শ্রমিকদের ‘শতভাগ’ পাওনা বুঝিয়ে দিয়ে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত সব পাটকলের উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে সরকার।
Published : 02 Jul 2020, 06:02 PM
বৃহস্পতিবার বিকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এক ব্রিফিংয়ে মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস সরকারের এই সিদ্ধান্তের কথা সাংবাদিকদের জানান।
তার আগে সকালে গণভবনে মুখ্য সচিব, অর্থ সচিব, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিবের সঙ্গে বৈঠক করেন সরকারপ্রধান।
মুখ্য সচিব বলেন, “আজ যখন প্রধানমন্ত্রী এই সিদ্ধান্ত দিলেন, তিনি খুব আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন।”
ধারাবাহিকভাবে লোকসানে থাকা দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ২৬টি পাটকলের ২৪ হাজার ৮৮৬ জন স্থায়ী কর্মচারীর চাকরি গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে অবসায়নের সিদ্ধান্ত গত রোববার এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী।
বস্ত্র ও পাট সচিব লোকমান হোসেন মিয়া সেদিন বলেন, শ্রমিকদের অবসায়নের পর আগামী ছয় মাসের মধ্যে পিপিপির (সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব) আওতায় আধুনিকায়ন করে এসব পাটকলকে উৎপাদনমুখী করা হবে। তখন এসব শ্রমিক সেখানে চাকরি করার সুযোগ পাবেন।
২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত যে ৮ হাজার ৯৫৪ জন পাটকল শ্রমিক অবসরে গেছেন, তাদের সব পাওনাও একসঙ্গে বুঝিয়ে দেওয়া হবে বলে সেদিন জানিয়েছিলেন পাটমন্ত্রী।
তবে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন এর বিরোধিতায় মিছিল-সমাবেশের মত কর্মসূচি চালিয়ে আসছে গত কয়েক দিন ধরে।
বিশ্বে পাট ও পাটজাত পণ্যের চাহিদা যেখানে বাড়ছে, সেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর আধুনিকায়ন হলে শ্রমিক ছাঁটাই নয়, বরং নতুন শ্রমিকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে বলে যুক্তি দিয়ে আসছেন প্রতিবাদকারীরা।
এ পর্যন্ত এই পাটকলগুলোর পুঞ্জিভূত ক্ষতির পরিমাণ ১০ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা জানিয়ে আহমদ কায়কাউস বৃহস্পতিবার বলেন, “এখানে কাউকে চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে না। শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করে তাদের অবসরে পাঠানো হচ্ছে।”
২০১৫ সালের সর্বশেষ মজুরি কাঠামো অনুযায়ী প্রায় ২৫ হাজার পাটকল শ্রমিক অবসরকালীন সুবিধাসহ প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা পাবেন জানিয়ে আহমদ কায়কাউস বলেন, সেজন্য আগামী তিন দিনের মধ্যে শ্রমিকদের তালিকা তৈরি করতে প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছেন।
মুখ্য সচিব জানান, পাটকলগুলোর শ্রমিক-কর্মচারীদের পাওয়া বুঝিয়ে দিতে সরকার কয়েকটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
দুই লাখ টাকার কম যাদের পাওনা হবে, তাদের পুরো টাকা তাৎক্ষণিকভাবে নগদ দেওয়া হবে।
