বুড়িগঙ্গায় লঞ্চ ডুবে ৩২ প্রাণের অবসান

ঢাকার শ্যামবাজারের কাছে বুড়িগঙ্গা নদীতে এক লঞ্চের ধাক্কায় আরেকটি ছোট লঞ্চ ডুবে অন্তত ৩২ জনের মৃত্যু হয়েছে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 June 2020, 05:08 AM
Updated : 29 June 2020, 06:36 PM

এমএল মর্নিং বার্ড নামের ওই লঞ্চটি মুন্সিগঞ্জের কাঠপট্টি থেকে যাত্রী নিয়ে সদরঘাটের দিকে আসছিল। সোমবার সকাল সোয়া ৯টার দিকে শ্যামবাজারের কাছে নদীতে ময়ূর-২ লঞ্চের ধাক্কায় সেটি ডুবে যায়।

ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তা রোজিনা ইসলাম জানান, দুর্ঘটনার পর তাদের ডুবুরি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করে। পাশাপাশি নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড, নৌ পুলিশ ও বিআইডব্লিউটিএর কর্মীরাও সেখানে উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়।

উদ্ধারকর্মীরা ঘটনাস্থল থেকে ৩০টি মৃতদেহ উদ্ধার করেন। এছাড়া স্থানীয়রা আরও দুজনকে উদ্ধার করে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন বলে ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন সরদার জানান।

বিআইডব্লিউটিএ এর পরিবহন পরিদর্শক মো. সেলিম জানান, মুন্সীগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা মর্নিং বার্ডে অর্ধশতাধিক যাত্রী ছিল বলে তারা তথ্য পেয়েছেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন সাঁতরে তীরে উঠতে পারলেও অনেকেই ভেতরে আটকা পড়েন।

ঢাকার শ্যামবাজারের কাছে বুড়িগঙ্গা নদীতে ডুবে যাওয়া লঞ্চ থেকে উদ্ধার মৃতদেহের সারি। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

লঞ্চডুবির প্রায় ১৩ ঘণ্টা পর রাত সোয়া ১০টার দিকে একজনকে জীবিত উদ্ধারের কথা জানায় ফায়ার সার্ভিস। তবে ঠিক কতজন নিখোঁজ রয়েছেন, তা এখনও স্পষ্ট নয়।

ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসাইন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার কাছাকাছি এলাকায় নদীর মাঝখানে ডুবে যাওয়া লঞ্চটি উল্টে রয়েছে।

কথা ছিল তল্লাশি শেষ হলে বিআইডব্লিউটিএর উদ্ধারকারী নৌযান ডুবে যাওয়া লঞ্চটি টেনে তুলে সরিয়ে নেবে। কিন্তু বুড়িগঙ্গা ব্রিজের নিচ দিয়ে উদ্ধারকারী জাহাজ প্রত্যয় আসতে না পারায় তা সম্ভব হয়নি।

ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তা কামরুল হাসান রাত ১০টার দিকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তাদের এবং বিআইডব্লিউটিএর এর ডুবুরি দল ঘটনাস্থলে তল্লাশি চালিয়ে যাচ্ছে। সেই সেঙ্গ অন্য নৌযানের সাহায্যে লঞ্চটি টেনে তোলারও চেষ্টা করা হচ্ছে।

যেভাবে দুর্ঘটনা

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, চাঁদপুর থেকে আসা ময়ূর-২ ভোর সাড়ে ৪টার দিকে লালকুঠী ঘাটে যাত্রী নামিয়ে অন্য ঘাটে গিয়ে বার্থিং করে। পরে আবার যাত্রী তোলার জন্য ব্যাক গিয়ারে চাঁদপুর ঘাটে আসছিল। ওই সময় পেছনে নদীতে থাকা মর্নিং বার্ডের সঙ্গে ধাক্কা লাগে।

সকালে ঘটনাস্থলে উপস্থিত বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক সাংবাদিকদের বলেছিরেন, দুই লঞ্চের কর্মীদের ‘অসতর্কতায়’ এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে তারা মনে করছেন।

