সাংবাদিকরা না থাকলে সরকারি কর্মচারীরা নির্বিঘ্নে সব ধরনের অন্যায় করতে পারেন। ফলে যেসব প্রতিষ্ঠানে অন্যায় বেশি, সেসব প্রতিষ্ঠানে সাংবাদিক প্রবেশে কড়াকড়িও বেশি।
Published : 28 Apr 2024, 12:25 PM
‘বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা, নিয়মের কড়াকড়ি।’ গত ২৫ এপ্রিল এই বিসয়ে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয় দেশের একাধিক গণমাধ্যমে। খবরে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকরা অবাধে প্রবেশ করতে পারলেও গত এক মাস ধরে তারা সেখানে প্রবেশ করতে পারছিলেন না বলে অভিযোগ করে আসছিলেন। এ নিয়ে সাংবাদিকদের মধ্যে অসন্তোষ জন্ম নেয়। ফলে বিক্ষুব্ধ সাংবাদিকরা বৃহস্পতিবার সকালে বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে অবস্থান নেন।
বিষয়টি সমাধানের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে বৈঠক করেছে অর্থনীতি-বিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ)। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, এখন থেকে সাংবাদিকরা ব্যাংকের নির্দিষ্ট অনুমতিপত্র (প্রবেশ পাস) নিয়ে শুধু মুখপাত্রের কাছে যেতে পারবেন। তবে কোনো কর্মকর্তা যদি সাংবাদিকদের পাস দেন, সেক্ষেত্রে তারা শুধু সেই কর্মকর্তার কাছে যেতে পারবেন। তবে আগের মতো তারা অবাধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো বিভাগে প্রবেশ করতে পারবেন না।
বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে নিয়মের এই যে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে, তাকে প্রকারান্তরে নিষেধাজ্ঞা বলে সাংবাদিকরা মনে করছেন। মুখপাত্রের কাছে গিয়ে যে খবর পাওয়া যাবে, সেই সব খবর তো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতেই পাওয়া যায়।
এর আগে গত ৪ ফেব্রুয়ারি গণমাধ্যমের আরেকটি খবরের শিরোনাম: ‘সাংবাদিকের মোবাইল নিয়ে ছবি ডিলিট করলেন ম্যাজিস্ট্রেট'। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, মানিকগঞ্জে বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেন জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (সাধারণ শাখা) সাবিহা সুলতানা ডলি। এ সময় সংবাদ প্রকাশের জন্য ছবি তোলায় পুলিশের মাধ্যমে দৈনিক যায়যায়দিনের রিপোর্টারের মোবাইল নিয়ে সেগুলো ডিলিট করেন তিনি। ছবি তোলায় নিষেধাজ্ঞার কারণ জানতে চাইলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাবিহা সুলতানা সাংবাদিকদের বলেন, ছবি তোলার আগে এডিএম (অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক) স্যার অথবা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্যারের অনুমতি নিয়ে এলে ছবি তোলা অ্যালাউ করব।
প্রশ্ন হলো, কোনো ঘটনা বা অভিযানের ছবি তুলতে গেলে জেলা প্রশাসকের অনুমতি লাগবে— এটি দেশের কোন আইনে আছে এবং একজন ম্যাজিস্ট্রেট কী করে একজন সাংবাদিকের ফোন থেকে ছবি ডিলিট করেন? এই ক্ষমতা ও এখতিয়ার তাকে কে দিয়েছে? ঘটনার পরে ওই ম্যাজিস্ট্রেটের কি কোনো শাস্তি হয়েছে বা এই ঘটনায় কোনো নিরপেক্ষ তদন্ত হয়েছে?