দুই লাখের বেশি পাওনা হলে ৫০ শতাংশ টাকা তাৎক্ষণিকভাবে নগদ দেওয়া হবে। বাকি ৫০ শতাংশ টাকা তাদের দেওয়া হবে তিন মাস মেয়াদী সঞ্চয়পত্রের আকারে।
“তার মানে হচ্ছে, এই সঞ্চয়পত্র থেকে তিনি ইন্টারেস্ট পাবেন। আমরা একটা হিসেব করে দেখেছি, যদি গড়ে ১১ শতাংশ হারে মুনাফা দেওয়া হয়, তাহলে তিন মাসে গড়ে ১৯ হাজার ৩২০ টাকা থেকে ৭৪ হাজার ৫২০ টাকা পর্যন্ত মুনাফা পেতে পারেন তারা,” বলেন আহমদ কায়কাউস।
তিনি বলেন, “প্রকৃত অর্থে একজন শ্রমিক যা এখন নগদে পেত তার চেয়ে বেশি পাবে যদি আমি মাসিক মুনাফাটা হিসাব করি। নিম্নআয়ের শ্রমিক ভাই বোনদের জীবনের নিশ্চয়তার জন্যই প্রধানমন্ত্রী এটি করেছেন।”
মুখ্য সচিব বলেন, তাদের হিসাব অনুযায়ী, চাকরির অবসায়নের মাধ্যমে পাটকল শ্রমিকরা গড়ে ১৩.৮৬ লাখ টাকা পাবেন। কারও কারও ক্ষেত্রে তা ৫৪ লাখ টাকাও হবে।
‘নিরুপায়’ সিদ্ধান্ত
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকার দেশের সব পাটকল জাতীয়করণ করে। ১৯৭২ সালে ৭৮টি পাটকল নিয়ে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) যাত্রা শুরু হয়।
পরে ৩৫টি মিল সাবেক মালিকদের কাছে দিয়ে দেওয়া হয়। বিজেএমসির হাতে এখন আছে ২৬টি মিল, যার মধ্যে মনোয়ার জুট মিল ছাড়া সবগুলোতেই উৎপাদন চলছে।
এসব কারখানায় ২৪ হাজার ৮৬৬ জন স্থায়ী শ্রমিকের বাইরে তালিকাভুক্ত ও দৈনিক মজুরিভিত্তিক শ্রমিক আছে প্রায় ২৬ হাজার।
বেসরকারি খাতের পাটকলগুলো লাভ দেখাতে পারলেও বিজেএমসির আওতাধীন মিলগুলো বছরের পর বছর লোকসান করে যাচ্ছে, যার পেছনে অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
আহমদ কায়কাউস বলেন, এই ২৬টি মিল গত ৪৮ বছরের মধ্যে কেবল ৪ বছর কিছুটা লাভ দেখাতে পেরেছিল। বাকি ৪৪ বছরই বিজেএমসি অব্যাহতভাবে লোকসান দিয়ে গেছে।
“বিশ্বব্যাপী পাটের চাহিদা বাড়ছে। আপনারা সকলেই জানেন, পাটের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নজর রয়েছে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে উনি পাটের জিনরহস্য উদ্ঘাটনের জন্য গবেষণায় অর্থায়ন করেছিলেন। পাটের যে বহুমুখী ব্যবহার, সেটার ব্যাপারে উনি নজর দিয়েছেন।
“কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের রাষ্ট্রায়ত্ত্ব যে প্রতিষ্ঠানটি রয়েছে, বিজেএমসি, সেটি প্রাইভেট সেক্টরের সঙ্গে পারছে না।”
এর ফলে পাটকলগুলোর ২৫ হাজার শ্রমিককে ভুগতে হচ্ছিল মন্তব্য করে মুখ্য সচিব বলেন, “যেহেতু লোকসান হচ্ছে, সেহেতু বিভিন্ন সময়ে সরকারি অর্থ দিয়ে এগুলো চালাতে হচ্ছিল। তারা যথাসময়ে টাকা পাচ্ছিলেন না, বেতনও পাচ্ছিলেন না।
“মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রায় তিন দিন সময় নিয়েছেন এটার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে। কারন, উনি কোনো মিল বন্ধ করার পক্ষে না।”
গণভবনে সকালের বৈঠকের প্রসঙ্গ তুলে ধরে মুখ্য সচিব বলেন, “এই সিদ্ধান্ত আজকে চূড়ান্তভাবে জানানোর জন্য তার কাছ থেকে আমরা সম্মতি পেয়েছি। এই সম্মতি দেওয়ার আগেও উনি বেশ আবেগআপ্লুত হয়ে গিয়েছিলেন। কারণ উনি কাউকে ছাঁটাই করতে চান না।”