৬৪ ধারার জবানবন্দি, ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন, মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে গ্রেপ্তার, ধর্ষণের শিকার শিক্ষার্থীর শনাক্তকরণ ও সাক্ষীদের সাক্ষ্যের মাধ্যমে আমরা আদালতকে সন্তুষ্ট করতে পেরেছি। তাই আদালত সন্তুষ্ট হয়ে আসামিকে এই আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন। আমরা রাষ্ট্রপক্ষ এই রায়ে সন্তুষ্ট।”

তিনি বলেন, ওই শিক্ষার্থীকে ২০টি ছবি দেখানো হয়, তার মধ্যে মজুনর ছবিও ছিল। তিনি মজনুকেই ধর্ষক হেসেবে শনাক্ত করেছিলেন।

ধর্ষণের ঘটনার পর ক্যাম্পাসে বা বাড়িতে না ফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষার্থী আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে ছিলেন।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের অ্যডভোকেট আবদুর রশিদ বলেন, “এরকম রায়ই আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম। যেহেতু, আগের আইনে অভিযোগ গঠন হয়েছে, ফলে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার সুযোগ ছিল না।

“আমরা ওই শিক্ষার্থীর পরিবারকে রায়ের কথা জানিয়েছি। তারা এই রায়ে সন্তুষ্ট।”

ধর্ষকের ফাঁসির দাবিতে মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মানববন্ধন করে ছাত্রলীগ। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

কী ঘটেছিল

এ বছরের ৫ জানুয়ারি সন্ধ্যার পর ঢাকার কুর্মিটোলায় নির্জন সড়কের পাশে ধর্ষণের শিকার হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষার্থী। পরদিন তার বাবা ক্যান্টনমেন্ট থানায় মামলা করেন।

তিন দিন বাদে মজনুকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব জানায়, নোয়াখালীর হাতিয়া থেকে ১০ বছর আগে ঢাকায় আসা এই ব্যক্তিই ধর্ষণকারী।

তদন্ত শেষে দুই মাস পর গত ১৬ মার্চ ডি‌বির প‌রিদর্শক আবু বকর সিদ্দিক আদালতে অভিযোগপত্র দা‌খিল ক‌রেন। তাতে শুধু মজনুকেই আসামি করা হয়। ভুক্তভোগীর পোশাক ও মোবাইল ফোনসহ ২০টি আলামত তিনি জমা দেন আদালতে।

গত ২৬ আগস্ট ভার্চুয়ালি শুনানিতে মজনুর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে আদালত। রাষ্ট্রপক্ষে মোট ২৪ সাক্ষীর মধ্যে ২০ জন সাক্ষ্য দেন। আসামিপক্ষে কেউ সাফাই সাক্ষ্য দেননি।

গ্রেপ্তারের পর রিমান্ড শেষে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলেও আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনের সময় নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন মজনু।

তিনি বলেছিলেন, “আমার মা ছাড়া পৃথিবীতে কেউ নেই। আমাকে মায়ের কাছে যাইতে দেন। আমি এই কাম করি নাই। আমারে ছাইড়া দ্যান।”

তবে ধর্ষণের শিকার ওই তরুণী রুদ্ধদ্বার আদালত কক্ষে দাঁড়িয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো মজনুকে ধর্ষণকারী হিসেবে শনাক্ত করেছিলেন। তিনি র‌্যাবকেও বলেছিলেন, তার উপর নিপীড়নকারীর চেহারা জীবনেও ভুলতে পারবেন না তিনি।

দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে গত ১২ নভেম্বর বিচারক এ মামলার রায়ের জন্য ১৯ নভেম্বর দিন রাখেন।

ঘটনার আট মাসের মধ্যে মামলা আদালতে ওঠার পর ১৩ কার্যদিবসে বিচার শেষে মজনুকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দিল আদালত। 

রাজধানীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ মামলায় রায়ের আগে একমাত্র আসামি মজনুকে বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকার সপ্তম নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে আদালতে আনা হয়। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

আদালতে যা করলেন মজনু

আসামি মজনুকে বেলা ২টার দিকে কাশিমপুর কারাগার থেকে আদালতে নিয়ে আসার পর উপস্থিত সবাইকে তিনি ‘ছেড়ে দেওয়ার’ আর্জি জানাতে থাকেন।

তাকে বলতে শোনা যায়, “ভাই আমাকে ছেড়ে দেন। আমি এতিম, অসহায়। আমারে মারলে আল্লাহ অনেক শাস্তি দিবে। আমাকে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। আমি নির্দোষ।”

বেলা আড়াইটার দিকে মজনুকে এজলাসে নেওয়া হলে কড়া পুলিশ বেষ্টনীর মধ্যে কাঠগড়ায় থেকেই তিনি হইচই শুরু করেন।

চিৎকার করে তিনি বলতে থাকেন, “আমি বাড়ি যামু গা, আমি আর থাকব না। আমি রিকশা চালাই, ভ্যান চালাই। আমি দুর্বল মানুষ। আমারে বিনা দোষে ধরে এনেছে। আল্লাহ বিচার করব রে। আমার নাম মজনু। আমি পাগল মজনু। আইজকা ছাইড়া দ্যান। আমারে এক বছর বিনাদোষে আটকে রেখেছে।”

এক পর্যায়ে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে হাজত পুলিশের এক সদস্যের ঘাড় চেপে ধরেন আসামি মজনু। এরপর কাঁদতে কাঁদতে কোর্ট হাজতের ওসির কাছে অভিযোগ জানাতে থাকেন এবং পুলিশ সদস্যদের গালাগাল শুরু করেন।

“আমার চোখের পানি শুকায়ে গেছে। আমি ধর্ষণকারী না। আমারে তাড়াতাড়ি ছাইড়া দেন। না হলে অবস্থা খারাপ হবে। হাতের হ্যান্ডকাফ একবার খুলে দে। কত পুলিশ আছে দেখে নেব।”'

রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি আফরোজা ফারহানা আহম্মেদ অরেঞ্জ তখন বলেন, “ক্যামেরা দেখে আসামি সিন ক্রিয়েট করছে।”

মজনু বলতে থাকেন, কাশিমপুর কারাগারে অনেক মশা। আদালতে আনার জন্য তাকে কিছু খেতেও দেওয়া হয়নি।

“আমারে অনেক অত্যাচার করেছে। আমার পক্ষে কেউ নাই। আমারে ছাইড়া দেন। আমি ব্রিজ থেকে লাফ দেব।”

মজনুর চিৎকার চেঁচামেচিতে বাধ্য হয়ে এক পর্যায়ে বিচারক সাংবাদিক ও উৎসুক আইনজীবীদের বাইরে বারান্দায় যেতে বলেন।

আইন সাংবাদিকদের মধ্যে কেবল জ্যেষ্ঠ একজনকে এজলাসে থাকার অনুমতি দেওয়া হলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আদালত প্রতিবেদক রায় ঘোষণার সময় উপস্থিত থাকার সুযোগ পান।

রায়ের পর মজনুকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে পুলিশ বেষ্টনীর কোর্ট হাজতে নিয়ে যাওয়া হয়।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণ মামলার একমাত্র আসামি মজনু। ফাইল ছবি

কে এই মজনু?

