মহামারীকালে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে রায়হীন বছর

করোনাভাইরাসের মহামারীর বছরে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের কোনো মামলার রায় দিতে পারেনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

তাবারুল হক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Dec 2020, 04:49 PM
Updated : 1 Nov 2021, 12:50 PM

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ২০১০ সালের ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর ২০১৩ সাল থেকে রায় দেওয়া শুরু হয়। এরপর গত সাত বছরের প্রতিটিতে কোনো না কোনো মামলার রায় হয়। মোট ৪১টি রায়ে ৯৫ জনকে দণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল।

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ২০১৩ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সময়ে ট্রাইব্যুনালে গড়ে প্রতি বছর ছয়টি রায় এসেছে। এরপর এবারই কোনো রায় দেওয়া সম্ভব হয়নি।

তিনি বলেন, “করোনাভাইরাসের কারণে মামলার স্বাভাবিক কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটেছে। ট্রাইব্যুনালের বেশ কয়েকজন প্রসিকিউটর ও তাদের পরিবারের সদস্য কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছিলেন। ট্রাইব্যুনালের বহু কর্মীও আক্রান্ত হয়েছিলেন।”

করোনাভাইরাস মহামারীর কারণেই এবছর ট্রাইব্যুনালের বিচার কাজে অগ্রগতি হয়নি, বলছেন জ্যেষ্ঠ প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্তও।

২০২০ সালের শুরুতে গত ২৬ জানুয়ারি ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের খলিলুর রহমানসহ ১১ আসামির বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রম শেষে যে কোনো দিন রায় ঘোষণার জন্য (সিভিএ) রেখেছিল ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু বছর শেষ হয়ে গেলেও এই রায়ও হয়নি।

মহামারীর শুরুর আগেই ট্রাইব্যুনালের এক বিচারক অসুস্থতাজনিত কারণে ছুটিতে আছেন।

খলিলুরের মামলার রায় দেওয়ার ক্ষেত্রে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালের এক সদস্য ছুটিতে থাকাও আরেকটি কারণ বলে মনে করেন আইনজীবীরা।

রানা দাশগুপ্ত বলেন, তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে কোনো এক সদস্য অনুপস্থিত থাকলে এই ক্ষেত্রে চারটি বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার নেই।

“মামলার অভিযোগ আনুষ্ঠানিক আমলে নেওয়া, মামলার অভিযোগ গঠন, যুক্তিতর্ক এবং রায় ঘোষণার ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনালের ফুল বেঞ্চ ছাড়া এখতিয়ার নেই। তবে অন্যান্য কাজ যেমন- সাক্ষ্যগ্রহণের ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনালের এক সদস্য বা দুই সদস্য পারেন।”

জেয়াদ আল মালুম বলেন, “সংক্রমণের ঝুঁকির কারণে কারণে বহু মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। দেশের দূর-দূরান্ত থেকে সাক্ষীদের হাজির করা সম্ভব হয়নি।”

রানা দাশগুপ্ত বলেন, মহামারী পরিস্থিতির কারণে ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার যেমন থমকে আছে, পাশাপাশি একই কারণে যেসব মামলার রায় হয়ে আপিল পর্যায়ে রয়েছে, সেগুলোও থমকে রয়েছে।

“নতুন বছরে ট্রাইব্যুনালের বিচার কাজ চালিয়ে নিতে পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমাদের চেষ্টা থাকবে, যেন গুরুত্বপূর্ণ এসব মামলার বিচার দ্রুত সম্পন্ন করা সম্ভব হয়।”

চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলাগুলোর বিচার চলছে। ট্রাইব্যুনালের অন্য ‍দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি আমির হোসেন ও বিচারপতি মো. আবু আহমেদ জমাদার।

গত ২২ মার্চ থেকে বিচারপতি আমির হোসেন অসুস্থতাজনিত কারণে ছুটিতে আছেন। চেয়ারম্যান ও অন্য সদস্য ট্রাইব্যুনালের বিচারিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখছেন।

