সরকারি যানবাহন পুলের জাহাজ ‘জিএমভি এ্যানি’ উদ্ধারে ছয় মাসে আগে পোস্তগোলার বুড়িগঙ্গা সেতুর নিচ দিয়ে সদরঘাটের ওয়াইজঘাট এলাকায় গিয়েছিল উদ্ধারকারী জাহাজ ‘প্রত্যয়’।
Published : 04 Jul 2020, 08:10 PM
সে সময় কোনো সমস্যা না হলেও গত ২৯ জুন ডুবে যাওয়া ‘মর্নিং বার্ড’ নামের ছোট লঞ্চটি উদ্ধার করতে গিয়েই ঘটে বিপত্তি।
নারায়ণগঞ্জ থেকে রওনা হওয়া জাহাজ ‘প্রত্যয়’র আঘাতে বুড়িগঙ্গা সেতুর গার্ডারের কিছু অংশে ফাটল দেখা দেয়। যার ফলে এখন ওই সেতুতে যান চলছে সীমিত আকারে।
ছয় মাস পর একই পথ অতিক্রম করতে গিয়ে কেন এই ঘটনা ঘটল? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেল বর্ষায় নদীতে পানি বাড়ার কারণে সেতু ও পানির মধ্যবর্তী স্থানের ফারাক কমে আসায় জাহাজটি ওই পথে নেয়ার বিষয়ে সংশয়ে ছিলেন এর কমান্ডার।
তারপরও উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ডাক পেয়ে রওনা হয়েছিল জাহাজটি। কিন্তু ‘প্রত্যয়’র বুম অনেকটা হেলানো হলেও বাতাস আর অনুকূল স্রোতের কারণে জাহাজটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। ফলে সেতুর সঙ্গে সংঘর্ষও এড়ানো যায়নি।
তবে বিআইডব্লিউটিএ বলছে, যত আশঙ্কাই থাকুক মাস্টার এখানে দায় এড়াতে পারে না। একটু সতর্ক থাকলে এই দুর্ঘটনা ঘটত না।
দুর্ঘটনার পর উদ্ধারকারী জাহাজ ‘প্রত্যয়’ নারায়ণগঞ্জ-৫ নম্বর ঘাট থেকে রওয়ানা দেয়। কিন্তু দুপুর ২টা ১২ মিনিটে পোস্তগোলা সেতুর গার্ডারে আঘাত করলে সেতুটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়; বন্ধ করে দেওয়া হয় সেতুর উপর দিয়ে যানচলাচল।
দুর্ঘটনাটি বিষয়ে জানতে চাইলে ‘প্রত্যয়’ জাহাজের কমান্ডার মো. জহির উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ডিসেম্বরে শুকনো মৌসুমে আমরা গিয়েছিলাম। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে বুড়িগঙ্গার পোস্তগোলা সেতুর নিচ দিয়ে ‘প্রত্যয়’ নেওয়া যাবে কিনা সংশয় ছিল।
তবু ক্রেনবার্জে পানি ভরে উচ্চতা দুই ফুট কমানো হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রত্যয়’ এর ৬১ ফুট উচ্চতার বুম ১৫ ডিগ্রি পর্যন্ত হেলানো যায়।
“১৫ ডিগ্রি হেলানোর পর বুমের উচ্চতার দাঁড়ায় ৪৮ ফুট কিন্তু পোস্তগোলা সেতুর কাছাকাছি আসার পর প্রথম শ্রেণির মাস্টার খায়রুল ইসলাম বুঝতে পারেন এই ক্রেনবার্জ নেয়া যাবে না। তখন মাস্টার টাগবোর্ড ‘দুরন্ত’ নিউট্রাল করে দিলেও স্রোত আর বাতাসের টানে আস্তে আস্তে বুমের ধাক্কা লাগে সেতুর গার্ডারে।”
গত ডিসেম্বরে যখন এই সেতুর নিচ দিয়ে নেওয়া হয়েছিল ‘প্রত্যয়’ তখন সেতুর গার্ডার থেকে বুমের মধ্যে প্রায় চার ফুট ফাঁক ছিল, কিন্তু এবার অল্পের জন্য আটকা পড়ে যায়।
“প্রত্যয় জাহাজের বুমের উচ্চতা যথাযথ রেখে সর্বোচ্চ সতর্কতায় জাহাজের স্পিড স্লো করে সেতুর নেভিগেশন স্পান দিয়ে অতিক্রমের চেষ্টার সময় স্রোতের টানে প্রত্যয়ের বুমের সামনের অংশ সেতুর গার্ডারের একেবারে নিচের অংশে হালকা আঘাত করে।
