কুকুর সরানোয় সমাধান নেই, বুঝছেন সিটি কর্মকর্তারাও

বেওয়ারিশ কুকুরগুলোকে রাজধানী থেকে সরিয়ে ফেলার পক্ষে বললেও তা যে সমাধান নয়, তা বুঝতে পারছেন খোদ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা।

রাসেল সরকারমেহেরুন নাহার মেঘলা ওবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Sept 2020, 06:33 PM
Updated : 2 Sept 2020, 07:55 PM

এদিকে কুকুর স্থানান্তরের এই উদ্যোগের বিরোধিতা করছেন পশুপ্রেমীরা। এটা যে রাষ্ট্রীয় আইনের লঙ্ঘন, তাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন তারা।

কুকুরের উপদ্রব থেকে রক্ষা পেতে বন্ধ্যাত্বকরণ কর্মসূচি জোরদার এবং জলাতঙ্কের টিকা দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন পশুপ্রেমীরা।

ঢাকা শহরে রয়েছে অসংখ্য কুকুর। সংখ্যাটি এখন কত, সঠিক কোনো পরিসংখ্যান কারও কাছেই পাওয়া যায় না।

২০১৬ সালের এক জরিপ অনুযায়ী, ঢাকায় উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় কুকুরের মোট সংখ্যা ৩৭ হাজার। তবে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বলছে, কুকুরের সংখ্যা এখন দেড় লাখ।

এরমধ্যে রাস্তায় কুকুরের কারণে বিড়ম্বনার শিকার হওয়ার অভিযোগ নাগরিকদের কাছে পেয়ে সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ৩০ হাজার কুকুর সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়।

ডিএসসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বাসিন্দাদের কাছ থেকে কুকুর সম্পর্কিত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার অভিযোগ পাওয়ার পরই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

“বিভিন্ন জায়গা থেকে আমাদের কাছে প্রচুর অভিযোগ আসে যে, রাস্তাঘাটে কুকুরের যন্ত্রণার শিকার হচ্ছে নগরবাসী। ফলে আমাদের বাধ্য হয়েই এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।”

লকডাউনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাত থেকে আটটি স্থানে প্রতিদিন কুকুরদের খাবার দিচ্ছিলেন ইসতিয়াক আহমেদ হৃদয় ও তার বন্ধুরা। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

রাজধানী কাঁঠালবাগান এলাকার বাসিন্দা ফারহানাজ রুমি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তার এলাকার গলিতে সকাল থেকেই ১০-১২টি কুকুর বসে থাকে।

“বাচ্চাকে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার সময়, বাজার করতে কিংবা কোনো কারণে বাইরে যেতে হলে বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। কুকুর প্রাণী হিসেবে মানুষের সবচেয়ে কাছের হলেও মাঝে মাঝে বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হতে হয়। এর সমাধান দরকার।”

এর ‘প্রাথমিক সমাধান’ হিসেবে কিছু কুকুর মাতুয়াইল এলাকায় স্থানান্তরের একটি পরিকল্পনা নেয় ডিএসসিসি। কিন্তু সেখানে কুকুরগুলোর খাবারের সঙ্কটে পড়বে ভেবে সেই পরিকল্পনা বাতিল করা হয়েছে।

এবিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান ভেটেরিনারি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত করা হয়নি।

“দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মহোদয় বলেছেন, নগরবাসীর সুবিধার্থে কুকুর সরিয়ে ফেলতে হবে। কিন্তু আমি তাকে বলেছি, সরিয়ে ফেলাটা কোনো সমাধান নয়। এদের সরিয়ে ফেললে এরা আবার আগের জায়গাতেই ফিরে আসবে।”

কুকুর সমস্যা নিয়ে আলোচনা চলছে জানিয়ে শফিকুল বলেন, “আলোচনায় এতখানি চূড়ান্ত হয়েছে যে, নগর ভবন, রমনা ও ধানমণ্ডি এই তিন এলাকার কুকুর সরিয়ে ফেলা হবে।”

তবে তাতেও কোনো লাভ হবে না বলে মনে করেন তিনি।

“এর আগে এমনটা করা হলেও কুকুরগুলো আগের জায়গাতেই ফিরে এসেছে।”

রাজধানীতে এখন বেওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যা দেড় লাখ বলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ভাষ্য।

কুকুরের সংখ্যা কত?