তবে সদরঘাটের একটি সিসি ক্যামেরার ভিডিও পরে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে পেছন দিকে চলতে থাকা ময়ূর-২ এর ধাক্কায় তুলনামূলকভাবে আকারে অনেক ছোট মর্নিং বার্ডকে মুহূর্তের মধ্যে বুড়িগঙ্গায় ডুবে যেতে দেখা যায়।

দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করার পর ওই ভিডিও দেখার কথা জানিয়ে নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ঘটনার যে ধরন, তাতে তার মনে হয়েছে ধাক্কা দেওয়ার বিষয়টি ‘পরিকল্পিত’।

এ দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখতে সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন) মো. রফিকুল ইসলাম খানকে আহ্বায়ক এবং বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক (নৌ নিরাপত্তা) মো. রফিকুল ইসলামকে সদস্য সচিব করে গঠিত এই কমিটিকে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতাল মর্গের সামনে বুড়িগঙ্গা নদীতে সোমবারের লঞ্চ দুর্ঘটনায় নিহতদের স্বজনদের আহাজারি। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

আহাজারি নদী তীরে, মর্গে

এদিকে দুর্ঘটনার পর হাজার হাজার মানুষ ঘাটে এসে ভিড় করেন। মর্নিং বার্ডের নিখোঁজ যাত্রীদের খোঁজে ঘাটে আসা স্বাজনদের বিলাপ করতে দেখ যায়।

ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা যেসব লাশ উদ্ধার করেছেন, তাদের মধ্যে যমুনা ব্যাংকের ইসলামপুর শাখার কর্মচারী সুমন তালুকদারকে শনাক্ত করেন তার বড় ভাই নয়ন তালুকদার।

তিনি জানান, তাদের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের মিরকাদিমে। প্রতিদিন বাড়ি থেকে এসে পুরান ঢাকার ইসলামপুরে অফিস করতেন সুমন।

সকাল সাড়ে ৭টার দিকে লঞ্চে উঠে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন এক সন্তানের বাবা সুমন। পরে দুর্ঘটনার খবর পেয়ে এবং তার ফোন বন্ধ পেয়ে সদরঘাটে ছুটে আসেন তার ভাই। 

মুন্সিগঞ্জের ফল বিক্রেতা আবু সাইদ (৩৯) সোমবার সকালে ওই লঞ্চে করে ঢাকায় আসছিলেন ফল কিনতে। দুর্ঘটনার কথা শুনে মর্গে ছুটে যান তার স্ত্রী নুরজাহান বেগম। মৃতদেহের স্তুপ থেকে খুঁজে বের করা হয় তার স্বামীকে।

এসময় বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন নুরজাহান। তিনি আর তার ছেলে সাজিম বিকালে আবু সাইদের মৃতদেহ নিয়ে রওয়ানা হন মুন্সিগঞ্জের মিরকাদিমের গোপপাড়া গ্রামে তাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে।

পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতাল মর্গের সামনে বুড়িগঙ্গা নদীতে সোমবারের লঞ্চ দুর্ঘটনায় নিহত এক স্বজনদের আহাজারি। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

মুন্সিগঞ্জের রামপালের কাজী কসবা এলাকার আবু তাহের (৫০) যমুনা ব্যাংকের মতিঝিল শাখায় চাকরি করতেন। তিনিও প্রতিদিন গ্রাম থেকে ঢাকা এসে অফিস করতেন বলে জানান তার ভগ্নিপতি মতি হাওলাদার।

মর্গে তাহেরের লাশ শনাক্ত করার পর বিমর্ষ মতি বলেন, “ছোট পদে চাকরি করত, তিনটা মেয়ে মাদ্রাসায় পড়ে… কীভাবে যে সংসারটা চলবে…।”

বিউটি বেগম (৩৮) তার স্বামী লিটন খানের চোখের অপারেশন করানোর জন্য ঢাকায় আসছিলেন মর্নিং বার্ডে করে।

বিউটির দেবর রনি খান বলেন, “ভাই কোনো রকমে বেঁচে গেছে। কিন্তু ভাবি পারেনি।”