২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সরকার। এরপর ২০১২ সালের ২২ মার্চ ট্রাইব্যুনাল-১ ও ট্রাইব্যুনাল-২ নামে দুটি ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলে। ২০১৫ সালে ট্রাইব্যুনাল-২ নিষ্ক্রিয় করে ট্রাইব্যুনাল-১ বিচার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

সাত বছরের ৪১ রায়

২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি ফরিদপুরের বোয়ালমারীর আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে প্রথম মৃত্যুদণ্ড দিয়ে ট্রাইব্যুনালের রায় দেওয়া শুরু হয়।

এরপর একই বছরের ৪ ও ২৮ ফেব্রুয়ারি, ৯ মে, ১৫ জুলাই, ১৭ জুলাই, ১ অক্টোবর, ৯ অক্টোবর ও ৩ নভেম্বর পর্যন্ত এক বছরে নয়টি মামলার রায় দেয় ট্রাইব্যুনাল।

২০১৪ সালে ২৯ অক্টোবর জামায়াতে ইসলামীর প্রধান মতিউর রহমান নিজামীকে মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। এরপর একই বছরের ২, ১৩, ২৪ নভেম্বর, ২৩ ও ৩১ ডিসেম্বর মোট ছয়টি মামলার রায় দেওয়া হয়।

পরের বছর ২০১৫ সালে ১৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াত নেতা আব্দুস সোবহানকে মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। এরপর একই বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০ মে, ৯ জুন, ১৬ জুলাই, ১১ অগাস্ট পর্যন্ত ওই বছর আরও ছয়টি মামলার রায় এসেছে।

২০১৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি নেত্রকোনার দুই রাজাকারের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে ওই বছরের রায় দেওয়া শুরু হয়। পরে একই বছরের ৩ মে, ১ জুন, ১৮ জুলাই, ১০ অগাস্ট ও ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ওই বছরে আরও ছয়টি মামলার রায় দেয় ট্রাইব্যুনাল।

এর পরের বছর ২০১৭ সালের ১৯ এপ্রিল কিশোরগঞ্জের নিকলী থানার দুই রাজাকারকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে ওই বছরের প্রথম রায় ঘোষণা করে ট্রাইব্যুনাল। এরপর একই বছরের ২২ নভেম্বর বছরের দ্বিতীয় রায়টি হয়।

২০১৮ সালের ১০ জানুয়ারি মৌলভীবাজারের রাজনগরের পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে দণ্ড ঘোষণা করে ট্রাইব্যুনাল। এরপর ১৩ মার্চ, ১০ মে, ১৭ জুলাই, ১৩ অগাস্ট, ৫ নভেম্বর পর্যন্ত ছয় মামলার রায় আসে।

পরের বছর ২০১৯ সালে ছয়টি মামলার রায় দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। ওই বছরের ২৮ মার্চ, ২৪ এপ্রিল, ২৭ জুন, ২৭ অগাস্ট, ১৫ অক্টোবর, ১১ ডিসেম্বর সর্বশেষ রায় হয়।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, ফাইল ছবি

বিচারাধীন ৩৬টি মামলা

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৩৬টি মামলা বিচারাধীন পর্যায়ে রয়েছে। এসব মামলার বেশ কিছু বিচারের গুরুত্বপূর্ণ স্তরে আটকে রয়েছে বলে প্রসিকিউটররা জানিয়েছেন।

সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে কক্সবাজারের মহেশখালীর সালামত উল্লাহ খানসহ ২১ আসামির বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা।

এছাড়া ময়মনসিংহের এম এ হান্নানসহ আট আসামি, একই জেলার মো. রেজাউল করিম ওরফে এ এস এম রেজাউল হক ওরফে আক্কাস মৌলভীসহ আট আসামির মামলাটিও সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে আছে।

অন্যদিকে গত ২৬ জানুয়ারি থেকে যে কোনো দিন রায়ের জন্য অপেক্ষায় আছে ময়মনসিংহের পাগলা, ভালুকা ও গফরগাঁওয়ের ১১ আসামির বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মামলাটি।