মজনুকে গ্রেপ্তারের পর র‌্যাবের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছিল, তার বয়স আনুমানিক ৩০ বছর, বাড়ি নোয়াখালীর হাতিয়ায়। জীবিকার তাগিদে বছর দশেক আগে তিনি ঢাকা আসেন।

মজনুর বাবা মাহফুজুর রহমান মারা গেছেন আগেই। মা জীবিত থাকলেও বাড়ির সঙ্গে মজনুর কোনো যোগাযাগ নেই বলেও র‌্যাব জানায়।

নিরক্ষর মজনু ১২ বছর আগে ট্রেনে যাওয়ার সময় পড়ে গিয়ে দাঁত ভেঙে ফেলেন। এই ভাঙা দাঁতের বিষয়টি তদন্তের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে বলে সে সময় জানান র‌্যাবের কর্মকর্তা সারোয়ার বিন কাশেম।

তিনি বলেন, “সে (মজনু) এক সময় বিবাহিত ছিল। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে।”

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মজনু বলেছিলেন, তিনি পেশায় দিনমজুর, হকার। পাশাপাশি তিনি ‘ছিনতাই, রাহাজানি, চুরির মত কাজেও’ জড়িত ছিলেন বলে র‌্যাবের ভাষ্য।

“সে আমাদের কাছে প্রাথমিক স্বীকারোক্তি দিয়েছে, সে সিরিয়াল রেপিস্ট। সে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রতিবন্ধী, ভিক্ষুক মহিলাকেও নানাভাবে ধর্ষণ করেছে। সে মাদকাসক্ত।”

র‌্যাব কর্মকর্তা কাশেম সে সময় বলেছিলেন, “তার স্ত্রী যখন মারা যায়, তারপর আসলে তার যা অবস্থা, সে আর কাউকে বিয়ে করতে পারেনি। তখন যেটা সে করত, বিভিন্ন ভিক্ষুক, তাদের সে ধর্ষণ করত। এবং প্রতিবন্ধী নারী, তাদের সে বিভিন্ন জায়গা থেকে ধরে এনে রাখত এবং এই কাজগুলো করত।”

কুর্মিটোলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে ধর্ষণে গ্রেপ্তার মজনুকে বৃহস্পতিবার আদালতে হাজির করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে সাত দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে আদালত।

যেভাবে গ্রেপ্তার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষার্থীর কাছ থেকে অপরাধীর দেহের বর্ণনা শুনে মজনুকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সে সময় জানায়।

ওই তরুণী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস থেকে কুর্মিটোলা বাসস্ট্যান্ডে নেমে বান্ধবীর বাসায় যাচ্ছিলেন। ফুটপাত দিয়ে হাঁটার সময় ধর্ষণকারী তাকে জাপটে ধরে একটি ঝোঁপের আড়ালে নিয়ে ধর্ষণ করে।

র‌্যাব কর্মকর্তা সারোয়ার বিন কাশেম সে সময় বলেছিলেন, সেই রাতে মেয়েটির ফেলে যাওয়া মোবাইল ফোন, ব্যাগ এবং পাওয়ার ব্যাংক নিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন মজনু। কুর্মিটোলায় এক নারীর কাছে ফোনটি বিক্রি করে দেন ৫০০ টাকায়। সেখান থেকে মজনু চলে যান নরসিংদীতে। পরদিন ফিরে আসেন ঢাকায়।

ভিকটিমের মোবাইল ফোনের সূত্র ধরে র‌্যাব খায়রুল নামে এক রিকশাচালককে আটক করেন। খায়রুল ওই মোবাইল কিনেছিলেন সেই নারীর কাছ থেকে।

“তার দেওয়া তথ্যের সঙ্গে ভিকটিমের তথ্য মিলিয়ে আমরা সিদ্ধান্তে আসি যে তারা (মোবাইল বিক্রেতা ও ধর্ষক) একই ব্যক্তি। কারণ তার বাড়ি নোয়াখালী, স্থানীয় ভাষায় সে কথা বলে, তার সামনে দাঁত নেই। চুল কোঁকড়া এবং সে খর্বকায়। এই তথ্যগুলো মিলিয়ে আমরা তাকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হই।”

পরে ওই তরুণীকে মজনুর ছবি দেখালে তিনিও তাকে শনাক্ত করেন বলে সে সময় জানান র‌্যাব কর্মকর্তা সারোয়ার।