দুই বছর বয়সী তালহা আর তার খালু আলম ব্যাপারির মৃতদেহ উদ্ধার হলেও তালহার মা মারুফার মৃতদেহ পাওয়া যায়নি বলে জানান তাদের আত্মীয় সুমন।

নিখোঁজ রয়েছেন ৫০ বছর বয়সী আব্দুর রহমানও। তবে তার স্ত্রী হাসিনা রহমান ও ছেলে সিফাতের (৮) লাশ উদ্ধার হয়েছে। মর্গ থেকে তাদের দুজনের লাশ বুঝে নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন স্বজনরা।

ঢাকার শ্যামবাজারের কাছে বুড়িগঙ্গা নদীতে ডুবে যাওয়া লঞ্চে সোমবার দুপুরে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিদের পাশাপাশি নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ড সদস্যদের উদ্ধার অভিযান। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

প্রাণ গেল যাদের

দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা ওসি মোহাম্মদ শাহজামান জানান, যে ৩২ জনের লাশ মর্গে এসেছে, তাদের সবাইকে শনাক্ত করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তাদের সবার বাড়ি মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায়।

এরা হলেন- শাহাদাত হোসেন (৪৪), আবু তাহের বেপারী (৫৮), সুমন তালুকদার (৩৫), ময়না বেগম (৩৫), তার মেয়ে মুক্তা আক্তার (১৩), আফজাল শেখ (৪৮), মনিরুজ্জামান মনির (৪২), গোলাপ হোসেন (৫০), সুবর্ণা বেগম (৩৮), তার ছেলে তামিম (১০), আবু সাঈদ (৩৯), সুফিয়া বেগম (৫০), শহিদুল ইসলাম (৬১), মিজানুর রহমান কনক (৩২), সত্য রঞ্জন বনিক (৬৫), শামীম বৈপারী (৪৪), বিউটি আক্তার (৩৮), আয়শা বেগম (৩৫), মো. মিল্লাত (৩৫), মো. আমির হোসেন (৫৫), সুমনা আক্তার (৩২), পাপ্পু (৩২), মো. মহিম (১৭), দিদার হোসেন (৪৫), হাফেজা খাতুন (৩৮), হাসিনা রহমান (৩৫), সিফাত (৮), আলম বেপারী, তার ভাগ্নে তালহা (২), ইসমাইল শরীফ (৩৫), সাইফুল ইসলাম (৪২) ও বাসুদেব নাথ (৪৫)।

ঢাকার শ্যামবাজারের কাছে বুড়িগঙ্গা নদীতে ডুবে যাওয়া লঞ্চে সোমবার দুপুরে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিদের পাশাপাশি নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ড সদস্যদের উদ্ধার অভিযান। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

নৌ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী জানিয়েছেন, লঞ্চডুবিতে মারা যাওয়া প্রত্যেকের পরিবারকে দেড় লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।

পাশপাশি লাশ দাফনের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রত্যেক পরিবারকে তাৎক্ষণিকভাবে ১০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে বলে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ হোসেন জানান।

বিআইডিব্লিউটিএ’র পক্ষ থেকেও নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ১০ হাজার টাকা করে সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সোমবার ১৭ জনের পরিবারকে সেই টাকা দেওয়াও হয়েছে। পরে বাকিদেরও দেওয়া হবে বলে বিআইডব্লিউটিএ এর পরিবহন পরিদর্শক হুমায়ূন কবির জানিয়েছেন।

দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ওসি শাহ জামান বলেন, সোমবার রাত ১০টা কোনো মামলা এ ঘটনায় দায়ের হয়নি।

তবে ময়ূর-২ লঞ্চটি ঘটনার পরপরই জব্দ করা হয়েছে জানিয়ে নৌ পুলিশের প্রধান ডিআইজি আতিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “লঞ্চের মাস্টারসহ অন্যরা পালিয়ে গেছে। আমরা লঞ্চে থাকা দুইজন স্টাফকে গ্রেপ্তার করেছি। জব্দ করা লঞ্চটি এখন লালকুঠি ঘাটে আছে।”

আরও পড়ুন