কুকুরের সংখ্যার  যে হিসাব দক্ষিণ সিটি করপোরেশন দিচ্ছে, তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন প্রাণী অধিকার সংরক্ষণ বিষয়ক বেসরকারি সংস্থা 'অভয়ারণ্য'র চেয়ারম্যান রুবাইয়া রহমান।

গত ৩১ অগাস্ট তিনি এক ফেইসবুক লাইভে ডিএসসিসির সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্টি জানানোর পাশাপাশি বলেন, “ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন বলছে কুকুরের সংখ্যা এক থেকে দেড় লাখ। এর মধ্য থেকে ৩০ হাজার কুকুর সরিয়ে ফেলা হবে। এই হিসাব কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।”

পরবর্তীতে অভয়ারণ্যের ফেইসবুক পাতায় কুকুরের সংখ্যা নিয়ে একটি পরিসংখ্যান দেওয়া হয়।

সেখানে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে হিউম্যান সোসাইটি ইন্টারন্যাশনাল এবং অভয়ারণ্য, কনজারভেশন রিসার্চ লিমিটেডের ড. লেক্স হিবির তত্ত্বাবধানে ঢাকা নগরীতে পথ কুকুরদের নিয়ে একটি জরিপ করে।

জরিপ অনুসারে

>> ঢাকায় উত্তর ও দক্ষিণের সম্মিলিত মোট কুকুর এর সংখ্যা ৩৭ হাজার।

>> এর মধ্যে উত্তরের কুকুরের সংখ্যা ২৪ হাজার এবং দক্ষিণে ১২ হাজার।

>> উত্তরের ২৬ শতাংশ কুকুর এবং দক্ষিণের ১৩ শতাংশ কুকুর টিকাপ্রাপ্ত এবং বন্ধ্যা।

>> ঢাকা শহরে প্রতি কিলোমিটারে ১২টি কুকুর বসবাস করে।

>> গড় অনুপাতে ঢাকা শহরে প্রতি ২০০ মানুষে একটি কুকুর বসবাস করে (উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের তুলনায় এটি খুবই কম)।

এই জরিপের আগে প্রায় দুই বছর ঢাকা শহরে কুকুরের টিকাদান এবং বন্ধ্যাকরণ কাজ প্রায় বন্ধ ছিল বলে অভয়ারণ্য জানায়।

প্রাণী অধিকার রক্ষা সংগঠন কেয়ার ফর প’জের চেয়ারম্যান সৌরভ শামীম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোনো একটি এলাকায় একসাথে ১০টা কুকুর দেখলে বলা হয়, ওই এলাকার অলিতে-গলিতে ১০টা করে কুকুর!

“এইভাবে কুকুরের পপুলেশন নিয়ে সবার মধ্যে এক ধরনের বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। সঠিক পরিসংখ্যান কেউই বের করতে পারেনি। তবে এক্ষেত্রে অভয়ারণ্যের দেওয়া পরিসংখ্যানটি গ্রহণযোগ্য।”

ঢাকা শহর থেকে ৩০ হাজার কুকুর বাইরে স্থানান্তরের ঘোষণা দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, যার প্রতিবাদে ধানমণ্ডি ১০ এ সড়কের পাশে দেয়ালে রঙ-তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মানুষ ও কুকুরের সহাবস্থানের চিত্র। পিপল ফর এনিমেল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে শুক্র ও শনিবার চলে এই চিত্রাঙ্কন।

 

সোচ্চার পশুপ্রেমীরা

বেওয়ারিশ কুকুর সরানোর কথা শুনেই ইন্টারনেটে সোশাল মিডিয়ায় সরব হয়েছেন বিভিন্ন প্রাণী অধিকার সংস্থা এবং পশুপ্রেমীরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় ঘুরে বেড়ায় অসংখ্য কুকুর। সেখানকার পথশিশুদের সঙ্গেও তাদের সখ্য বহুদিনের।

পথশিশু এক ফুল বিক্রেতা সাকিব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলে, “এই কুত্তাগুলা আমাগো লগেই থাকে, খায়। মালা আর ফুল বেইচ্চা যা পাই তা দিয়া রুটি, বিস্কুট কিনলে অগোরেও সেইখান থেইক্কা ভাগ দেই। কোনোদিনও আমগোরে কামড়ায় নাই। অগোরে ছাড়া কেমনে থাকুম?”

টিএসসি এলাকার কুকুরগুলোর সঙ্গে সখ্য রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীরও। বিকালের আড্ডায় চা খেতে বসে অনেকেই খাবার তুলে দেন এই কুকুরগুলোর মুখে।

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী আরেফিন মিজান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কুকুর যেহেতু একটা নির্দিষ্ট এলাকায় বসবাসে অভ্যস্ত প্রাণী, সেহেতু এদের সরিয়ে অন্যত্র নিয়ে যাওয়াটা আমার কাছে যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয়না। কারণ অন্য এলাকায় গিয়ে এরা বাঁচবে না।”

লকডাউনে খাদ্য সঙ্কটে পড়া অফিসপাড়ার কুকুরগুলোকে নিজ উদ্যাগে খাবার দিচ্ছিলেন কেউ কেউ। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

আরেক শিক্ষার্থী শারমিন জাহান জুহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কুকুর অন্যত্র সরানো হলে তাদের অভিযোজনে সমস্যা হবে এবং তারা মারা যাবে। এটা পরিবেশের জন্যও বিশেষ সুফল বয়ে আনবে না। বরং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।”