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে বহুদিন ধরেই সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ২০১৪ সালের ২১ এপ্রিল একজন রোগীর আত্মীয়কে মারপিটের ঘটনার ছবি ওঠানোর সময় সাংবাদিকদের লাঠি ও হকিস্টিক দিয়ে বেধড়ক পেটান ইন্টার্ন চিকিৎসকরা। এতে অন্তত ১০ সাংবাদিক আহত হন। এ ঘটনায় সাংবাদিকরা প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন। এরপর থেকে রামেক হাসপাতালে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে কর্তৃপক্ষ। শুধু তাই নয়, ২০২০ সালের জানুয়ারিতে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও রাজশাহী মেডিকেলে সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষেধাজ্ঞার পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেন, হাসপাতালের ঢুকতে হলে সাংবাদিকরা পরিচালকের কাছে অনুমতি নেবেন তারপরে হাসপাতালে ঢুকবেন। হাসপাতালে অনেক ধরনের অসুখ-বিসুখ থাকে। তাই বেশি অ্যাটেনডেন্স থাকার কারণে রোগীদের নানা রকম জটিলতা দেখা দেয়। খবরটি ২০২০ সালের ৪ জানুয়ারির ইত্তেফাকে পাওয়া যাবে। নিশ্চয়ই অন্যান্য পত্রপত্রিকায়ও এই খবর প্রকাশ পেয়েছিল।
সেতু ভবনেও সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল ২০১৮ সালে। ওই বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সেতু ভবনের প্রবেশের দায়ে ‘আমাদের সময়’ পত্রিকার সিনিয়র রিপোর্টার তাওহীদুল ইসলামকে দেড় ঘণ্টা আটকে রাখা হয়। এরপর চলে দফায় দফায় জেরা। পরবর্তীতে মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তার হস্তক্ষেপে তিনি সেতু ভবন থেকে বের হন। এর আগে প্রথম আলোর সিনিয়র রিপোর্টার আনোয়ার হোসেন ও সমকালের স্টাফ রিপোর্টার রাজীব আহাম্মদকেও নাজেহাল করা হয়। এ সময় সেতু ভবন কর্তৃপক্ষের তরফে বলা হয়, সেতু ভবনে সাংবাদিকের কোনো কাজ নেই। দরকার মনে করলে দাওয়াত দেয়া হবে। সাংবাদিক প্রবেশ নিয়ে এই অবস্থানের কারণ জানতে সেতু বিভাগের তৎকালীন সিনিয়র সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামকে সাংবাদিকরা ফোন করলে তিনি উল্টো জিজ্ঞেস করেন, সাংবাদিকের কাজ কী সেতু ভবনে? তথ্য সংগ্রহের কথা তুলে ধরলে তিনি বলেন, ব্রিফিং ছাড়া সাংবাদিকের কোনো কাজ থাকতে পারে না। এ খবরটি ২০২৮ সালের ৭ ফেব্রুয়ারির ‘যুগান্তর’সহ বিভিন্ন পত্রিকায় পাওয়া যাবে।
আসলে কি তাই? সরকারি প্রতিষ্ঠানের তরফে ব্রিফিং না করলে ওই প্রতিষ্ঠানে সাংবাদিকের আর কোনো কাজ নেই? ওই ভবনে প্রবেশে সাংবাদিকের এখতিয়ার নেই? কোনো প্রতিষ্ঠানে যদি অনিয়ম ও দুর্নীতি চলে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কি ব্রিফিং করে সেই দুর্নীতি তুলে ধরবে? যদি তাই হয়, তাহলে পৃথিবীতে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা হবে কী করে? নাকি আমাদের দেশের সরকারি কর্মকর্তারা মনে করেন যে, কোনো অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার প্রয়োজন নেই? নাকি তারা সবাই ফেরেশতা এবং বাংলাদেশের কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয় না?
‘বিএসএমএমইউতে বাংলা ট্রিবিউনের সাংবাদিককে হেনস্তা’; ‘গণমাধ্যমে কথা বলতে অনুমতি লাগবে সরকারি কর্মচারীদের’; ‘সাংবাদিক হয়রানির প্রতিবাদে ইসির সামনে গণমাধ্যমকর্মীদের মানববন্ধন’— এরকম অসংখ্য সংবাদ গণমাধ্যেমের শিরোনাম হয়েছে।
স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১২ সালের ২৮ জুন সাংবাদিকদের প্রবেশে ‘মৌখিক নিষেধাজ্ঞা’ আরোপ করেছিল দুদক। ২০১৩ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালও গণমাধ্যম কর্মীদের ওপর ‘নিষেধাজ্ঞা’ আরোপ করে।
সরকারি অফিস চলে জনগণের ট্যাক্সের পয়সায়। জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় সরকারি কর্মচারীরা কী করছেন, জনগণকে কী সেবা দিচ্ছেন, কোন তরিকায় দিচ্ছেন, কী কী দুই নম্বরি করছেন— সেগুলো মানুষকে জানানোর দায়িত্ব সাংবাদিকদের। সুতরাং সরকারি অফিসে প্রবেশে, সেটি হোক জেলা প্রশাসকের দপ্তর, হোক সরকারি হাসপাতাল কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংক— সেখানে প্রবেশে সাংবাদিককে বিশেষ অনুমতি কিংবা পাস নিতে হবে কেন?