“এতে গার্ডারের নিচের কিছুটা অংশ এবং প্রত্যয়ের বুমের সামনের অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। টাগবোর্ডসহ হেভিওয়েট জাহাজটির ভর বেশি বিধায় বেগ কম হওয়ার পরও ভরবেগজনিত কারণে হালকা আঘাতেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণটা দৃশ্যমান হয়েছে।”
তার দাবি, জাহাজটি নিজস্ব ক্ষমতায় চালিত (সেল্ফ প্রোপেলড) নয়, এটি টাগবোর্ড দ্বারা পরিচালিত একটি ক্রেনবার্জ। সেল্ফ প্রোপেলড না হওয়ায় বিশালাকার ক্রেনবার্জটি টাগবোর্ড দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা খুবই দুরূহ ব্যাপার। হালকা স্রোত কিংবা বাতাসে সরু চ্যানেলে এটি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।
‘প্রত্যয়’ কমান্ডার মো. জহির উদ্দিন বলেন, নদীর গভীরতা ও প্রশ্বস্ততা বিবেচনায় চট্টগ্রাম থেকে সদরঘাট পর্যন্ত রুটটি প্রথম শ্রেণির উপযোগী নৌ-পথ। কিন্তু ১৯৮৯ সালে নির্মিত পোস্তগোলা সেতুটির ভার্টিক্যাল ক্লিয়ারেন্স প্রথম শ্রেণির উপযোগী (৬০ ফুট) করে নির্মিত হয়নি।
ঢাকার আশপাশে এমন ১৭টি সেতু রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এগুলো ভেঙ্গে সংস্কার করা না হলে এইসব জায়গায় পৌঁছানো যাবে না উদ্ধারকারী জাহাজ নিয়ে।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, প্রতি মাসে সেতুর নিচে পানির উচ্চতা মাপা হয়, মে মাসে যা ছিল ৫০ ফুট। তাই সবাই ধরে নিয়েছিল যে ‘প্রত্যয়’ আসতে পারবে। কারণ বুম হেলানোর পর উচ্চতা দাঁড়ায় ৪৮ ফুট, কিন্তু পানির লেভেল ৪৭ ফুট ছিল মনে হচ্ছে।
“কিন্তু এক ফুটের জন্য আসতে পারেনি। এটাতো মাস্টারের বুঝতে হবে। তার তো একটু হলেও ক্রটি আছেই। তা না হলে তো আর এই দুর্ঘটনা ঘটত না।”
বিআইডব্লিউটিএর একজন কর্মকর্তা বলেন, “মাস্টার ভেবেছিলেন সেতু ঘেঁষে ক্রেনবার্জটি নিতে পারবেন। তাই তিনি চেষ্টা করছিলেন কিন্তু একটু আঘাতে যে গার্ডারের এত ক্ষতি হবে, তা মাস্টারের ধারণা ছিল না। এটাই হল মাস্টারের অদক্ষতা।”
সড়ক ও জনপথ বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (ঢাকা অঞ্চল) সবুজ মিয়া খান বলছেন, সেতুর ক্ষতি করার দায় অবশ্যই বিআইডব্লিউটিএকে নিতে হবে।
“ভৈরব থেকে মেশিন এনে এক্সপার্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন, রোববার উনারা জানাবেন কি কি ক্ষতি হয়েছেন এবং ক্ষতিগ্রস্ত সেতু ঠিক করতে কত টাকা লাগবে।”
১৯৮৬ সালে নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে বুড়িগঙ্গা সেতুর নির্মাণ শেষ ও চালু হয় ১৯৮৯ সালে। এই সেতু বাংলাদেশ ও চীন যৌথভাবে তৈরি করে। ৭২৫ মিটার দৈর্ঘের এই সেতুটি প্রথম বুড়িগঙ্গা সেতু হিসেবে পরিচিত।
এ ঘটনায় কারও কোনো গাফিলতি ছিল কিনা তা খতিয়ে দেখতে বিআইডব্লিউটিএ ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।