কেয়ার ফর প’জের চেয়ারম্যান সৌরভ শামীম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কুকুর অপসারণ কোনো সমাধান না। কারণ যেখানে কুকুরগুলোকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে, সেখানেও একই সমস্যা সৃষ্টি হবে। এক জায়গা থেকে এতগুলো কুকুর সরিয়ে নিয়ে যাওয়াটা পরিবেশের জন্যও হুমকি।”

 

ডিএসসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গ্রামের পরিবেশ আর শহরের পরিবেশের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে।

“গ্রামাঞ্চলে কুকুর-বেড়ালের সাথে মানুষের সখ্য গড়ে উঠলেও নাগরিক সমাজের অধিকাংশই সেটা করতে পারে না। রাস্তাঘাটে কুকুর দেখে অনেকেই ভয় পায়, বিপজ্জনক মনে করে।”

 

সমাধান টিকায়?

পিপল ফর এনিমেল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠা সভাপতি রাকিবুল হক এমিল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কুকুর না সরিয়ে জলাতঙ্ক টিকা ও বন্ধ্যাত্বকরণ প্রকল্প ঠিকমতো চালিয়েই সমস্যার সমাধান সম্ভব।

কুকুর সরানোর সিদ্ধান্তটি আইনের লঙ্ঘন বলেও মনে করিয়ে দেন তিনি।

এমিল বলেন, “২০১৯ সালে নতুন প্রাণী কল্যাণ আইন হয়েছে। ওই আইনের সাত নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘মালিকহীন কোনো প্রাণীকে নিধন বা অপসারণ করা যাবে না’। সরকারের একটি প্রশাসন এই আইন ভঙ্গ করতে পারেন না।”

জলাতঙ্ক রোগ নির্মূল প্রকল্প সম্পর্কে তিনি বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে সরকারের জাতীয় জলাতঙ্ক নির্মূল কর্মসূচি চলছে। ২০২২ সালের মধ্যে সরকার দেশকে জলাতঙ্ক মুক্ত করবে। এই প্রকল্পের অধীনে সারাদেশ ৭০ শতাংশ কুকুরকে প্রথম রাউন্ডের টিকা দেওয়া হয়েছে। আরও দুই রাউন্ড টিকা দিতে হবে।

“করোনাভাইরাসের কারণে এবছর টিকা দিতে পারছে না। যদি ওই টিকা না দিয়ে অন্যত্র সরিয়ে ফেলে, তাহলে দক্ষিণ সিটি জলাতঙ্কের জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়বে। কারণ টিকা দেওয়া কুকুর সরিয়ে নিলে নতুন কুকুর আসবে।”

বন্ধ্যাত্বকরণ প্রকল্প সম্পর্কে তিনি বলেন, উত্তর সিটি কর্পোরেশনে বন্ধ্যাত্বকরণ কর্মসূচি অভয়ারণ্য সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্কিত। সেখানে এটা চলছে। দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এটা চলছিল। কিন্তু গত বছর দক্ষিণ সিটির প্রধান ভেটেনারি কর্মকর্তা আজমত আলীর মৃত্যুর পর এ কর্মসূচি বন্ধ হয়ে গেছে।

“এখন দক্ষিণ সিটি যদি কুকুর ধরে অন্যত্র সরাতে পারে, বন্ধ্যাত্বকরণ কেন পারবে না? সবই কিন্তু তারা খরচ করছে। শুধু তাদের ভেটেনারি সার্ভিসটা প্রয়োজন।”

কেয়ার ফর প’জের চেয়ারম্যান সৌরভ শামীম বলেন, “প্রয়োজনে আমরা বিভিন্ন সংস্থা এসব কাজে এগিয়ে আসব এবং যথাযথ সাহায্যমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতেও আমরা রাজি আছি।”

তিনি বলেন, “মাননীয় মেয়র দেশের বাইরে আছেন। উনি ফিরে এলে এ বিষয়ে তার নিকট আমরা একটি স্মারকলিপি পেশ করব। আশা করছি উনি সমস্যাটি সুষ্ঠুভাবে সমাধান করবেন।”

শহরে কুকুর থাকার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে রাকিবুল হক বলেন, “কুকুর মানুষের পরম বন্ধু। মানুষের নিরাপত্তায় অতন্দ্র প্রহরী। ময়লা-আবর্জনা খেয়ে শহরের পরিচ্ছন্নতায় তাদের অবদানের শেষ নেই।

“কিন্তু উপকারের বিপরীতে বরাবরই কুকুর, বিড়াল ও কাকের মতো প্রাণীগুলোকে সহ্য করতে হয় নানা নিপীড়ন। কুকুরের মতো এত চমৎকার একটা প্রাণীকে একটু ভালোবাসা দেখাতে এত কার্পণ্য কেন? নগরের কুকুর নগরেই থাকুক, আমাদের ভালোবাসায় আর যত্নে। সিটি কর্পোরেশনের দ্রুত বোধোদয় হোক।”