অফিসিয়াল সিক্রেসি আইনের দোহাই এবং তথ্য অধিকার আইনের অপব্যবহার করে তথ্য গোপন করা বা তথ্য না দেয়ার যে ‘কালচার’ তারা শুরু করেছেন, সেটি স্পষ্টত নাগরিক অধিকারের লঙ্ঘন এবং সরকারি চাকরি বিষয়ে যে সাংবিধানিক বিধান, তার স্পষ্ট খেলাপ।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আরেকটা উৎপাত শুরু হয়েছে, সেটি হলো, কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে ফোন করে কোনো তথ্য চাইলে দিতে চান না। বলেন, ‘অমুকের সাথে কথা বলেন।’ অমুক বলেন, ‘তমুকের সাথে কথা বলেন।’ টেলিভিশনে টকশোতে আমন্ত্রণ জানালেও আসতে চান না। বলেন, ‘অমুকের অনুমতি লাগবে।’ সেই অমুককে ফোন করলে তিনি ফোন ধরেন না। তাদের পিএসরা আরও বেশি ক্ষমতাবান। তাদের ভাবখানা এমন যে, সাংবাদিক তার কাছে তথ্য চেয়ে কিংবা তাকে কোনো অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে বিরাট অপরাধ করে ফেলেছেন।
ওনারা রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারে বসে জনগণের টাকার নয়ছয় করবেন; শত শত কোটি টাকা লুটপাট করে বিদেশে পাঠাবেন; জনগণের পয়সা মেরে সেই পয়সায় সন্তানদের বিদেশে পড়াবেন; দেশের অর্থনীতির বারোটা বাজাবেন— অথচ তথ্য চাইলে বলবেন অনুমতি নিয়ে আসুন। ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করুন...
অন্য যেকোনো পেশার একজন নাগরিকের প্রবেশাধিকার এবং সাংবাদিকের প্রবেশাধিকার এক নয়। সাংবাদিককে দেশ ও জনস্বার্থে তথ্য সংগ্রহ করতে হয়। সব প্রতিষ্ঠানে অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করতে হলে এবং ঘটনার বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা বক্তব্য না দিলে সাংবাদিকদের পক্ষে সঠিক সংবাদ তুলে ধরা সম্ভব নয়। যখনই তথ্য গোপন করা হয় বা তথ্য দিতে গড়িমসি করা হয়, তখনই অপতথ্য ও বিভ্রান্তি ডালপালা মেলে।
তথ্য অধিকার আইনের ধারা ৬ (২) এ বলা হয়েছে “তথ্য প্রকাশ ও প্রচারের ক্ষেত্রে কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো তথ্য গোপন করিতে বা উহার সহজলভ্যতাকে সংকুচিত করিতে পারিবে না।” কিন্তু কিছুদিন পরপরই সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেভাবে সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার সীমিত করে বা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তাতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত হলে বা সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার সীমিত ও সীমাবদ্ধ হলে যে অপরাধীদের সুবিধা হয়—সেটি সবাই বোঝেন। অতএব কারা কোন উদ্দেশ্যে গণমাধ্যমের কণ্ঠ রোধ করতে চান, সেটিও না বোঝার কোনো কারণ নেই।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, এখন সরকারি কর্মচারীরা আইনের দোহাই দিয়ে এবং আইনের মারপ্যাঁচ দিয়েই তথ্য গোপন করেন। তথ্য অধিকার আইনের দোহাই দিয়ে তারা সাধারণ একটি তথ্যের জন্যও তথ্য গ্রহীতাকে দরখাস্ত করাসহ বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতায় বাধ্য করেন—যাতে সাধারণ মানুষ তো বটেই, সাংবাদিকরাও তথ্য জানতে নিরুৎসাহিত হন। তাছাড়া সরকারি ও বেসরকারি বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের তথ্য ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়া অত্যন্ত দুর্বল ও জটিল। তথ্যের আপডেট থাকে না। তাই সাংবাদিকরা তাৎক্ষণিকভাবে সঠিক ও আপডেটেড তথ্য পাচ্ছেন না।
বিশেষ করে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে কোনো সরকারি অফিসে গিয়ে তথ্য বা সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য পাওয়া বেশ কঠিন। তথ্যের অবাধ প্রবাহের এই যুগে, যখন দেশে তথ্য অধিকার আইন নামে একটি অত্যন্ত যুগপযোগী ও জনবান্ধব আইন থাকার পরেও অফিসিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্ট বা সরকারি কর্মচারী বিধিমালার দোহাই দিয়ে তথ্য ও বক্তব্য না দেওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাছাড়া গণমাধ্যমকে দূরে রেখে সরকারের কোনো ভালো কাজ সম্পর্কেও মানুষকে জানানো যায় না। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রবণতা হলো, তারা শুধু ভালো খবরের প্রচার চায়। সমালোচনা শুনতে চায় না।