নড়াইলের আবদুল ওয়াহাবসহ ১২ আসামির বিরুদ্ধে মামলা, বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ ও কচুয়ার খান আশরাফ আলীসহ ১৪ আসামির মামলা, শেরপুরের নকলার এস এম আমিনুজ্জামান ফারুকসহ চার আসামি বিরুদ্ধে করা মামলা সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে।

এছাড়া কুমিল্লার দাউদকান্দির মোহাম্মদ শহিদুল্লাহর বিরুদ্ধে মামলা, নেত্রকোনার মো. খলিলুর রহমানসহ পাঁচ আসামির মামলা, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার আব্দুস সালামসহ নয় আসামির বিরুদ্ধে মামলা, মৌলভীবাজারের বড়লেখার আব্দুল আজিজ ওরফে হাবুলসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে মামলা, যশোরের মনিরামপুরের সিদ্দিকুর রহমান গাজীসহ চার আসামির বিরুদ্ধে মামলা, ময়মনসিংহের ত্রিশালের আনিসুর রহমান মানিকসহ নয় আসামির বিরুদ্ধে মামলা, নওগাঁর বদলগাছির রেজাউল করিম মন্টুসহ চার আসামির বিরুদ্ধে মামলা, খুলনার আমজাদ হোসেন হাওলাদারসহ আট আসামির বিরুদ্ধে মামলার বিচার চলছে ট্রাইব্যুনালে।

অন্যদিকে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ এলাকার আবুল খায়ের গোলাপ ওরফে গোলাপ মিয়াসহ দুই আসামির মামলা, খুলনার ডুমুরিয়ার শেখ আব্দুর রহিমসহ ১১ আসামির মামলা, যশোরের আজমত হোসাইন মোল্লাসহ পাঁচ আসামির মামলা, বগুড়ার বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল মোমিন তালুকদারের বিরুদ্ধে মামলা, সাতক্ষীরার জামায়াতের সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল খালেক মন্ডলসহ চার আসামির বিরুদ্ধে মামলার বিচারও চলছে।

এছাড়া হবিগঞ্জের লাখাইয়ের সাফিউদ্দিন মাওলানার বিরুদ্ধে মামলা, মাদারীপুরের মোহাম্মদ ওয়াহিদুল হকের বিরুদ্ধে মামলা, পিরোজপুরের বন্দরবাড়ির আব্দুল মান্নান হাওলাদারসহ পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে মামলা, হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ের মধু মিয়া তালুকদার ওরফে মধু মিয়ার বিরুদ্ধে মামলা, ময়মনসিংহের কিতাব আলী ফকিরসহ পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে মামলা, সুনামগঞ্জের দিরাই ও শাল্লার মুক্তি মনির ওরফে মুক্তি মিয়াসহ ১১ আসামির মামলা, গাইবান্ধার গবিন্দগঞ্জের মোফাজ্জল হক প্রধানসহ নয় আসামির মামলা বিচার কাজ চলমান রয়েছে।

আর ময়মনসিংহের ফুলপুরের গিয়াস উদ্দিন খানসহ ১৫ আসামির মামলা, ফেনী সদরের মোফাজ্জল হোসাইন ওরফে তাজুসহ তিন আসামির মামলা, ঠাঁকারগাঁওয়ের আবেদ হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা, নীলফামারীর একরামুল হকসহ ছয় আসামির মামলা, ঝিনাইদহের আব্দুর রশিদসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে মামলা, গোপালগঞ্জের নিজামুল হক মিয়া ওরফে লুৎফর রহমান ওরফে লুতু মোল্লাসহ চার আসামির বিরুদ্ধে মামলার বিচার চলছে ট্রাইব্যুনালে।

এছাড়া সাতক্ষীরার কালিগঞ্জের আকবর আলী শেখের বিরুদ্ধে মামলা, বরগুনার আব্দুল মান্নান হাওলাদারসহ পাঁচ আসামি বিরুদ্ধে মামলা এবং কুড়িগ্রামের নজরুল ইসলামসজহ ১৩ আসামির বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিচার চলছে।