তথ্য অধিকার আইন এবং সংবিধান গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করলেও সংবাদ প্রকাশ ও প্রচারের কারণে নানারকম আইনি মারপ্যাঁচে ফেলে সাংবাদিকদের হয়রানি করার ঘটনাও ভুরি ভুরি। শুধু তাই নয়, নির্ধারিত আইনের বাইরেও সাংবাদিকদের হয়রানি করার জন্য চুরি, ডাকাতি, হত্যা ধর্ষণের মতো মিথ্যা মামলায়ও জড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্যবহার করে আর এই সব মামলা করার অভিযোগ আছে।
গত বছর ৮ এপ্রিল ডয়েচেভেলে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে, ২০২৩ সালের প্রথম তিন মাসে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ১০টি। ৫৬ জন সাংবাদিক হয়রানির শিকার হয়েছেন। এরমধ্যে শারীরিক নির্যাতনের ঘটনাও আছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২১ জন। আর রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের হাতে ১০ জন। এর আগে ২০২২ সালে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৪৬টি। হয়রানির শিকার ১২৬ জন। নিহত ছয় জন। আর আর্টিক্যাল নাইনটিনের হিসাবে, ২০২০ সাল থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারাদেশে ২২৩ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১১০টি মামলা হয়েছে। এইসব মামলায় মোট ৫৪ জন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়।
প্রশ্ন হলো, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কেন সাংবাদিকদের ভয় পান বা কেন গণমাধ্যমের প্রতি তাদের ভীতি কাজ করে? এর একটি বড় কারণ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো জনবান্ধব নয়। খুব ব্যতিক্রম ছাড়া মানুষ এসব প্রতিষ্ঠানে গিয়ে নির্বিঘ্নে, বিনা হয়রানিতে, বিনা ঘুষে সেবা পায় না। হাতেগোণা কিছু প্রতিষ্ঠান বাদ দিলে জনগণের পয়সায় পরিচালিত সকল প্রতিষ্ঠানে গেলেই কোনো না কোনো অনিয়ম, হয়রানি ও দুর্ভোগের চিত্র পাওয়া যাবে। আর যখন সেবাগ্রহীতাদের কাছে গিয়ে সাংবাদিকরা সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন করেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনও ভালো অভিজ্ঞতা শোনা যায় না। আর যখন সাধারণ মানুষ কোনো প্রতিষ্ঠানে সেবা পেতে গিয়ে নিজেদের খারাপ অভিজ্ঞতার কথা বলেন এবং সেই অভিজ্ঞতা যখন টেলিভিশনের পর্দায় বা পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত হয়, তখন এটি ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের প্রশ্ন ও জবাবদিহিতার মুখে ফেলে। কিন্তু আমাদের সরকারি কর্মচারীরা কোনও ধরনের প্রশ্ন বা জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে চান না। বরং তারা চান সেবা নিতে এসে সাধারণ মানুষ তাদেরকে ‘স্যার স্যার’ করবেন। জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় বেতন হলেও তারা সেই জনগণের কাছ থেকেই ঘুষ না পেলে কাজ করতে চান না। আর এইসব অসঙ্গতি সবচেয়ে বেশি ধরা পড়ে সাংবাদিকের ক্যামেরায়। অতএব সাংবাদিক থাকলেই তাদের সমস্যা। সাংবাদিকরা না থাকলে সরকারি কর্মচারীরা নির্বিঘ্নে সব ধরনের অন্যায় করতে পারেন। ফলে যেসব প্রতিষ্ঠানে অন্যায় বেশি, সেসব প্রতিষ্ঠানে সাংবাদিক প্রবেশে কড়াকড়িও বেশি।
মুশকিল হলো, নানারকম বিধিনিষেধ ও আইনি জটিলতার ভয়ে এখন অপরাধবিষয়ক যেকোনো সংবাদ, বিশেষ করে যেখানে রাজনৈতিক, সামাজিক ও আর্থিকভাবে ক্ষমতাবানরা যুক্ত আছেন, তাদের বিষয়ে অনেক অভিযোগ পেলেও সাংবাদিকরা সেসব অনুসন্ধানে খুব বেশি উৎসাহ পান না। কারণ অনুসন্ধান করে রিপোর্ট প্রকাশ করলেও ওই রিপোর্টের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (সাইবার নিরাপত্তা আইন) মামলায় তাকে ফাঁসানো হতে পারে— এমন ভয়ে থাকেন। অর্থাৎ একধরনের স্বনিয়ন্ত্রণ বা সেলফ সেন্সরশিপ এখন সাংবাদিকদের আঁকড়ে ধরেছে। আর যখন কোনো দেশের সাংবাদিকরাই ভয়ে থাকেন, তখন সাধারণ মানুষ কী করবে?